Connect with us

প্রবন্ধ

ধর্মীয় সন্ত্রাস: ওষুধের বোতলে বিষ

Avatar photo

Published

on

আলম বালী


 কথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সন্ত্রাস সৃষ্টি করার ঘটনাকে যুক্তি হিসেবে ধরে যারা কথিত ধর্মপন্থীদের সন্ত্রাস সৃষ্টি করাকে জাস্টিফাই করেন সঙ্গত কারণেই আমি তাদের বিরোধিতা করি। এ কথা ঠিক যে, সন্ত্রাসের মধ্যে ভালো সন্ত্রাস ও মন্দ সন্ত্রাস বলে কিছু নেই, নিঃসন্দেহে সকল প্রকার সন্ত্রাস পরিত্যাজ্য, কিন্তু তবু বিশেষ কিছু কারণে ধর্মকে ব্যবহার করে ঘটানো সন্ত্রাস অধিক ঘৃণিত ও ধিক্কৃত হওয়ার ন্যায়সঙ্গত যুক্তি আছে।
আমাদের সমাজে অহরহ অন্যায়, অবিচার, হত্যা, গুম, শোষণ, বঞ্চনা, দমন-পীড়ন, প্রতারণা ইত্যাদি চলে। চলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ভয়াবহ সব অপরাধ। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতারণা, সন্ত্রাস, সহিংসতা ইত্যাদি মহামারি আকার ধারণ করেছে। আমরা যদি এসবের গভীরে তাকাই এবং নির্মোহ চিন্তা করি, দেখতে পাবো এই সকল অন্যায়-অপরাধের মূল কারণ হচ্ছে মানুষের ধর্মহীনতা। মানুষ ধর্ম হারিয়ে ফেলেছে। ধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে ধর্ম মনে করে আমাদের সমাজ যেটাকে প্রতিপালন করে চলেছে তা শান্তি আনবে কি, নিজেই অশান্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। যেমন ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে সমস্ত পৃথিবী থেকে ফাসাদ (অন্যায়, অবিচার) ও সাফাকুদ্দিমা (রক্তপাত) দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনকে যাবতীয় মিথ্যার উপদ্রব থেকে রক্ষা করা, সত্যকে বিজয়ী করা। অন্য ধর্মগুলোও একই কথা বলে। মানবতার জয়গান করে। পাশবিকতার নিন্দা করে। অধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দীক্ষা প্রদান করে। যারা ধর্মের পক্ষে লড়াই করবে তারা হবে মানবতার জন্য নিবেদিতপ্রাণ। মানুষকে নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করা হবে তাদের পার্থিব লক্ষ্য। সমাজ থেকে সন্ত্রাস-সহিংসতা, অনিরাপত্তা নির্মূল করাকে তারা বাধ্যতামূলক, ফরজ জ্ঞান করবে। তারা নিজেরা জীবন দেবে, কিন্তু সমাজকে অনিরাপদ হতে দেবে না এটাই নিয়ম। এই নিয়মের ধারাবাহিকতায় অতীতে যখনই সমাজ আক্রান্ত হয়েছে, মানবতা হুমকির মুখে পড়েছে, ধর্ম এগিয়ে এসেছে ত্রাণকর্তা হিসেবে। ধর্মের সুধা পান করে সুস্থ হয়েছে রোগাক্রান্ত সমাজ, সভ্যতা।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আজ যখন সমাজ নামক দেহ থেকে প্রাণপ্রদ্বীপ নির্বাপিত হবার পথে, সমাজের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অকেজো হয়ে পড়ছে, তখন ধর্মের সুধা বলে মানুষকে বিষ খাওয়াতে উদ্যত হয়েছে ধর্মব্যবসায়ী প্রতারকরা। যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলছে, নিজেদেরকে ইসলামের পক্ষশক্তি বলে পরিচয় দিচ্ছে তারাই সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ফল হচ্ছে এই যে, মানুষ ইসলামকে ভুল বুঝছে। যে ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করে মানুষ মুক্তির দিশা পেতে পারতো, সেই ইসলাম স¤পর্কে দিনদিন তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। এর জন্য দায়ী কারা? নিশ্চয়ই যারা ধর্মের পক্ষশক্তি সেজে আছে তারাই।
ধর্মনিরপেক্ষতার বিষক্রিয়ায় আমাদের এই রোগাক্রান্ত সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যত অকেজো হয়ে পড়ছে, যত তার জ্বালা-যন্ত্রণা বাড়ছে, ততই তার গলদেশে নতুন নতুন বিষ ঢালা হচ্ছে। বিষ ঢালছে ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও ধর্মবাদী উভয়পক্ষই। কিন্তু পার্থক্য হলো- ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বিষ ঢালছে বিষের বোতল থেকে, আর ধর্মবাদীরা বিষ ঢালছে ওষুধের বোতল থেকে। মানুষ ওষুধ মনে করে বিষ খাচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছে, জীবন হারাচ্ছে। ফলে কেউ সত্যিকার ওষুধ নিয়ে এলেও মানুষ তা খেতে অস্বীকার করছে। এর পরিণতি দাঁড়াচ্ছে আরও ভয়াবহ।
অর্থাৎ যারা ধর্মের নামে সন্ত্রাস করে, ধর্ম গেল ধর্ম গেল জিগির তুলে মানুষকে উস্কানি দিয়ে রক্তপাত ঘটায়, জনজীবনে বিপর্যয় নামিয়ে আনে, ফলে ধর্ম সম্পর্কে মানুষের মনে দ্বিধা-সঙ্কট তৈরি হয়, তারাই হচ্ছে অশান্তি নামক বিষবৃক্ষের শিকড়। আর অন্যরা সে বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা, লতা-পাতা। ওগুলো একটা কেটে ফেললে আরেকটা গজাবে যতক্ষণ না গাছের শেকড় কাটা যাচ্ছে। শাখা-প্রশাখা নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে, তবে চিন্তার কেন্দ্রে রাখতে হবে মূলকে, শেকড়কে।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

প্রবন্ধ

কবিতা: বাংলা সাহিত্যের দ্রৌপদী

Avatar photo

Published

on

সবুজ ভট্টাচার্য্য
শিরোনাম দেখে যদি কারো চোখ শিরে উঠে বসে, তাহলে তার জন্য লেখককে দোষারোপ করা যাবেনা। সার্বিক ধারনায় দ্রৌপদী যাঁর নিকট পরিচিত, তার নিকট শিরোনামের শিরচ্ছেদ করার কোনো প্রয়োজন আপাত দৃষ্টিতে নেই। তবে সূর্যদয়ের সময়ে যে কবিজাতী রাতের ঘুমের ব্যবস্থা করেন তাদের ভাবোদয়েও সূর্যাস্তের সময় হয়ে যায়। শিরোনামের উদ্দেশ্য উপসংহারে প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করছি।

পল্লিকবি জসিমউদ্দীন একান্ত নিজস্ব কোনো এক দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছিলেন, “সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি।” আলোচনা সমালোচনার কোনো কমতি হয়নি এর পর। যুগের পর যুগ ধরে চলতে লাগলো এ নিঃসীম আলোচনা। এই আলোচিত আলোচনার আলোচ্য বিষয়ের উপর জোড় দিতে পরিশেষে কিনা কবি শামসুর রাহমানও ঐ সমালোচকদের দলে যোগ দিলেন! তবে তিনি সমালোচনার নামে সমান ভাবে আলোচনা না করেই বলে বসলেন “যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।” তবে কবি যে, পক্ষে গিয়ে গেয়েছেন বিপক্ষের গান তা আমরা টের পাইনি। কবি যে ‘ইচ্ছে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তার শাব্দিক অর্থ, ভাবার্থ এবং কাব্যিক অর্থ সম্পুর্ণই ভিন্ন। ভাবার্থে কবি পছন্দ-অপছন্দের কথা বললেও, কাব্যিক অর্থে তিনি কবির বাকস্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক সিদ্ধান্তের উপর জোরারোপ করেছেন। কবিতাকে তিনি দিয়েছেন মতামত প্রকাশের সর্বোত্তম স্থান। তাই তিনি বলেছিলেন তাঁর কবিতার খাতায় তিনি যেমন ইচ্ছে তেমন লিখবেন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে নয়।

তাং: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রিয় প্রধান শিক্ষক, মাত্রাহীন উচ্চ বিদ্যালয়, কল্পনানগর, ছন্দখালি।
আশা করি ভালো আছেন কিন্তু আমি তো ভালো নেই। তবে আজ একটু ভালো বোধ করছি বলেই বিদ্যালয়ে এলাম। গত দুই দিন প্রলাপবাক্য বকেছি জ্বরের প্রতাপে। (মা বলেছেন, গণিত শিক্ষক স্নেহোত্তর চক্রবর্তী- কে প্রলাপকালিন আলাপে অশ্রাব্য গালিও দিয়েছি।)
অতএব, মহোদয় নিকট সবিনয় বিনীত নিবেদন এই যে, গণিত শিক্ষক স্নেহোত্তর চক্রবর্তীর স্নেহহীন শাসন এবং আমার শারীরিক অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে গত দু’দিন ছুটি দানে বাধিত করবেন।
নিবেদক
অষ্টম শ্রেণির খ শাখার নিয়মিত ছাত্র
“অকবি নাথ দুর্যোধন”

এখন হয়তো এটাই মূখ্য প্রশ্ন যে, এটা আদৌ কি ধরনের পত্র। আরে মশাই বুঝতেই তো পারছেন এটা আবেদনপত্র। শতভাবে বুঝালেও আপনি বলবেন এটি আবেদনপত্র হয়নি। কারন জানতে চাইলেও বড় একটা নিয়মনীতির তালিকা আমার হাতে ধরিয়ে দেয়া হতে পারে। কিন্তু কি এমন ভুল আছে এতে? তারিখের ক্ষেত্রে ইংরেজি মাসের নাম বাংলায় বানান করে লেখার চেয়ে এই তো ঢের ভালো ছিলো। নামের পরে প্রধান শিক্ষকের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ঠিকানাসহ তো দেয়াই হয়েছে। আর এ আবেদন তো উনি নিজেই পরবেন। তাই ওনাকে ওনার অবস্থান বিস্তারিত জানাতে আমি নারাজ; উনি নিজেই এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। শিক্ষক- ছাত্রের এতো মধুর একটা সম্পর্কের মাঝে প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ নামের ফরমালিটি কতটা সুন্দর দেখায় বা তার প্রভাবটাও বা কতটা ভালো, সে প্রশ্ন আমি রাখতেই পারি। কিন্তু পরিশেষে সবাই জাতীয় জোট বেঁধে এটাই প্রমাণ করবেন যে এটা আবেদনপত্রের নিয়মে পরেনি। তার মানে নিয়মের বাইরে দুটো শব্দ বা প্রদত্ত তথ্যের ভুল অবস্থানে যদি একে আবেদনপত্রের শ্রেণীচ্যুত করা হয় তাহলে পূর্বের আলোচনায় ফিরে যাওয়াটা আমার নিকট খুবই সহজ হয়।

হ্যাঁ, পল্লিকবি যথার্থই ভলেছেন। সবাই মোটেও কবি নন। আর কবি শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার সংবিধানে যে ধারা লিখে গেছেন তাতে শুধুমাত্র কি বিষয়ে লিখবো বা লিখবোনা তার ইচ্ছে বা স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে উপধারা প্রদত্ত হবার দরকার ছিলো অনেক বেশি।

তিনটি বাহু ত্রিকোনী অবস্থায় অবস্থান করা স্বত্বেও তাকে জ্যামিতিক ভাষায় ত্রিভুজ বলা যাবেনা যতক্ষণ না পর্যন্ত ঐ তিনটি বাহু পরস্পর যুক্ত হয়ে একটি আবদ্ধ ক্ষেত্র তৈরি না করে। ঠিক একইভাবে কবিতা বিষয়টাকে এতটা সহজ করে দেখলে হবেনা। কবিতার মাঝেও থাকতে হবে ছন্দ-মাত্রা এর শক্ত বাঁধন। যে বাঁধন তাকে দাঁড় করাবে উন্নত কবিতার কাতারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে স্বঘোষিত কবিদের স্বরচিত কবিতাগুলো যত দেখি ততই বর্তমান কবিদের পূর্বপুরুষদের কথা ভেবে চোখে জল আসে। এটাই চিন্তার শিরে উঠে বসে যে কি পরিমান কষ্টই না তারা করেছিলেন ছন্দ-মাত্রা ঠিক রাখতে। আমার এটা ভেবেও কষ্ট হয় যে, কি পরিমান কাগজ-কালি যে তাঁরা নষ্ট করেছিলেন শুধু এই ভেবে যে, তাঁর লেখা কবিতাটি কোনো এক চরনে/স্তবকে মাত্রাভ্রম/ছন্দভ্রম হয়েছে। তাঁরা ছন্দের বাঁধনে বাঁধতে গিয়ে মাত্রা ব্যবহারের যে নিম্নমাত্রা থেকে উচ্চমাত্রায় উঠানামা করতেন হয়তো তার গল্প শুধু ঐ দোয়াতকলম আর ময়লার স্তুপে জমায়িত কাগজের খন্ডিত টুকরো গুলোই জানে। জ্ঞানের জোড়ে হারাতে না পারলেও বুদ্ধির জোরে অত্যাধুনিক কবিরা তাঁদের শুধু হারিয়ে দিয়েছে বললেও ভীষণ ভুল হবে। বরং এটা বললেই ভালো হবে যে, অত্যাধুনিক কবিরা এই কথাই প্রমান করে ছেড়েছেন যে, “আবেগেটাই মূখ্য, ছন্দ-মাত্রা গৌন বিষয়।” অতি আবেগে মানুষ ভাষা হারিয়ে ফেলে; এসব কবিরা তো মাত্র মাত্রা আর ছন্দ হারিয়েছেন। যাই হোক, তাদের কবিতার খাতায় তারা কিভাবে কি লিখবেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই; সমস্যা শুধু তখনই হয় যখন দেখি এসব কবিতা কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই স্বজনপ্রিতির কোমল জালে আবদ্ধ সংবাদপত্রসমূহের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। তারাও কি তবে বলবেন, “যেমন ইচ্ছে ছাপানোর আমার সাহিত্যের পাতা।”

কবিতা লেখাটাকে যতটা সহজ করা হবে, ততটাই গ্রহণ যোগ্যতা পাবে, তবে হারাবে তার রাজকীয় অবস্থান ছন্দে শেখা কবিতাগুলো বৃদ্ধ বয়সেও মনে থাকে বাঁধনের জোড়েই।

কথায় আছে ‘‘স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’’ বাঙ্গালি অত্যাধুনিক কবিরা স্বাধীনতা অর্জন করেনি, দখল করেছে তবে তাও রক্ষা করতে পারবে কি না বেশ সন্দেহ। স্বাধীনতার প্রগারতা এতটা বেশি হয়ে গেছে যে, ‘কবিতা’ কে আমরা রাজ দরবারে রাখতে নারাজ আর তাই আজ আমরা ‘কবিতা’কে বর্তমান সাহিত্য বাজারের সস্তা পণ্যে পরিণত করেছি; যে চায় সেই কিনতে পারে। কবিতা লেখাটা বাঙ্গালি কবির মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। আমি কারো অধিকার হরণ করার কথা কলছিনা। তবে কোনো গদ্যকে খন্ডিত করে মাঝ পথে স্পেসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে অহেতুক স্তবকের আবর্তন ঘটিয়ে তাকে কবিতা দাবী করাটা মোটেও মানতে পারিনা। তবে স্ব স্ব সাহিত্য সভায় স্বরচিত সাহিত্য গৃহিত না হলে বর্তমান কবিরা স্বেচ্ছায় সভা ত্যাগ করেন আর এই ভয়ে অন্য কবিরাও তাতে “কেয়া বাত, কেয়া বাত” বলে বহ্বা দিয়ে বসেন।

বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বাজারে এই সহজ উৎপাদন পদ্ধতির কারনে সর্বজনস্বীকৃত সহজপ্রাপ্য কবিতা হারিয়েছে তার রাজবেস, রাজমুকুট ছেড়ে হয়েছে আজ জটাধারী পাগল। আর আমরা সেই জটাধাধারী পাগলের জটাকে জ্ঞানের ঘণিভূত অবস্থা ভেবে সন্যাসী রূপে পুজো করছি।
কোনো এক সময়ে বোধ হয় কবি শামশুর রহমান নিজেও টের পেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই মিথ্যে আলোর ঝকমকির আড়ালে লুকিয়ে থাখা বাংলা কাব্যের অন্ধকার যুগ। তাই হয়তো বারকার বলেছিলেন “রাত পোহাতে কত দেরি পাঞ্জেরী?” এই রাত বাংলা সাহিত্যের কাব্য জগতের অন্ধকার রাত। আমি বলছিনা কবিতা লিখতে হলে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করতে হবে। মহান কবিদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার স্বীকৃতি ছিলোনা তবে ধ্বনিতত্বের যে বাধনে তারা আপন ইচ্ছেয় নিজেদের বন্দি রেখেছিলেন তার কারনেই এখনো আমরা বাংলা সাহিত্য নিয়ে গর্ব করি।

নিয়মিত কিছু শব্দের অনিয়মিত প্রয়োগ ঘটিয়ে যে কবিদল বাংলা সাহিত্যকে রাজ মুকুট পড়ালেন, তাদের উত্তরসুরীরা জীবনের অনিয়মিত কিছু শব্দের নিয়মিত প্রয়োগ ঘটিয়ে ভাবছেন এই শব্দবৃষ্টিই হলো কাব্য সাগর। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রাথমিক কিছু ধারনা থাকা বাঞ্চনীয়। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতেই হয় অন্তত ‘‘অক্ষর”, ‘‘মাত্রা”, ‘‘মুক্তাক্ষর”, ‘‘বদ্ধাক্ষর বা যুক্তাক্ষর”, ‘‘পর্ব”, ‘‘অতিপর্ব” ইত্যাদি সম্পর্কে ন্যুনতম ধারনা থাকা উচিত।

অক্ষর
সাধারণ ভাবে আমরা বুঝি, প্রতিটি বর্ণই একেকটি অক্ষর/’সিলেবল’ (Syllable)। কিন্তু, বাংলা ব্যকরণের ভাষায় তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। আমরা জানি, মানুষ কোন শব্দ উচ্চারণ করার সময়, একবারে যত গুলো কম সংখ্যক বর্ণ উচ্চারণ করে, তাদের একেকটিকে একেকটি অক্ষর বলে। চলুন, আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি। এর জন্য আমি ‘‘কলম” শব্দটি বাছাই করলাম। খেয়াল করে দেখুন, ‘‘কলম’’ শব্দটি আমরা দুই ভাগ করে উচ্চারণ করছি ‘‘ক”, ‘‘লম্” এভাবে। শুধুমাত্র ‘‘কলম” শব্দটিই নয়, প্রতিটি শব্দই, আমরা এমন ভাগ ভাগ করেই উচ্চারণ করি। আর এই প্রতিটি ভাগই হল একেকটি অক্ষর। তাহলে, চলুন আমরা মাত্রা শিখে ফেলি।

মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর
যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে, তখন তাকে মুক্তাক্ষর/ওপেন সিলেবল (Open Syllable) বলে। যেমন, ‘‘কলম” শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি অক্ষর ‘‘ক’’, ‘‘লম্’’ পাওয়া যায়। এতে, ‘‘ক” একাই একটি অক্ষর, সুতরাং এটি মুক্তাক্ষর।
এবার, যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তাকে বদ্ধাক্ষর/ক্লোজড সিলেবল (Closed Syllable) বলে। সুতরাং, ‘‘কলম” এর ‘‘লম্’’ হল বদ্ধাক্ষর। এখন, একটি বড় শব্দের ক্ষেত্রে বোঝানোর চেষ্টা করি। যেমন, প্রত্যুৎপন্নমতি = প্রত্, তুৎ, পন্, ন, ম, তি। এখানে, ন, ম, তি এই তিনটি মুক্তাক্ষর এবং প্রত্, তুৎ, পন্, এই তিনটি বদ্ধাক্ষর। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
যে সব সিলেবল উচ্চারণের সময়মুখের ভেতর প্রবাহমান বাতাস জিভের দেয়ালে আটকে যায়তাদের ক্লোজড সিলেবল বলা হয়। যেমন : দাগ্, ভাগ্, ঘুষ্, হাঁস্, ঝাঁক্, আজ্, থাক্, কাল্, দিন্, চিন্, কই, ইত্যাদি।
যে সব সিলেবল উচ্চারণের সময়মুখের ভেতর প্রবহমান বাতাস জিভের দেয়ালের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের ওপেন সিলেবল বলে। যেমন: জা, ঝা, ছা, গু, চা, দি, দা, বা, বু ইত্যাদি।

পর্ব ও অতিপর্ব
এবার পর্ব নিযয়ে আলোচনা শুরু করছি। পর্বের সংজ্ঞা অনেকটা অক্ষরের মতই। এক নিঃশ্বাসে যতগুলো কম সংখ্যক শব্দ একবারে পড়া যায়, তাদের সমষ্টি হল একটি পর্ব। যেমন,
ঐ খানে তোর / দাদির কবর /
ডালিম গাছের / তলে /
যখন, একটি শব্দ নিয়ে একটি পর্ব বুঝাবে, তখন তাকে আমরা অতিপর্ব বলব। সুতরাং, এখানে ‘‘তলে” হল, অতিপর্ব। একে অপূর্ণ পর্বও বলা যেতে পারে। এখন চলুন আমরা আরেকটি কবিতা দেখি,
এই নেয়েছে / ঐ নিল যাঃ / কান নিয়েছে / চিলে /
চিলের পিছে / মরছি ঘুরে / আমরা সবাই / মিলে /
নিশ্চই বুঝতে পারছেন, ‘‘চিলে” এবং ‘‘মিলে” হল অতিপর্ব, বাকি গুলো পর্ব। সুতরাং, এই দুটি লাইনে ছয়টি পর্ব এবং দুইটি অতিপর্ব আছে।

ছন্দ
বাংলা কবিতার তিন ছন্দ সনাতনী ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। কবিতার উৎকৃষ্টতার জন্যে ছন্দ একমাত্র উপজিব্য না হলেও এটি যে প্রধানতম একটি দিক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিল্প সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, কবিতা, সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই তাল-লয়-সুর ইত্যাদির সংমিশ্রণে ভাষার মালা হয়ে মানুষের মনে দোলা দিয়ে আসছে। অক্ষর ও শব্দের নানামুখি চালে এই মালা তৈরীর প্রক্রিয়া বা নিয়মই আদতে ছন্দ।

এবার চলুন ভিন্ন ছন্দের বিশ্লেষনে আমারা মাত্রা সম্পর্কে জানার নিমিত্তে শব্দের শরীরের ভেতরে অক্ষরকে/সিলেবলকে খুঁজি।
উত্তম = উত্+তম্
(এখানে দুটিই ক্লোজড সিলেবল।)
জাঝা = জা+ঝা
(এখানে দুটিই ওপেন সিলেবল।)
বাহুবন্ধন = বা+হু+বন্+ধন্
(এখানে ‘বা’ ও ‘হু’ ওপেন সিলেবল কিন্তু ‘বন্’ ও ‘ধন্’ ক্লোজড সিলেবল।)
যুক্তাক্ষও = যুক্+তাক্+খর্
(এখানে তিনটিই ক্লোজড সিলেবল।)
ভিন্ন ছন্দে মাত্রা
অক্ষরবৃত্ত এর ক্ষেত্রে ওপেন সিলেবল সবসময়পাবে ১ মাত্রা। তবে শব্দের শুরুতে কিম্বা মধ্যে থাকলে ক্লোজড সিলেবল পাবে ১ মাত্রা, শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা।
যেমন-
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যায়দণ্ড’)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
চিত্ত যেথা/ ভয়শূন্য/ উচ্চ যেথা/ শির/
চিত্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ ভ(১)য়(১)শূন্(১)নো(১),/ উচ্(১)চো(১) যে(১)থা(১)/ শির্(২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।
জ্ঞান যেথা/ মুক্ত, যেথা/ গৃহের প্রা/চীর
জ্ঞা(১)ন(১) যে(১)থা(১)/ মুক্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ গৃ(১)হের্(২) প্রা(১)/ চীর্র (২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।

মাত্রাবৃত্ত এর ক্ষেত্রে ওপেন সিলেবল সবসময় পাবে ১ মাত্রা আর ক্লোজড সিলেবল পাবে ২ মাত্রা।
যেমন
ধনুকের মতো টংকার দিলো টাকা
তোমার উষ্ণ লাল কিংখাবে ঢাকা
(শহীদ কাদরী, প্রেমিকের গান)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
ধনুকের মতো/ টংকার দিলো/ টাকা/
ধ(১)নু(১)কের্(২) ম(১)তো(১)/ টং(২)কার্(২) দি(১)লো(১)/টা(১)কা(১)
দুইটি সম্পূর্ণ পর্ব ও একটি অতিপর্বে মাত্রাবৃত্তের ৬+৬+২ চাল।
তোমার উষ্ণ/ লাল কিংখাবে/ ঢাকা/
তো(১)মার্(২) উষ্(২) নো(১)/ লাল্(২) কিং(২)খা(১)বে(১)/ ঢা(১)কা(১)/
অর্থাৎ, ৬+৬+২ চাল।

স্বরবৃত্ত এর জন্য ওপেন, ক্লোজড উভয়সিলেবলই পাবে ১ মাত্রা।
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয়পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।
(আল মাহমুদ, ‘পাখির মতো’)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
তোমরা যখন/ শিখছো পড়া/
তোম্(১)রা(১) য(১)খন্(১)/ শিখ্(১)ছো(১) প(১)ড়া(১)/
অর্থাৎ ৪+৪ চাল।
মানুষ হওয়ার/ জন্য,/
মা(১)নুষ্(১) হও(১)য়ার্র(১) জন্(১)নো(১)/
অর্থাৎ, ৪+২ চাল।
আমি না হয়পাখিই হবো,
আ(১)মি(১) না(১)হয়্(১)/ পা(১)খিই(১) হ(১)বো(১)/
অর্থাৎ ৪+৪ চাল।
পাখির মতো বন্য।
পা(১)খির্(১) ম(১)তো(১)/ বন্(১)নো(১)/
অর্থাৎ, ৪+২ চাল।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে, আমি গদ্যছন্দের কথা ভূলে গেছি। কিন্তু খেয়ালের দরুন আমাদের বেখায়ালী মনে যে বোধটির উদয় হতে পারে তা হলো, গদ্য ছন্দে লেখা কবিতারও শব্দ সমূহের মধ্যে আভ্যন্তরীয় সম্পর্ক এবং সুরের প্রবাহ থাকে।
যেমন- “ যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না” বলেই আদালতে আমরা “মিথ্যাসভা” এর উদ্ভোধনী ফিতা কাটি আর জমিয়ে রাখা কথার জাবর কাটি। অথ্যাধুনিক কবিরাও তাই তাদের ব্যর্থ চরনের ভ্রান্তি ঢাকতে কবিতার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। তবে তাঁরা চাইলে অনশনও করতে পারেন; তাতে বাংলারই মঙ্গল।
অনেকের মাঝে আবার একটি ভ্রান্ত প্রবাহের বিভ্রান্ত কবিতাকুল মনোভাব দেখা যায়; তারা মনে করেন দূর্বোধ্য কিছু শব্দের পাশাপাশি অবস্থানেই সৃষ্টি হয় অমর কবিতা। কাব্য জগতকে অমর করতে গিয়ে যে তারা কাব্যের জন্যেই কবর কুড়ে বসেন তাতে পাঠক সমাজ খুবই মর্মাহত হয়ে কবিতাকে অন্য গ্রহের ভাষা মনে করেন।

যদি কেউ লেখেন,
মনগোলাপের পাপড়িমাল্যে সুবাসচাদরের ক্রিয়ামূল
শুভ্রসকালে উথিত সূর্য!
মালিরূপ মন, আবেগের জল-
থামিল বাগান দুয়ারে
(কালপনিক কবিতা)

কোনো সাধারন পাঠককে যদি বলি কবি ‘বিখ্যাতবিমল রায়’-এর এই অখ্যাত কবিতাটি সাপ্তাহিক ‘অবিবেচিত’ পত্রিকার তথাকথিত সাহিত্য সাময়ীকিতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে বলে বসবেন, “বাহ! খ্বুই সুন্দর” অথচ উপরিউক্ত কবিতাটি বিন্দুমাত্র না ভেবে শুধুমাত্র কিছু অপরিচিত রূপক শব্দের পাশাপাশি অবস্থান। যা কবিতার ‘ক’ তেও নয় ‘তা’ তেও নয়, ‘বি’ তে এসে বিশ্রিভাবে বিনষ্ট হয়েছে।
এবার সমাপ্তি রেখা টানতেই হয়। অতি নিয়মে খেলার আনন্দ মাটি হয় বলে যে, কোনো নিয়ম ছাড়াই আমরা খেলায় মাতবো এটা কেমন কথা? নিয়মের অভাবেই যত দ্বন্দের উৎপত্তি। তাই সার্বিক ধারনা মাথায় নিয়েই কলমের আঁচর খাতায় দেয়া উচিৎ।

“কবিতা” রাজদরবারের বিষয় বলে আমি তার গন্ডিকে চারদেয়ালের মাঝে রাখতে রাজি নই। তবে এও আমার চাহিদা নয় যে, তাকে আমি পথের ধুলিতে পরিণত করবো। আমি চাই কবিতাকে আমরা রাজদরবারের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকরূপ প্রজাদের মাঝে নিয়ে আসবো কিন্তু তার স্বাদে কোনো ভিন্নতা থাকবেনা।

তাই কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বাংলা কবিতাকে বাংলা সাহিত্যের দ্রোপদী বলে আক্ষ্যায়িত করা। আমার এই কাল্পনিক কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধন একজন নয়, হাজারে দুর্যোধন একইসাথে যে পাশা খোলায় মেতেছে, তার পরিণতীতে আমাদের অমর কবিরাই পঞ্চপান্ডব হয়ে বনবাসে চলে যাবে। খেলা শেষে চারপাশ থেকে ছুটে আসছে অগণিত দুর্যোধনের হাত আর তারা যেমন ইচ্ছে তেমন করেই বাংলার এই দ্রোপদীর ক্রমাগত বস্ত্রহরণ করছে। আমাদের সন্তানরা হয়তো তা পুথি হিসেবে পড়বে।

পরিশেষে অত্যাধুনিক কবিদের কাছে করজোর প্রার্থনা যেমন ইচ্ছে তেমন বিষয় নিয়ে লিখুন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে নয়।

লেখক : গবেষক, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

Continue Reading

প্রবন্ধ

বাবা-মা সম্বোধনটি যেভাবে এলো

Avatar photo

Published

on

babamaa1অনলাইন ডেস্ক: বাবা সম্বোধনটি যেভাবে এলো – মা শব্দের মতো বাবা ডাক নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বাবা ডাকের ইংরেজি শব্দ papa। রাশিয়ান, হিন্দি, স্প্যানিশ ভাষায়ও পাপা ব্যবহৃত হয়। জার্মান ভাষায় পাপি। আইসল্যান্ডের ভাষায় পাব্বি। সুইডিশ ভাষায় পাপ্পা। তুর্কি, গ্রিক এবং মালয় ভাষাসহ আরও অনেক ভাষায় ব্যবহৃত হয় বাবা। শিশুরা যখন প্রথম ভাঙা ভাঙা কথা বলতে শুরু করে, সেই সময়ই তারা মা-বাবা শব্দ দুটি উচ্চারণ করে অনায়েসেই। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, শিশুরা যখন প্রথম কথা বলতে শেখে তখন ম, ব, দ, ত এই রকম সহজ উচ্চারণের ব্যঞ্জনবর্ণগুলো উচ্চারণ করতে পারে আগে। তাই তারা সহজেই তাদের প্রথম উচ্চারিত শব্দ হিসেবে মা, বাবা, দাদা এগুলো উচ্চারণ করে থাকে।
আজ প্রাসঙ্গিক তাই বলা, মা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ mom, যা পূর্বে ব্যবহৃত শব্দ mamma- এর পরিবর্তিত রূপ। বলা হয়, ইংরেজি শব্দ মাম্মা এসেছে ল্যাটিন শব্দ mamma থেকে। যা স্তন বোঝতে ব্যবহৃত হতো। এই শব্দ থেকে mammel শব্দটির উৎপত্তি। যা কিনা স্তনপায়ী প্রাণীর ইংরেজি শব্দ। মজার হলো- পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মা কে বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দগুলোর উচ্চারণ প্রায় কাছাকাছি। আর সবগুলো শব্দের শুরুতেই ব্যবহৃত হয়েছে এম অথবা ম ব্যঞ্জনবর্ণ। উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। জার্মান ভাষায় মাট্টার (Mutter), ওলন্দাজ ভাষায় ময়েদার (Moeder), ইতালির ভাষায় মাদর (Madre), চিনা ভাষায় মামা (Mama), হিন্দি ভাষায় মাম (Mam), প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় মাত (Mut) এবং আফ্রিকার বিভিন্ন ও বাংলা ভাষায় মা (Ma)।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত মা ডাকের শব্দগুলোর মধ্যে উচ্চারণগত এই মিল কীভাবে ঘটল তা এক রহস্য। তবে, ভাষাবিদরা বলেন, শিশুরা যখন তার মায়ের দুধ পান করে, তখন তারা তাদের মুখভর্তি অবস্থায় কিছু শব্দ করে। সেই শব্দগুলো নাক দিয়ে বের হয় বলে উচ্চারণগুলো অনেকটা ম এর মতো শোনা যায়। তাই প্রায় সব ভাষাতেই মা ডাকে ব্যবহৃত শব্দগুলো ম বা এম দিয়ে শুরু হয়। বাবার ক্ষেত্রে এমন কোনও যুক্তি সেভাবে নেই।

Continue Reading

প্রবন্ধ

স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির উপর অনেক কিছু নির্ভর করে

Avatar photo

Published

on

Asad Aliমোহাম্মদ আসাদ আলী : সুস্থ মস্তিস্কের সচেতন মানুষমাত্রই জানেন- আত্মাহীন যান্ত্রিক উন্নতিতে ভর করে সমগ্র মানবজাতি দিন দিন নিশ্চিত ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলছে। মানুষ জানে এ পথ ধ্বংসের, এ পথ বিপদের, কিন্তু থেমে যেতে পারছে না। পারছে না কারণ প্রচলিত বস্তুবাদী সভ্যতা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
আত্মাহীন জীবনব্যবস্থাগুলো মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক সর্বগ্রাসী মহাদানবে পরিণত করেছে, পৃথিবীর কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত হয়ে বিশেষ একটি শ্রেণির হাতে জমা হচ্ছে যাদের কাছে একটি প্রাণের চেয়ে একটি বুলেটের মূল্য অনেক বেশি। অতি ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য সমগ্র মানবজাতিকে বিপদে ফেলতেও তারা পিছপা হচ্ছে না। এই কর্তৃত্ববাদী শক্তির শাসন ও শোষণ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ একের পর এক জীবনব্যবস্থা পরিবর্তন করছে। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে প্রবেশ করেছে, কিন্তু জীবনব্যবস্থার এই উত্থান পতন ধ্বংসের পথে মানুষের অগ্রযাত্রাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। বরং এই জীবনব্যবস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটে গেছে।
যে পথে চললে, যে জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করলে মানুষ জাতি অপ্রতিরোধ্যভাবে তার আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাবে না, তার বুদ্ধি ও মনের, দেহের ও আত্মার এমন একটা সুষ্ঠু, ভারসাম্য মিশ্রণ দেবে যা তাকে দু’দিকেই উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবে- এমন পথ খুঁজতে গেলে সর্বপ্রথম মানুষকে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে সিদ্ধান্তের উপর তার সাফল্য ও বিফলতা স¤পূর্ণভাবে নির্ভর করবে। সেটা হচ্ছে ধীরস্থির, নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত করা যে, এই পৃথিবী ও মহাবিশ্বের কোন স্রষ্টা আছেন, কি নেই।
সাধারণ বুদ্ধিতেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মানুষ পৃথিবীতে কোন পথে কিভাবে চললে নিরাপত্তা ও শান্তির মধ্যে থাকতে পারবে তা স্রষ্টা থাকলে বা না থাকলে এই উভয় অবস্থাতেই একই হওয়া স¤পূর্ণ অসম্ভব। আরও সহজ করতে গেলে- আপনাকে যদি কোনও বিশেষ একটি দেশে যেতে হয়, তবে সর্ব অবস্থাতেই আপনার সিদ্ধান্ত কি একই হবে? যদি সেই দেশটাতে দৃঢ় আইন-কানুন, বিচারালয়, কর্তব্যনিষ্ঠ, দক্ষ পুলিশ থাকে, অথবা সেই দেশটাতে কোন সরকার, আইন-কানুন, পুলিশ এমনকি কোর্ট-কাচারী কিছুই না থাকে- এই উভয় অবস্থাতেই কি আপনি একইভাবে সেই দেশে প্রবেশ করবেন এবং একইভাবে বিচরণ করবেন? কোন দ্বিধা না করে বলা যায় যে- অবশ্যই নয়। প্রথম অবস্থায় আপনি একা এবং নিরস্ত্র সে দেশে প্রবেশ করবেন এবং নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াবেন এবং দ্বিতীয় অবস্থায় আপনি একা সে দেশে অবশ্যই প্রবেশ করবেন না। যদি যেতেই হয় তবে আপনি দল গঠন করবেন, অস্ত্র সজ্জিত হবেন এবং চলাফেরার সময় অত্যন্ত সতর্ক এবং সাবধান হবেন। যেহেতু দেশে আইন নেই তাই আপনার অস্ত্রই হবে আইন। অর্থাৎ ঐ দেশে একটা শক্তিশালী সরকার থাকা বা না থাকার উপর আপনার মত, পথ, কাজ সর্ব কিছু শুধু বদলাচ্ছে না একেবারে উল্টো হয়ে যাচ্ছে।
একইভাবে স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকা বা না থাকার উপর মানুষের চলার পথ, মত ও শান্তি-অশান্তি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। নাস্তিকদের দাবি মোতাবেক যদি তিনি না থাকেন তবে তো না-ই, সে ক্ষেত্রে মানুষের চলার পথ মানুষকেই ঠিক করে নিতে হবে যে চেষ্টা চলছে বিগত কয়েক শতাব্দীব্যাপী এবং যার পরিণাম হিসেবে মানবজাতি এখন ধ্বংসের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের চলার পথ নিজেরা ঠিক করে নিতে মানুষ অপারগ- এটা প্রমাণিত সত্য। অন্যদিকে যদি তিনি থেকে থাকেন তাহলে এটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে, যেহেতু তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, মানুষের শরীর ও আত্মা, মানুষের দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তার চেয়ে ভালো আর কেউই জানে না, সুতরাং একমাত্র তিনিই পারেন এমন একটি জীবনব্যবস্থা মানুষকে দান করতে যা মেনে চললে মানুষ অনিবার্যভাবে রক্তপাতহীন ও অন্যায়-অবিচারহীন শান্তিময় জীবনযাপন করতে পারবে।
কাজেই স্রষ্টা আছেন কি নেই এই সিদ্ধান্তের উপর স¤পূর্ণ নির্ভর করছে মানুষের সত্যিকারের শান্তিময়, সুখী প্রগতির পথ কিম্বা বিপথ। মানব জাতি হিসাবে, মানুষ আজও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নি, তাই তার মত ও পথের এত বিভিন্নতা, এত সংঘর্ষ। মানব জাতিকে সামগ্রিকভাবে আজ স্থির সিদ্ধান্ত নিতেই হবে যে স্রষ্টা আছেন কি নেই, কারণ আজ শুধু মানুষে মানুষে যুদ্ধ, রক্তারক্তি, হানাহানি, অশান্তি আর অশ্র“ নয়, এগুলো দিয়ে তার অতীত ও বর্তমান পূর্ণ হয়ে আছে- আজ বাজী তার একেবারে অস্তিত্বের।

Continue Reading