Connect with us

জাতীয়

নদী তুমি কার?

Published

on

Dead Riverখন্দকার ইয়াসীন পাভেল:
আজ ১৪ মার্চ। আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা দিবস। অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীকে সুপেয় পানির সঙ্কট থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও যথারীতি পালিত হচ্ছে দিবসটি। নদী প্রাকৃতিক সম্পদ। এর পানিপ্রবাহ হলো প্রকৃতির খেলা। সমস্ত মানবজাতি এর স্বত্ত্বাধিকারী। স্রষ্টা এগুলো কোন নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী বা কোন নির্দিষ্ট দেশের অধিবাসীদের জন্য দান করেন নি। কারণ, তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির জন্যই রয়েছে সমান ভালোবাসা। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রই আজ এই সত্য মেনে নিতে নারাজ। তাই উজানের দেশগুলো নদীর উৎপত্তিস্থলে বাঁধ দিয়ে বা অন্যভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে ভাটির দেশগুলোকে প্রাপ্য পানি থেকে বঞ্চিত করতে সদা প্রস্তুত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু অভিন্ন এবং আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানির বণ্টন নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দেশগুলো। শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় পানির অশীদারত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে অন্যান্য মহাদেশেও। আর এই দ্বন্দ্বে নদ-নদীর আমূল পরিবর্তন হচ্ছে, কোথাও কোথাও চিরতরে হারিয়েও যাচ্ছে। সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে চীন, ভারত ও পাকিস্তান; গঙ্গা, তিস্তা, বরাকসহ বেশ কটি নদীর পানি ভারত ও বাংলাদেশ; মেকং নদীর পানি নিয়ে চীন, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে চীন, ভারত ও বাংলাদেশের দ্বন্দ্ব বহু দিনের। এছাড়া বিশ্বের বিরোধপূর্ণ প্রধান নদ-নদী এবং বিবাদে জড়িয়ে পড়া দেশগুলো হচ্ছে জর্ডান নদীর পানি নিয়ে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন; অরোস্ত নদীর পানি নিয়ে লেবানন ও সিরিয়া; শাতিল আরব নদীর পানি নিয়ে ইরাক ও ইরান; আমুদরিয়া ও শিরদরিয়ার পানি নিয়ে মধ্য এশিয়ার কিছু দেশসহ অন্য আরো কয়েকটি নদীর পানি নিয়ে কিরগিজস্তান তাজাখস্তান, উজবেকিস্তান; আফ্রিকার নদ-নদীর পানি নিয়ে ওই অঞ্চলের মিসরসহ ১০টি দেশ; জাম্বোজি নদীর পানি নিয়ে জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা; ইউরোপের দানিয়ুর নদীর পানি নিয়ে হাঙ্গেরি, চেক ও স্লোভেনিয়া এবং উত্তর আমেরিকা রিও গ্র্যান্ডি নদীর পানি যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো। পানির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জটিল ও বিরোধপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আমাদের এ অঞ্চলটি। এ অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে মূলত আগামীর দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন কর্তৃক বিশাল নদীসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য পানি জোগান দেয়া, বন্যা ঠেকাতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা এবং অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ আন্তর্জাতিক ও অভিন্ন নদ-নদীগুলো জবরদখলে রাখাকে কেন্দ্র করে। এই সঙ্কটগুলোর সবই হচ্ছে মানবসৃষ্ট, নিজেরা সুবিধা নিয়ে অন্যদেরকে বঞ্চিত করার মানসিকতা থেকে।
নদীর সৃষ্টি উঁচু জায়গা থেকে, পাহাড় থেকে। সেখানে নদী সৃষ্টি হয় পরে একে বেকে নি¤œভূমিতে প্রবাহিত হয়। যে নদী যে দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সে দিকের পানির অংশীদার ঐ এলাকার মানুষ। সেটা থেকে তাকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। নদীর উৎপত্তিস্থলে বাঁধ দিয়ে ভাটির অঞ্চলের মানুষকে পানির কষ্ট দিয়ে শুকিয়ে মারার প্রবণতা অত্যন্ত অমানবিকতা। পৃথিবীর কোন আইন এটাকে বৈধতা দেয়নি। প্রচলিত আন্তর্জাতিক নদী সংক্রান্ত আইনে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভীন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য কোন রাষ্ট্রের ক্ষতি না করেই তা ব্যবহার করতে হবে (অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী সংক্রান্ত হেলসিংকি নীতিমালা, ৪ ও ৫ নং অনুচ্ছেদ)। সুতরাং একটি দেশকে মরুকরণের উদ্দেশ্যে বা একা ভোগ করার মানসিকতা থেকে যে একচোখা নীতির অনুসরণ বিশ্বজুড়ে চলছে সেটা চূড়ান্ত অন্যায়, যা আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করে। আবার যদি ধর্মীয় দিক দিয়েই বিবেচনা করা হয়, তবুও এমন আচরণ হতাশাব্যঞ্জক হিসেবেই প্রতীয়মান হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ (রা.) আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলাল্লাহ বলেছেন, তিন শ্রেণির লোকের সাথে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না এবং তাদের প্রতি তাকাবেনও না। (এক) যে ব্যক্তি কোন মাল সামানার ব্যাপারে মিথ্যা কসম খেয়ে বলে যে, এর দাম এর চেয়ে বেশি বলেছিল কিন্তা তা সত্ত্বেও সে তা বিক্রি করেনি। (দুই) যে ব্যক্তি আসরের সালাত (নামায) এর পর একজন মুসলমানের মাল-সম্পত্তি আত্মসাত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা কসম করে। (তিন) যে ব্যক্তি তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি মানুষকে দেয় না। আল্লাহ তা’আলা বলবেন (কিয়ামতের দিন) আজ আমি আমার অনুগ্রহ থেকে তোমাকে বঞ্চিত রাখব। যেরূপ তুমি তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থেকে বঞ্চিত রেখেছিলে অথচ তা তোমার হাতের তৈরি নয়। আলী (রা.) ও সালিহ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি হাদীসের সনদটি রসুল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। (সহীহ বুখারি অধ্যায়, পানি সিঞ্চন, হাদিস নাম্বার: ২২১৩)।
সনাতন শাস্ত্রেও মানুষের পানির চাহিদা পূরণার্থে নানান কর্মোপদেশ দান করা হয়েছে। শাস্ত্রে উল্লেখিত মহর্ষী মনুর একটি উক্তি হচ্ছে- “সকল দান অপেক্ষা জলদানই উৎকৃষ্ট; অতএব মুখ্য প্রযতœ সহকারে কূপ, জপী ও তড়াগাদি খনন করাইবে। সলিলপূর্ণ কূপ খননকর্ত্তার পাপের অর্দ্ধাংশ বিলুপ্ত করিয়া থাকে। যাহার জলাশয়ে ব্রাহ্মণ, সাধু, মনুষ্য ও গোসমুদয় জলপান করে, তাঁহার সমুদয় বংশ পাপ হইতে নির্মুক্ত হইয়া থাকে। গ্রীষ্মকালে যাঁহার জলাশয়ে সকলেই অপ্রতিষিদ্ধ হইয়া জলপান করিতে পারে, তিনি, কদাচ বিপদে নিপতিত হয়েন না (মহাভারত, অনুশাসন পর্ব পৃৃ: ১০০৯; পঞ্চষষ্ঠিতম অধ্যায়)। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় এই শিক্ষা যে ধর্মে রয়েছে সে ধর্মের অনুসারী দাবিদার অর্থাৎ ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সনাতন ধর্মের অনুসারীরা পানি থেকে বঞ্চিত করছে ভাটির দেশের বাঙালিদের। যেখানে মুসলমান ছাড়াও তাদের স্বজাতি লক্ষ লক্ষ হিন্দুও রয়েছে। সংকীর্ণ জাতীয়তা, আর ধান্দাবাজের রাজনীতি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে আইন, ধর্ম, মানবতা কোনটাই বিবেচ্য হচ্ছে না। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করে রাখছে তারা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ও ধর্মীয় আইন উভয় আইনেরই বরখেলাপ করছেন। যতদিন পর্যন্ত না মানুষ এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ তথা অমানবিকতাকে ত্যাগ না করবে, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করবে, ততদিন এরকম হাজার হাজার দিবস পালন করেও কোন সুফল পাওয়া যাবে না।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *