Connect with us

জাতীয়

রংপুরে পত্রিকা অফিসে সন্ত্রাসী হামলা- বিচারের বাণী আজও নিভৃতে কাঁদে

Published

on

image
রংপুর অফিস:
রংপুরে হেযবুত তওহীদ কর্তৃক পরিচালিত একটি দৈনিক পত্রিকার কার্যালয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত হামলার পর প্রায় এক বছর হতে চললেও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ভয়াবহ ওই হামলার পূর্বে করা জিডিসহ মোট দুইটি জিডি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে করা অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের দুইটি মামলার কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মামলার বাদীপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়। জানা গেছে প্রশাসনের চোখের সামনেই আসামিরা প্রকাশ্য ঘোরাঘুরি করছে এবং ওই মামলাগুলোর বাদীপক্ষকে হুমকি-ধামকি প্রদান করছে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মামলার প্রধান আসামি রংপুরের শালবন নামক স্থানের একটি মসজিদের ইমাম মোসলেম উদ্দীন জিহাদী। তিনি মামলার সাথে সম্পৃক্ততা এড়ানোর জন্য বাদীপক্ষের উপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। এমনকি মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসুল্লিদের সামনে খোতবা দানকালে তিনি বাদীপক্ষের অনেকের নাম উল্লেখ করে তাদের সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল তথ্য প্রদান করে মানুষকে উত্তেজিত করে তুলছেন। স্থানীয় চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কিছু যুবকও তার কথায় প্রভাবিত হয়ে বাদীপক্ষকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ভীতি প্রদর্শন করছে। ফলে যতই দিন যাচ্ছে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে বছরখানেক আগের ভয়াবহ ওই সন্ত্রাসী হামলার ভুক্তভোগী বাদীপক্ষের জীবন। শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা বাসা বাঁধছে তাদের মনে।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল তৎকালীন ‘দৈনিক দেশেরপত্র’ এর রংপুর কার্যালয়কে ঘিরে। গত ১ ফেব্র“য়ারি রংপুর শহরস্থ পূর্ব শালবন এলাকায় দেশেরপত্রের বিভাগীয় ব্যুরো অফিস উদ্বোধন করা হয়। উক্ত অফিস উদ্বোধনের পর থেকে অফিসে উপস্থিত পত্রিকার স্টাফরা সেখানেই নামাজ পড়তেন। এর কারণ কী জানতে চাইলে তারা বলতেন- যেহেতু আল্লাহ ধর্মের কোনো কাজ করে বিনিময় নেওয়া বা পার্থিব স্বার্থ আদায় করাকে নিষেধ করেছেন এবং যারা এমনটা করে তাদের অনুসরণ করতেও নিষেধ করেছেন কাজেই আমরা কোনো ধর্মব্যবসায়ীদের পেছনে নামাজ পড়ি না। এ কথার পেছনে তারা কোর’আন-হাদীস থেকে যথাযথ যুক্তি-প্রমাণও তুলে ধরতেন বলে জানা যায়। কিন্তু তারা মসজিদে নামাজ না পড়ায় স্থানীয় মসজিদের ইমাম মোসলেম উদ্দীন জিহাদীসহ আরও অনেকে মুসুল্লিদের কাছে প্রচার করতে থাকে যে, দেশেরপত্রের কর্মীরা নামাজই পড়ে না। তারা যেন জনগণের মধ্যে এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে সে জন্য পত্রিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে মাইক দিয়ে আজান দিয়ে নামাজ পড়া শুরু হয়। কিন্তু তখনও মিথ্যাচার করা হয় যে, এরা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের দালাল, এরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না, দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, জানাজা পড়ে না, এদেরকে জীবিত রাখা উচিত নয়, এদের মারতে পারলে হজ্বের সমান সওয়াব অর্জন করা যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে ওই শ্রেণিটি স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে পত্রিকার স্টাফদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতে থাকে। এদিকে খবর পেয়ে যে কোনো নাশকতামূলক ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে পত্রিকার পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়।
কিন্তু তা সত্ত্বেও গত বছরের ২০ ফেব্র“য়ারি রংপুর নগরের পূর্ব শালবনস্থ ওই বিভাগীয় কার্যালয়ে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা মোসলেম উদ্দীন জিহাদীর নেতৃত্বে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। তারা রাত সাড়ে আটটার সময় পত্রিকা অফিসে অবস্থানরত নারী ও পুরুষ সংবাদকর্মী ও স্টাফদের উপরে ধারালো অস্ত্র, লাঠি সোটা ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হামলায় দেশেরপত্র কার্যালয়ে অবস্থান করা বেশ কয়েকজন আহত হন। হামলাকারীরা পত্রিকা অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর করার পর স্থানীয় সংবাদ প্রতিনিধি মামুনুর রশিদ মুকুলের পৈত্রিক ছয়টি দোকান ও বাড়িতে হামলা চালায়, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। স্থানীয় আরও দুই সংবাদকর্মীর বাড়িতে ও দোকানে হামলা ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। পরবর্তীতে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর কোনো অজানা কারণে নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে পুলিশ পত্রিকা অফিসেরই ২০ জন কর্মীকে থানায় নিয়ে যায় এবং পাবলিক সেন্টিমেন্টের দোহাই দিয়ে তাদের মধ্যে ১৭ জনকে আদালতে চালান দেয়। তিনদিন কারাভোগের পর ২৪ ফেব্র“য়ারি তারা জামিনে কারামুক্ত হন।
এ ব্যাপারে বাদী আমিরুল ইসলাম জানান- আমরা ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে পত্রিকার পক্ষ থেকে থানায় জিডি করেছিলাম। প্রশাসনও তাদেরকে থানায় ডেকে কোনোরকম হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হতে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু তারা আইনের তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ বে-আইনীভাবে আমাদের নিরাপরাধ কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, অফিস ও বাড়িঘরে ভাঙচুর চালায়, অগ্নিসংযোগ করে। অথচ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে আমাদেরই ১৭ জনকে গ্রেফতার করল, এটা কেমন নৈতিকতা? কোন আইন এই অন্যায়কে স্বীকৃতি দেয়?
হামলার পর অফিস ভাঙচুর ও লুটপাটের কারণে ১৪ জনকে আসামি করে এবং হেযবুত তওহীদের স্থানীয় কর্মীর বাড়িতে ও দোকানে অগ্নিসংযোগ ও হামলা লুটপাটের কারণে ১২ জনকে আসামি করে রংপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভিন্ন দুইটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বিবরণী শুনে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট থানাকে দ্রুত মামলা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু মামলার বাদীপক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে যে, উক্ত মামলা গ্রহণ করার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে তদন্ত রিপোর্টটি প্রদান করা হয়েছে তাতে ইচ্ছাকৃতভাবে আসামিদের পক্ষাবলম্বন করা হয়েছে, এমনকি তদন্ত করার সময় কোনো বাদী বা স্থানীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় নি। বাদী আমিরুল ইসলামের মতে, প্রকৃত সত্য তুলে না ধরে সম্পূর্ণ মনগড়া একটি ভিত্তিহীন প্রতিবেদন করা হয়েছে যা তার ন্যায়বিচার পাবার পথ রুদ্ধ করেছে। তাই গত বছরের ২১ ডিসেম্বর মামলাটির বাদীপক্ষ পুনরায় তদন্তের আবেদন জানিয়ে নারাজি দাখিল করে। আর এতেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আসামিরা। শুরু হয় বাদীপক্ষকে মামলা তুলে নেবার হুমকি-ধামকি। এমনকি কোনো রকম আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে আদালত চত্বরেই আসামিপক্ষের লোকজন বাদী পক্ষের লোকজনকে বিভিন্ন হুমকি প্রদান করে বলে অভিযোগ করা হয়।
বাদী আমিরুল ইসলাম বলেন, আমাদেরকে বর্তমানে সর্বাবস্থায় শঙ্কার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। আবারও আসামিদের দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দাবি হলো যারা প্রকৃতই সন্ত্রাসী, অপরাধী তাদের বিচার নিশ্চিত হোক, আইনের আওতায় আনা হোক। যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়। কিন্তু এইটুকু চাওয়াই যেন আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের জীবন এখন হুমকির মুখে। আইন-আদালতের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। গত একটি বছর যাবৎ আমরা ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায় আছি, কিন্তু এখন প্রশ্ন জাগছে- সত্যই কি আমরা ন্যায়বিচার পাব?
খবর নিয়ে জানা গেছে, আদালত নারাজি আবেদন গ্রহণ করার পর শুনানির দিন ধার্য করলে স্থানীয় ওই সন্ত্রাসীদের প্রকোপ আরও বেড়ে যায়। সবশেষ গত ২১ জানুয়ারি আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই মামলার চিহ্নিত আসামিরা আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে উপস্থিত আইনজীবীদের সামনেই বাদীপক্ষের লোকজনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এতসব হুমকি-ধামকির মুখে নিরাপত্তা চেয়ে রংপুর কোতয়ালী থানায় আরও একটি জিডি করেছে বাদীপক্ষ। এদিকে আবারও পুরোদমে শুরু হয়েছে মামলার প্রধান আসামি স্থানীয় মসজিদের ইমাম মুসলিম উদ্দিন জিহাদীর উসকানীমূলক ফতোয়াবাজী। তার অতি সাম্প্রতিক বক্তব্যের একটি অডিও আমাদের হাতে এসেছে যেখানে তিনি বলছেন- ‘ইচ্ছা করলে আমাদের এলাকায় যত মানুষ মানববন্ধন করেছি সবাই মিলে যদি তাদের (বাদীপক্ষকে) হত্যা করি তাহলে আমাদের এক পিস করেও আটবে না তারা।’ বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে এবং স্থানীয় প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে আবারও প্রাণের ঝুঁকিতে পড়েছে বাদীপক্ষ। পরিস্থিতি ঘোলাটে করার উদ্দেশ্যে আসামিপক্ষের সন্ত্রাসীরা যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে মামলা দু’টির বাদীপক্ষ।
যে কোনো সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করার পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইন সবার জন্য সমান। অপরাধ করলে যদি অপরাধীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা না হয়, যে কোনো বিবেচনায় পার পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তাহলে অপরাধীর অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সে ক্রমেই নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। ঔদ্ধত্য তাকে অন্ধ করে দেয়। আর নিরীহ-নিরাপরাধ মানুষকে দিতে হয় চরম মূল্য। সমাজ হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল, নৈরাজ্যকর। তাই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ভূমিকা পালন করবে এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *