Connect with us

দেশজুড়ে

সাতক্ষীরায় প্রবাসীর স্ত্রী ও স্বজনদের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বর্বর নির্যাতন

Published

on

সাতক্ষীরার করারোয়ায় মালেশিয়া প্রবাসীর স্ত্রী ও স্বজনদের এভাবেই নির্যাতন করে কথিত সমাজপতিরা

সাতক্ষীরার করারোয়ায় মালেশিয়া প্রবাসীর স্ত্রী ও স্বজনদের এভাবেই নির্যাতন করে কথিত সমাজপতিরা

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:  সাতক্ষীরার কলারোয়ায় অসামাজিক কার্যকলাপের কল্পিত অভিযোগ তুলে এক মালয়েশিয়া প্রবাসীর স্ত্রী, তার খালাতো বোন ও বোন জামাইকে প্রকাশ্যে রশি দিয়ে বেঁধে , বাঁশের লাঠি ও কুড়ালের আছাড় দিয়ে পিটিয়ে অমানষিক নির্যাতন করেছে একদল সন্ত্রাসী। কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে তাদেরকে ‘ওই গ্রামে আর ফিরবে না’ এই শর্তে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

বর্বর নির্যাতনের এই ঘটনাটি এখান থেকে ১৩ দিন আগে ঘটলেও লোকলজ্জার ভয়ে নির্যাতনের শিকার কেউ মুখ খুলেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষটি ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ বিল্লাল হোসেন নামের একজনকে গ্রেফতার করলেও প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতার প্রচেষ্টায় আদালত থেকে সে জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় গিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে, লোক লজ্জায় নিজের মুখ লুকিয়ে রেখেছেন নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ সুমাইয়া খাতুন। আর তার খালাতো বোন রুমা খুঁজছেন আত্মহননের পথ। তার স্বামী জাহিদও লোকলজ্জার ভয়ে ঘরের বাইরে আসতে পারছেন না। বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ সুমাইয়া পিত্রালয়ে নিজেকে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী করে রেখেছেন। অপরদিকে তার খালাতো বোন ও বোন জামাই সামাজিক দুর্নাম ও নির্যাতন মাথায় নিয়ে বেড়াচ্ছেন।

নির্যাতনের ঘটনাটি ১৩ দিন আগের হলেও উভয় পক্ষ তা নিজ নিজ কারণে চেপে রাখার চেষ্টা করে। অবশেষে তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সন্ত্রাসীরা নিজেদের ঠেকাতে এখন পুলিশ ও সংবাদকর্মীদের দ্বারস্থ হয়েছেন। স্থানীয়রা বলেন উভয় পক্ষকে ম্যানেজ করে এরই মধ্যে তারা বেশ সময় কাটিয়ে দিয়েছে।

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের ডা. আবদুল আজিজের মেয়ে (নির্যাতনের শিকার) সুমাইয়া খাতুন জানান, প্রায় ১২ বছর আগে তার সাথে বিয়ে হয় একই উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের পাঁচপোতা গ্রামের হেজো মোড়লের ছেলে হাফিজুলের। হাফিজুল গত তিন বছর যাবত মালয়েশিয়া প্রবাসী। সুমাইয়া জানান, স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে একই গ্রামের ইব্রাহীমের ছেলে ট্রলিচালক চোরাকারবারী বিল্লাল হোসেন তাকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতো। তার মোবাইল ফোন নম্বর চেয়েও না পাওয়ায় সে আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সুমাইয়া পরিচয়ে বিল্লালের মামী । তার খারাপ প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে বিল্লাল তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে অশোভন কথা বলে বেড়াতো।

সুমাইয়া আরও জানান কিছুদিন আগ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় থেকে বাড়ি ফিরে আসা তার ভাসুর মোস্তফা মোড়লের সাথে তার স্বামীর জমির সীমানা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয় । ভাগনে বিল্লাল এই সুযোগে তার মামা মোস্তফার পক্ষ নিয়ে সুমাইয়া সম্পর্কে আরও বেশি করে কটূক্তি করতে থাকে। এঘটনার পর ভাই ওমর শরিফ তার বোন সুমাইয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসেন মাস চারেক আগে।

সুমাইয়া জানান, তিনি গত ২৭ অগাস্ট মেয়ে ঈশিতা ও তার খালাতো বোন কলারোয়ার ব্রজবাকসা গ্রামের আকরাম সরদারের মেয়ে রুমা খাতুনকে সাথে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যান। এর ২ দিন পর ২৯ অগাস্ট রুমার স্বামী জাহিদুল ইসলামও আসেন তাদের বাড়িতে। দুপুরে তারা যখন একই ঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত সে সময় তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে বিল্লাল , গোলাম মোস্তফার ছেলে রুহুল কুদ্দুস , ভাসুর মোস্তফা মোড়ল , জিয়া , জোহর , লাল্টু ,ভোলা ,ইসমাইল,ইমান মুহুরি, আশরাফুল , কওসারসহ বেশ কয়েকজন।

তারা নিজেদের সমাজপতি দাবি করে সুমাইয়াদের ঘরে ঢুকে পড়ে। সুমাইয়া জানান, তারা তার বোন রুমা ও বোন জামাই জাহিদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি তাদেরকে নিজের বোন ও বোন জামাই বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় তারা তাদের বিয়ের কাগজপত্র দেখতে চায় । রুমা জানান ‘দেড় বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে । কাগজপত্র তো সাথে কাছে থাকেনা ’। এ কথা শুনবার পর মুহুর্তেই তারা বলেন ‘ ৫০ হাজার টাকা নগদ দেন, তাহলে আমরা কোনো ক্ষতি করবো না’ । এতে আপত্তি জানালে তারা ঘরের আসবাবপত্র ভাংচুর করতে শুরু করে। এ সময় যে যার মতো নগদ টাকা , গলার চেইন , মোবাইলসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। কুদ্দুস সুমাইয়ার মুখে কয়েকটি চড় বসিয়ে মজা করে । তারা গরু বাঁধার রশি এনে তিনজনকেই হাতে ও পিঠে বেঁধে টানতে টানতে ঘরের বাইরে এনে শুরু করে বাঁশের লাঠি ও কুড়ালের আছাড় খুলে মারপিট । এ সময় সেখানে এলাকার শত শত মানুষ জড়ো হয়। তাদের সামনেই ওই তিন জনকে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।

যন্ত্রনায় বিকট চিৎকার দিলেও এলাকার ছেলে-মেয়ে বুড়ো-বুড়ি সবাই এতে উৎসাহ যুগিয়ে উল্লাস করতে থাকে। এভাবে বেশ কয়েক মিনিট যাবত মারপিট করার পর তাদেরকে ফের টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে প্রতিবেশি পুলিশিং কমিটির সদস্য ইসমাইলের বাড়িতে।

একই ভাবে সেখানে মারধর করার পর তাদেরকে একশ’ বার কান ধরে ওঠ-বস করার শাস্তি ঘোষনা করা হয় । সুমাইয়া জানান ‘ আমাদের চার পাশে ঘুরে ঘুরে নাটকীয় কায়দায় প্রচন্ড মারপিট আর কান ধরে ওঠ-বসের মতো অপমান ও শারীরিক নির্যাতনের সময় তারা বারবার চিৎকার দিয়ে বলেছি ‘ আমাদের কোনো দোষ নেই , আমাদের ছেড়ে দিন , আমাদের মারবেন না’ । কিন্তু পাষন্ডরা সেসব কথার পাত্তা না দিয়্ইে চালাতে থাকে নির্যাতন । গ্রামপুলিশ ইব্রাহীম , আসমা,ইয়াসমিন , মুনসুর, সাবিনা , তানজিলা বেগমসহ শতাধিক নারী পুরুষ তা প্রত্যক্ষ করেও ছিলেন নির্বিকার । সুমাইয়া জানান এতো বড় নারকীয় ঘটনার সময় তার বৃদ্ধা ও অসুস্থ শাশুড়ি ‘ ওদের মারিসনে , মারিসনে ’ বলে বারবার বললেও তার কোনো গুরুত্ব দেয় নি তারা ।

এদিকে দিন দুপুরে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে আসেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. ফারুক হোসেন ও তার ছেলে সবুজ। সুমাইয়া জানান, ফারুক তাদের কাছ থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে ওড়না ও রশির বাঁধন খুলে দেন । এরপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সুমাইয়া।তার বোন রুমা ও বোন জামাইও গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সেখান থেকে সরে যায় । তাদের কাছ থেকে মোবাইল, নগদ টাকা ও সোনার গয়নাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

আফসোস করে সুমাইয়া জানান অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকলেও তাকে কেউ এক গ্রøাস পানিও খাওয়াতে আসেনি।এ অবস্থায় তাকে তার ঘরে তুলে ফেলে রাখা হয়। ইউপি সদস্য ফারুক জানান তিনি গ্রাম্য ডাক্তার বাসারকে ডেকে আনেন । ডাক্তার সুমাইয়াকে অচেতন অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চলে যান।

সুমাইয়ার ভাই ওমর শরিফ জানা,ন তিনি রাত ১২ টায় জানতে পারেন তার বোনের ওপর নির্যাতনের কথা। ওই রাতেই তিনি ও তার চাচা মফিদুল ইসলাম তাকে কলারোয়া হাসপাতালে নিয়ে আসেন । সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়।

লোকলজ্জা এবং পরবর্তী বিপদ আপদের আশংকায় সব নির্যাতনের কথা চেপে রেখে ঘটনার কয়েকদিন পর গত ৬ সেপ্টেম্বর সুমাইয়া বাদি হয়ে কলারোয়া থানায় একটি মামলা দেন । এই মামলা দায়ের করার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সুমাইয়া জানান ‘দারোগা মোয়াজ্জেম হোসেনকে আমি যা বলেছি তা তিনি লেখেননি । একই কথা বারবার বলতে হয়েছে । তাও লুকোচুরি করেছেন দারোগা।তিনি বলেন মামলায় নাম দিয়েছেলাম মোট ২০ জনের ।অথচ এতে লেখা হয়েছে মাত্র তিনজনের নাম’ । সুমাইয়ার এই মামলা করতে খরচও হয়েছে বেশ, জানালেন তার স্বজনরা।

কলারোয়া থানার উপ-পরিদর্শক ( এসআই) মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, এফআইআরভুক্ত আসামিরা হচ্ছে রুহুল কুদ্দুস, বিল্লাল ও ইসমাইল। এছাড়া অজ্ঞাত আসামি হিসাবে আরও ২/৩ জন রয়েছে। তবে তিনি অসহযোগিতার অভিযোগ অস্কীকার করেন।

লোক লজ্জা , সামাজিক অপমান , ক্ষোভ ও ঘৃনায় পিত্রালয়ে স্বেচ্ছাগৃহবন্দি হয়ে থাকা সুমাইয়া জানান তিনি জানতে পেরেছেন ‘রুহুল কুদ্দুস সাতদিনের মাথায় জামিনে বাড়ি এসে হুমকি দিতে শুরু করেছে’।এসআই মোয়াজ্জেম বলেন ‘ এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ১০ ধারায় ও পেনাল কোডে মামলা হয়েছে । কুদ্দুসকে গত ১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় । উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিক্ষার্থী হিসাবে সে জামিন পেয়েছে বলে শুনেছি। অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে’।গ্রামবাসী জানান ঘটনার সাথে জড়িতরা গা ঢাকা দিয়েছে।আবার বিল্লাল , ইসমাইল , মোস্তফাসহ কেউ কেউ এলাকায় ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ বলছে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা ।

কেড়াগাছি ইউপি চেয়ারম্যান ভুট্টোলাল গাইন বলেন, তিনি ঘটনা জানার পরই সেখানে গেছেন । সুমাইয়াকে তিনি মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। ওই পরমার্শ অনুযায়ী তিনি মামলা করেছেন বলে তার দাবী।

রুমার মা মমতাজ বেগম হাসপাতালে সুমাইয়াকে দেখতে এসেছিলেন । তিনি বলেছেন ‘ রুমা ও জাহিদ আত্মহননের চেষ্টা করছে’। বিদ্ধ মা মমতাজ বেগম নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দাবী করে বলেন, নির্যাতনকারী বেল্লাল ও কুদ্দুস স্থানীয় এজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। ওই জনপ্রতিনিধি তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। আদালত থেকে আসামীদের জামিন করিয়ে এনেছেন।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *