দেশজুড়ে
বাঘার সফল জননী রত্নগর্ভা হাসনা হেনা
বাল্যবিয়ের কারনে হাসনা হেনাকে ছোটবেলা থেকেই জীবন যুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয়। শিক্ষক হুদা ছাত্রদের মাঝে যখন মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন। তখন হাসনা হেনাকেও সেই দিকেই মনোনিবেশ করতে হয়। সে সময় জাইগির প্রথা থাকায় ভাল ছাত্রদের নিজের বাড়িতে রাখতেন শিক্ষক হুদা। আর সেই ছাত্রের খাওয়া-দাওয়া, নিয়মিত পড়ালেখার দিকে নজর দিতে হতো হাসনা হেনাকে। এরই মাঝে কোল জুড়ে আসে হাসনা হেনার বড় সন্তান ওয়ালী আহাদ। তাকেও তিনি লেখা পড়া শেখান। এভাবেই একে একে বারোটি সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এর মধ্যে ছয়টি ছেলে আর ছয়টি মেয়ে।
বারো সন্তানের জন্মই শুধু দেননি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজের সম্মানজনক স্থানে জায়গায়ও করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর সব সন্তানই এখন চাকরীজীবী। তাদের অধিকাংশই সরকারী কর্মকর্তা। বড় ছেলে ওয়ালী আহাদ বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেসরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করছেন। দ্বিতীয় ফখরুল ইসলাম জনতা ব্যাংকের এজিএম, তৃতীয় জহুরুল ইসলাম সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পরের সন্তান মারিউল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে সম্মান শ্রেনীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারাত্বক অসুস্থ হয়ে মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে বর্তমানে বাড়িতে অবস্থান, রাবিউল ইসলাম এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষক, মাহফুজুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টারস শেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, বড় মেয়ে তহমিনা খাতুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে বর্তমানে গৃহিনী, দ্বিতীয় মেয়ে মাসুমা খাতুন জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার, পরের মেয়ে নাছিমা খাতুন প্রয়াত কলেজ শিক্ষক, ফরিদা পারভীন দিনাজপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহযোগী অধ্যাপক, মোর্শেদা নাজনীন ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহযোগী অধ্যাপক এবং সর্বশেষ মেয়ে নীলা হাফিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা পদে কর্মরত। একারনেই ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারী স্থানীয় এলাকাবাসী আনুষ্ঠানিকভাবে রতœগর্ভার খেতাবে ভুষিত করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালিন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার শফিউল আলম।
স্বল্প আয়ের শিক্ষক হুদা এতোগুলো ছেলে-মেয়ের পড়া লেখার খরচ চালাতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন হাসনা হেনা হুদা তাকে সাহস যুগিয়েছেন। দিয়েছেন প্রেরণা। স্বামীকে বাড়তি আয়ের জন্য টিউশনি করতে পরামর্শের পাশাপাশি নিজে বাড়িতে হাঁস মুরগী ও গরু পুষতেন। বাড়ির আঙ্গিনায় শাক-সবজি চাষ আর বাতাবি লেবুর গাছ লাগিয়ে সময়ে-অসময়ে সেগুলো বিক্রি করে তিনি সন্তানদের লেখা পড়ার খরচে সহযোগীতা করতেন। কখনও খেয়ে কখনও বা না খেয়েই সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের টাকা পাঠাতেন।
এদিকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতেন উজ্জীবীত শিক্ষক হুদা। সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের হাতে রেঁধে খাওয়া-দাওয়া করাতেন মা হাসনা হেনা। আর একারনেই পাক-হানাদাররা শিক্ষক হুদার বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ধরে নিয়ে যায় হুদাকে। সেসময় বুদ্ধির জোরে একদিন পর বেঁচে ফিরেন তিনি। ফিরে এসে বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি একমাত্র বাড়িটি আর তার ভেতরের আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হওয়ায় ভেঙ্গে পড়েন হুদা। সেসময় স্ত্রী হাসনা হেনা স্বামী সাহস যুগিয়েছেন। পার্শবর্তী নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা গ্রামে অন্যের বাড়িতে ছেলে-মেয়ে নিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানেও বেশিদিন ঠাঁই হয়নি। পরে বাউসা গ্রামে এক পরিচিত ব্যাক্তির বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন হাসনা হেনা ও তার পরিবার।
জীবন যুদ্ধে বারবারই হোচট খেয়েছেন হাসনা হেনা। সবশেষে ১৯৯৩ সালে শিক্ষক হুদার মৃত্যুর পর তিনি একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন। বড় ছেলের চাকরী হলেও বাঁকিগুলোর অনেকের চাকরি, কারও লেখা-পড়া শেষ করানো এ চিন্তা যেন হাসনা হেনাকে তাড়া করে ফেরে। আত্মীয়দের বাড়িতে ধার-কর্য করে আর ছেলেমেয়েদের বাড়তি টিউশনি। সন্তানদের সবাই তী² বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ায় চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন এবং সমাজের সম্মানজনক জায়গায় স্থান করে নেন।