Connect with us

ফিচার

রাণীনগরের সুস্বাদু কুমড়া বড়ি চালান হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে

Published

on

মনোরঞ্জন চন্দ্র, রাণীনগর: গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ফাঁকা রোদ মাখানো স্থানে চাটাইয়ের উপড় সারি সারি করে বিছানো সাদা রঙ্গের মাসকালাইয়ের তৈরি কুমড়া বড়ি শুকানো হচ্ছে। কেউ কেউ আবার শুকনো বড়িগুলো বাঁশের চাটাই থেকে খুলছে আবার কেউ কউে সেই বড়ি সৎকার করছে এরকম হাজারো দৃশ্য চোখে পড়বে। এহলো মাসকালাইয়ের কুমড়া বড়ি তৈরির গ্রামের বর্ণনা। বর্তমানে এই গ্রামের নাম কুমড়া বড়ির গ্রাম।

অনেক সকাল থেকেই এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠানে উঠানে চলে এই বড়ির তৈরির কাজ। বাড়ির গৃহিণী থেকে শুরু করে ছোট-বড় ও বয়স্ক লোক সবাই মিলে তৈরি করছে সুস্বাদু ও অধিক পুষ্টিগুন সম্পন্ন এই কুমড়া বড়ি। এহলো নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের খট্টেশ্বর গ্রামের বর্ণনা। এই গ্রামে শতাধিক বছর পূর্ব থেকেই বিখ্যাত এই বড়ি তৈরি করা হয়। তাই আজো এখানকার কারিগররা শত বাঁধাকে উপেক্ষা করে পৈত্রিক এই পেশাটিকে ধরে রেখেছে। সারা বছর টুকটাক তৈরি হলেও শীত মৌসুমে এই বড়ি তৈরির ধূম পড়ে যায়। এই বড়ি মূলত শীতকালের একটি আর্কষনীয় খাবার পণ্য। বর্তমানে এই গ্রামের সকলেই সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শীত মৌসুমে এই বড়ির চাহিদা বেশি থাকায় এখন এই বড়ি তৈরির পল্লীতে বড়ি তৈরি নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। অর্ধেক রাত থেকে শুরু হয় এই বিখ্যাত বড়ি তৈরির কাজ। নিজ উপজেলার প্রয়োজন মিটিয়ে চালান হচ্ছে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, উপজেলার নিজস্ব একটি ঐতিহ্যপূর্ণ খাবার হলো এই মাসকালাইয়ের কুমড়া বড়ি। এটি শীত মৌসুমের একটি বিশেষ খাবার। শীতের ৬মাসই মূলত এই বড়িটি তৈরি করা হয়ে থাকে। দিন দিন এর চাহিদা বেড়েই চলেছে। বড়িতে রয়েছে অধিক মানের পুষ্টি। বড়ি তৈরির সব উপকরণই পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার পণ্য। তাই এই বড়িতে ভেজাল বলে কিছুই নেই। শীত মৌসুমে যে কোন তরকারিতে এই কুমড়া বড়ি যোগ করে আলাদা একটি স্বাদ। উপজেলার মধ্যে শুধুমাত্র রাণীনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের খট্টেশ্বর গ্রামে শত বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ এই কুমড়া বড়ি বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করে আসছে এখানকার কারিগররা। এই গ্রামের ২৫-৩০টি পরিবারের মানুষ পৈত্রিক ভাবেই তৈরি করে আসছে এই কুমড়া বড়ি। এই কটি বাড়ির কুমড়া বড়ি তৈরির কারিগররাই আজো ধরে রেখেছে ঐতিহ্যপূর্ণ এই কুমড়া বড়ির শিল্পটি। তবে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ অনেকটাই কমে গেছে বলে জানান কারিগররা ।

খট্টেশ্বর গ্রামের মৃত- বলায় চন্দ্র দাসের ছেলে জীবন কুমার জানান, ‘এই তৈরির পেশাটি আমাদের বাপ-দাদার। তাই আজো তা করে আসছি। এই বড়ি মূলত মাসকালাই, চাল কুমড়া, জিরা, কালোজিরা, মোহরী দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি বড়ি ২৫০-৩০০ টাকা (বড় আকারের) এবং ১০০-১৫০টাকা (ছোট আকারের) করে খুচরা-পাইকারি বিক্রয় করা হয়। নিজ এলাকার প্রয়োজন মিটিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রংপুর, দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই বড়িগুলো সরবরাহ করা হয়। এই শীতকালই হচ্ছে এই কুমড়া বড়ির মৌসুম। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিনিয়তই পাইকাররা এসে আমাদের কাছ থেকে এই বড়ি কিনে নিয়ে যায়। এছাড়া আমরা স্থানীয় বিভিন্ন হাটেও খুচরা বিক্রয় করি’।

একই গ্রামের বড়ি তৈরির কারিগর নিতাই চন্দ্র জানান, ‘আমরা নিম্ম আয়ের কিছু মানুষ ঐতিহ্যপূর্ণ এই পৈত্রিক পেশাটিকে আজো ধরে রেখেছি। আমরা বিভিন্ন এনজিও-সংস্থা থেকে ঋন নিয়ে কোন মতে এই শিল্পটাকে ধরে রেখেছি। যার কারণে আমামের ইচ্ছে থাকলেও এই শিল্পটাকে প্রসারিত করতে পারছি না কারণ আমাদের পুজি কম। আমরা যদি কম সুদে ঋণ পেতাম তাহলে বড় ধরনের অর্থ খাটিয়ে এই শিল্পটাকে আরো অনেক বড় করতে পারতাম। এখন কোন মতে খেয়ে-পড়ে বেচেঁ আছি। আগের তুলনায় একণ বড়ি তৈরির উপকরণের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় লাভ অনেকটাই কমে গেছে। তবু শত কষ্টেও বাপ-দাদার এই পেশাটি আমরা ধরে রেখেছি’।
এই কুমড়া বড়ি তৈরির বিষয়ে আরেক বড়ি তৈরির কারিগর শান্তি রাণী জানান, ‘প্রথমে আমরা মাসকালাই পানিতে ভিজিয়ে ঘষে পরিস্কার করে মেশিনে ভেঙ্গে গুড়া করে আবার তা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রুটি তৈরির আটার মতো অবস্থায় পরিণত করা হয়। এরপর এর সঙ্গে চাল কুমড়া পিষিয়ে অন্যান্য উপকরন মিশিয়ে বড়ি তৈরি করা হয়। এরপর তা ২-৩দিন রোদে ভালো ভাবে শুকানোর পর বিক্রয় করা হয়। বড়িকে শক্তিশালী করার জন্য এর সঙ্গে খুব কম পরিমাণে আলো চালের আটা মিশানো হয়। প্রতি কেজি মাসকালাই থেকে প্রায় ৬শ গ্রাম কুমড়া বড়ি তৈরি হয়। যে কোন রান্না করা তরকারির সঙ্গে এই কুমড়া বড়ি রান্না করা যায়। আর রান্নার পর তরকারিতে এই বড়ি যোগ করে অন্য রকমের এক স্বাদ’।

স্থানীয় ইউপি মেম্বার রূপকুমার জানান, ‘সারা দেশে এই গ্রামের তৈরি কুমড়া বড়ির সুনাম রয়েছে। অনেক দুর-দুরান্তের মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা এসে এই গ্রামের কুমড়া বড়ি নিয়ে যায়। তবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত নি¤œ আয়ের মানুষরা সরকারি ভাবে কিংবা কোন সংস্থার কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পায় না। যদি এই মানুষরা আর্থিক ভাবে সহযোগিতা পেতো তাহলে এই শিল্পটি আরো প্রসারিত হতো। আরো অনেক বেকার মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। সরকার ইচ্ছে করলে এই সুস্বাদু বড়ি বিদেশেও রপ্তানি করতে পারে। এই বড়ি যদি বিদেশে রপ্তানী করা সম্ভব হয় তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষরা যেমন লাভবান হবে তেমনি সরকার রাজস্ব হিসাবে আয় করতে পারবে অনেক অর্থ। এটি বাস্তবায়ন করতে শুধুমাত্র সরকারের উর্দ্ধতন ব্যক্তিদের ইচ্ছে শক্তিই যথেষ্ট বলে তিনি মনে করেন।

রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া বিনতে তাবিব জানান, ‘জেলার মধ্যে রাণীনগর উপজেলার একমাত্র এই খট্টেশ্বর গ্রামটিতেই অনেক বছর যাবৎ বাণিজ্যিক ভাবে পুষ্টিগুন সম্পন্ন এই সুস্বাদু মাসকালাইয়ের কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে। অন্যান্য গ্রামে বাণিজ্যিক ভাবে এই বড়ি তৈরি করা হয় না। তবে সরকারি ভাবে যদি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে এই শিল্পটি আরো অধিক প্রসারিত হতো। তবে এখানকার কারিগররা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে আমরা তাদেরকে সরকারি ভাবে না হোক উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *