Connect with us

ঝিনাইদহ

মরমী কবি পাগলা কানাইয়ের ২০৫তম জন্মজয়ন্তী আজ

Published

on

Jhenaidah pagla kanai  Photo-09-03-2015মনিরুজ্জামান সুমন,  ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : জিন্দা দেহে মুরদা বসন, থাকতে কেন পরনা, মন তুমি মরার ভাব জান না, মরার আগে না মরিলে পরে কিছুই হবে না/ আমি মরে দেখেছি, মরার বসন পরেছি, কয়েকদিন বেঁচে আছি, তোরা দেখবি যদি আয় পাগলা কানাই বলতেছি।’ এমন শত শত গানের স্রষ্টা মরমী কবি পাগলা কানায়ের ২০৫তম জন্ম জয়ন্তী আজ (সোমবার) । লোক-সাধনা ও মরমী সঙ্গীতের এ কবি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বেড়বাড়ি গ্রামে বাংলা ১২১৬ সালের ২৫ ফাল্গুন জন্মগ্রহণ করেন।

এই মরমী কবির ২০৫ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে তার জন্মভিটা ঝিনাইদহের বেড়বাড়ি গ্রামে ৩ দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে পাগলা কানাই স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে রয়েছে কবির মাজারে পুষ্পমাল্য অপর্ণ, মিলাদ মাহফিল, লাঠিখেলা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা ও লোক সংগীত অনুষ্ঠান। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন ঝিনাইদহ-২ আসনের সাংসদ তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমি। ২য় দিনের অনুষ্ঠানে রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লোক সংগীত ও নাটক। আগামী ১১ মার্চ শেষ দিনে থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, লোক সংগীত ও ভাব সংগীতের প্রতিযোগিতা। শেষ দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন ঝিনাইদহ-১ আসনের সাংসদ আব্দুল হাই। বিশেষ অতিথি থাকবেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার, ঝিনাইদহ- ৩ আসনের সাংসদ নবী নেওয়াজ। 

জীবনী : পাগলা কানাই ১৮০৯ সালে তৎকালীন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার, বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার, লেবুতলা গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর জীবন কেটেছে বেড়বাড়ি বোনের বাড়িতে। বাবার নাম কুড়ন শেখ, মায়ের নাম মোমেনা বিবি। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে কানাই সবার বড়। ভাইয়ের নাম উজ্জ্বল শেখ, বোন স্বরনারী। পাঠশালায় পড়াকালে তাঁর বাবা কুড়ন শেখ মারা যান। পিতৃহারা হয়ে কানাই ভবঘুরে হয়ে যান। জীবনের তাগিদে মোমেনা বিবি কোনো উপায়ান্তর না দেখে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চেউনে ভাটপাড়া গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে কিছুদিনের মধ্যে তিনিও মারা যান। মা হারিয়ে কানাই ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বলরামপুরে ভরস মণ্ডলের বাড়িতে রাখালির কাজ নেন। বোন স্বরনারী দুই ভাইকে সেখান থেকে নিজের আশ্রয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়বাড়িতে নিয়ে আসেন। বোনের শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো হওয়াতে কানাইয়ের গান চর্চার রাস্তা আরও সহজ হয়। কানাই বোনের বাড়ির গরুর পাল চরাতেন আর গান বাঁধতেন, তাতে সুর দিতেন। ছোটবেলা থেকেই পাগলাকানাই দুরন্ত প্রকৃতির, পাগলাটে স্বভাবের এবং আধ্যাত্ম প্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এ খেয়ালীপনার জন্যে শৈশবে স্মেহবশতঃ লোকে তাঁর নামের সাথে “পাগলা’ অভিধাটি(উপনাম) যুক্ত করে। তাঁর কর্মকীর্তির সাথে এ পাগলা উপাধিটি অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত হয়েছে।

কর্ম জীবন

সুর দেওয়া হয়ে গেলে আপন মনে গলা ছেড়ে তা গাইতেন। অস্থির পাগল এই স্বভাবকবির কোনো জায়গায় বেশি দিন ভালো লাগত না। গরু চরানো রেখে কাজ নেন মাগুরা জেলার আঠারখাদার জমিদার চক্রবর্তী পরিবারের বেড়বাড়ির নীলকুঠিতে। দুই টাকা বেতনের সেই খালাসির চাকরি বেশি দিন করা হয়ে ওঠেনি। গানের প্রতি টানে চাকরি ছেড়ে-ছুড়ে পথে বের হন আবারও।

গরু চরাতে গিয়ে ধুয়ো জারীগান গাইতেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর সঙ্গীত মুগ্ধ হয়ে শুনত। এভাবে ধুয়োজারীতে তাঁর হাতে খড়ি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর কোন সঙ্গীত শিক্ষা না থাকলেও এখানকার তৎকালীন আউল-বাউল, সাধু-ফকির প্রভৃতি গুণীজনের পদচারণা সর্বোপরি জীবন ও জগত সম্পর্কে কবির আত্মার আত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্ম-অন্বেষণ তাঁকে প্রখর অধ্যাত্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তোলে। তাঁর গানে ইসলাম ও আল্লাহর প্রিয় নবীর, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ), প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ পায়। পাগলা কানাই নিরক্ষর হলেও তাঁর স্মৃতি ও মেধা ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে একের পর এক গান রচনা করতে পারতেন।

এ পর্যন্ত পাগলা কানাই রচিত গানের মধ্য মাত্র শ’তিনেক সংগৃহীত হয়েছে। মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ড, মাযহারুল ইসলাম, আবু তালিব, আমিন উদ্দিন শাহ, দুর্গাদাস লাহিড়ী, উপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য প্রমুখ মনীষীগণ পাগলা কানাইয়ের গানের সংগ্রহ ও গবেষণা করেছেন।

শিক্ষাজীবন

গ্রামের মক্তবে তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করলেও চঞ্চল স্বভাবের জন্যে তাঁর লেখাপড়া বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর রচিত একটি গানের মধ্যেই তাঁর স্বভাবসুলভ অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

“    লেখাপড়া শিখব বলে পড়তে গেলাম মক্তবে

পাগলা ছ্যাড়ার হবে না কিছু

ঠাট্টা করে কয় সবে।

ছ্যাড়া বলে কিরে তাড়ুম তুড়ুম

মারে সবাই গাড়ুম গুড়ুম

বাপ এক গরীব চাষা

ছাওয়াল তার সর্বনাশা।

সে আবার পড়তে আসে কেতাব কোরান ফেকা

পাগলা কানাই কয় ভাইরে পড়া হল না শেখা। ”

বাউলজীবন

তৎকালীন সময়ে কবিত্ব প্রতিভায় লালনের পরেই তাঁর স্থান নিরূপণ করা যায়। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও আধ্যাত্মিক চেতনায় জ্ঞানান্বিত হয়ে অপরূপ সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে দোতারা হাতে ঘুরে ফিরেছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠের একটি গান আজও উচ্চারিত হয় মানুষের মুখে মুখে।

“    সালাম সালাম সালাম রাখি দেশের পায়।

পয়লা সালাম করি আমি খোদার দরগায়

তারপর সালাম করি নবীজীরে

যিনি শোয়া আছেন মদিনায়

ওরে সালাম করি ওস্তাদের আর সালাম পিতা-মাতায়

অধম আমি পাগলা কানাই এল্যাম চাঁদ সভায়

আল্লাহ তরাও হে আমায়।   ”

পাগলা কানাই ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং ইসলাম ধর্মের বিধি বিধানগুলি সঠিকভাবে মেনে চলতেন। তাঁর বিভিন্ন গানের মধ্য দিয়ে তাঁর এই অভিব্যক্তি পরিস্ফুটিত হয়েছে।

“    ও, মোমিন মুসলমান, কর এই আকবারের কাম

বেলা গেল হেলা করি বসে রয়েছো

গা তোল্ গা তেল্

মাগরেবের ওয়াক্ত হয়েছে, এই সময় নামাজ পড়।   ”

যশোর জেলার কেশবপুরের রসুলপুর গ্রামের নয়ন ফকিরকে তাঁর ওস্তাদ বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এই স্বভাব কবির সর্বাপেক্ষা পদচারণা ছিল ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। পরবর্তীতে তিনি ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। পাবনার বিখ্যাত ভাবুক কবি ফকির আলীমুদ্দীনের সাথে তাঁর আন্তরিক সখ্যতা গড়ে ওঠে।

এ সকল অঞ্চলের বিভিন্ন আসরে গান বেঁধে বিভিন্ন ভঙ্গীতে পরিবেশন করে হাজার হাজার শ্রোতাকুলকে ঘন্টার পর ঘন্টা সম্মোহিত করে রাখতেন পাগলা কানাই। তাঁর কন্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত জোরালো মধুর। ৩০/৩৫ হাজার স্রোতা তার গান মাইক ছাড়াই শুনতে পেত। তাঁর জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক গানের কয়েকটি লাইন।

“    গেলো দিন

শুন মুসলমান মোমিন

পড় রব্বিল আলামিন

দিন গেলে কি পাবি ওরে দিন

দীনের মধ্যে প্রধান হলো মোহাম্মদের দীন”।  ”

পরলোক গমন

বাংলার পথে, দোতারা হাতে, গান গেয়ে ফেরা মরমী গীতিকবি পাগলা কানাই ১৮৮৯ (বাংলা ১২৯৬ সালের ২৮ আষাঢ়) সালে মৃত্যুবরণ করেন।

উল্লেখ্য, এই মরমী কবি পাগলা কানাইয়ের রচিত ৩ সহস্রাধিক গান থাকলেও আজও তা সংগৃহিত হয়নি। ঝিনাইদহ সহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফেরে তার গান। কবির গান সংরক্ষণের দাবি কবি ভক্ত ও এলাকাবাসির।

 

 

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *