জাতীয়
নোয়াখালীতে ধর্মব্যবসায়ীদের তান্ডব: হেযবুত তওহীদের ৩ সদস্যকে হত্যা; নিখোঁজ ৭
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল ১০টার দিকে বহিরাগত কিছু মাদ্রাসার ছাত্র নতুন বাজার এলাকায় হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে জঙ্গি মিছিল করে। মিছিলের শ্লোগানে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের বাড়িতে হামলা চালানোর উস্কানি দেওয়া হয়। তারপর তারা মাইকিং করে হামলার জন্য লোক জড়ো করে। এসময় স্থানীয় পুলিশ নতুন বাজারেই অবস্থান করছিল। আনুমানিক বেলা ১২টার দিকে হামলার সূত্রপাত হয়। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পদক্ষেপে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। এই প্রতিবেদন তৈরির সময় পর্যন্ত ৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে যাদের মধ্যে দুইজনকে হত্যার পর লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা হচ্ছেন ইব্রাহিম রুবেল, সোলাইমান খোকন ও আব্দুস সোবহান। তাদের বিস্তারিত পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে ঘটনাস্থলে অবস্থান করছিলেন এমন আরো অন্তত ৭ জন নিখোঁজ রয়েছেন যাদের হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে বলে ধারণা করছেন হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
হেযবুত তওহীদের নোয়াখালী শাখার আমীর নিজাম উদ্দিন জানান, হেযবুত তওহীদকে নিয়ে আগে থেকেই সোনাইমুড়ির পোরকরা গ্রামে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আসছে। সংগঠনটির সদস্যরা খ্রিস্টান হয়ে গেছে এমন বহু অপপ্রচার চালিয়ে তারা জনগণকে উস্কানি দিয়ে আসছে। হেযবুত তওহীদের এমামের বাড়িতে নির্মাণাধীন একটি মসজিদকে তারা ‘গীর্জা’ আখ্যা দিয়ে তা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার প্ররোচনাও দিয়ে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার পোরকরা গ্রামের মসজিদগুলোতে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা “হেযবুত তওহীদ একটি কুফরি সংগঠন” শিরোনামে একটি উড়ো হ্যান্ডবিল বিলি করে। এমনকি মসজিদের এমামরা খুতবার আগে হেযবুত তওহীদকে কাফের আখ্যা দিয়ে তাদের উপর হামলা ও তাদের বাড়ি-ঘর, নির্মাণাধীন মসজিদ ভাঙচুর করার উস্কানি দেন। এভাবে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে তারা একটি ভয়াবহ, নৃশংস হামলায় জনগণের সমর্থন আদায় করে এবং তাতে অংশগ্রহণে তাদের প্ররোচিত করে।
হেযবুত তওহীদের নোয়াখালী শাখার আমীর অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় প্রশাসনকে সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারে অবগত করা হলেও তারা এ ব্যাপারে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের কোনো নিরাপত্তা দেননি। গত ১২ মার্চ সোনাইমুড়ি থানায় হামলার আশঙ্কা জানিয়ে জিডি করতে গেলে থানা আবেদন জমা নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এমনকি গতকাল হামলার শিকার হওয়ার আগে সকালে নিরাপত্তা চেয়ে নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জানায় সংগঠনটির সদস্যরা। অথচ প্রশাসনের নাকের ডগায় একশ্রেণির উগ্রপন্থী, সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে গতকাল হামলাটি ঘটে। হামলার সময় নতুন বাজারে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র্যাব উপস্থিত থাকলেও তারা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সন্ত্রাসীদের তা-বে নিকটস্থ হেযবুত তওহীদের এমামের বাড়িতে কয়েকজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর তারা অ্যাকশনে যান। কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালিয়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন এবং আহতদের উদ্ধার করেন।
হেযবুত তওহীদের স্থানীয় আমীর বলেন, “হেযবুত তওহীদ যাবতীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলে। ধর্মের নামে অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট। গত ২০ বছর ধরে আমরা এসবের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছি। কোরআন, হাদীস দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছি ধর্মব্যবসা যেমন ইসলামে হারাম, ধর্মের নামে যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-েরও বৈধতা ইসলামে নেই। এজন্য শুরু থেকে হেযবুত তওহীদ সেই শ্রেণির আলেমদের বিদ্বেষের শিকার হয়ে আসছে যারা ধর্মকে তাদের রুটি-রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে আসছে।” তিনি বলেন, “২০০৯ সালেও একইভাবে এই গ্রাম থেকেই ফতোয়াবাজ ধর্মব্যবসায়ীরা হেযবুত তওহীদের সদস্যদের উচ্ছেদ করে দেয়, তাদের বাড়ি ঘর ভস্মীভূত করে দেয়। আজ এত বছর পর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।” তিনি বলেন, “হেযবুত তওহীদ সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে না। সন্ত্রাসীদের হামলায় আমরা পাল্টা-হামলা চালাইনি। আমরা প্রশাসনের উপর আস্থাশীল ছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের উদ্ধারে যথাসময়ে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা যখন তৎপর হয়েছেন ততক্ষণে আমরা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি। আজ যারা এ ঘটনায় নিহত হলেন তারা ছিলেন নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী কিছু মানুষ। তাদের হারিয়ে কেবল হেযবুত তওহীদই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এই জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতি এমন কিছু মানুষকে হারিয়েছে যারা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং এই দেশকে নানামুখী ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। আমরা আজকের এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যারা এখানে শহীদ হয়েছেন তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।” তিনি এ ঘটনার আইনি প্রতিকার চেয়ে বলেন, ‘যারা মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে, তাদের ঈমানী চেতনাকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে আজকের এই নৃশংস ঘটনার জন্ম দিল আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছি। আজ যদি প্রশাসন ও সরকার সোনাইমুড়ির এই ঘটনার সুষ্ঠু প্রতিকার না করে তবে মানুষের ধর্মবিশ্বাস এভাবে বারবার ভুল খাতে প্রবাহিত হবে। বাংলাদেশকে জঙ্গি, সন্ত্রাসী রাষ্ট্র প্রমাণ করার যে চেষ্টা আন্তর্জাতিক মহলে চলছে তা সুগম হবে। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এ ঘটনার ব্যাপারে জানতে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সোনাইমুড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও নোয়াখালী পুলিশ সুপারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।