নেতারা কোটি কোটি টাকা বানালো, শাস্তি ভোগ করছি আমরা : আ.লীগ কর্মী
আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা অভিযোগ করছেন, দলের শীর্ষ নেতারা যখন কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন, তখন সাধারণ কর্মীদের জীবন আজ বিপন্ন। ফরিদপুরের এক কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “নেতারা সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমাদের ফেলে দিয়েছে বিপদের মধ্যে। তাদের পাপের শাস্তি এখন ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো তৃণমূল কর্মীদের।” বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে দলটির কর্মীরা নানা হামলা ও মামলার শিকার হচ্ছেন। এতে অনেকেই নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। অপরদিকে, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা ও দিশেহারা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দলের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপন করলেও তৃণমূল কর্মীরা হামলা, মামলা ও লুটপাটের শিকার হয়ে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা এখন গভীর হতাশা ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দলটির শীর্ষ নেতাদের দেশত্যাগ এবং আত্মগোপনের পর সাংগঠনিক অবস্থাও ক্রমাগতভাবে ভেঙে পড়ছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন বলে অনেকে জানাচ্ছেন।
ফরিদপুরের একজন আওয়ামী লীগ কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ক্রিম খেলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানালো তারা; আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো তৃণমূল নেতাকর্মীদের।” তিনি জানান, এলাকা ছেড়ে এক মাস আগে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও হামলা ও লুটপাটের শিকার হয়েছে।
আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, “আমাদের দলের এখন দিশাহারা অবস্থা। এক মাস হয়ে গেল অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে।” পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। এক মাস ধরে বাড়িঘরে ফিরতে না পেরে নিরাপত্তার অভাবে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক তৃণমূল কর্মী। তারা জানান, নেতারা দেশের বাইরে থাকলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন।
তৃণমূলের একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কোনো কার্যকর নির্দেশনা না থাকায় তারা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছেন। অনেকেই মনে করছেন, শেখ হাসিনার দেশে ফেরা এবং দলের অভ্যন্তরে একটি নতুন শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন, যা তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে পারবে।
চাপে গোপালগঞ্জের নেতারা
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার নেতাকর্মীরা যখন ‘আত্মগোপনে’ যাচ্ছিলেন, তখন উল্টো চিত্র দেখা গিয়েছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির নিজ জেলা গোপালগঞ্জে। শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে দাবি করে গত ৫ আগস্টের পরপরই বেশ কয়েক দফায় বিক্ষোভ মিছিলও করেছিলেন তারা।
সে সময় বিক্ষোভ মিছিল থেকে সেনা সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে, যা নিয়ে পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে গত ১৫ আগস্টের পর গোপালগঞ্জেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আগের মতো সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। মূলত সেনা সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকেই তাদের ওপর ‘চাপ’ ছিল, যা এখন আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা।
“সব মিলিয়ে আমরা এখন চাপের মধ্যে আছি, বিশেষ করে যৌথ অভিযান শুরুর পর চাপ আরও বেড়েছে,” বলছিলেন গোপালগঞ্জের থানা পর্যায়ের এক নেতা। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর গ্রেপ্তার আতঙ্কে নেতাদের অনেকেই রাতে নিজ বাড়িতে থাকছেন না বলেও জানা গেছে।
হাল ধরবে কে?
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন পর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছিলেন, তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। “আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি—আমাদের যথেষ্ট হয়েছে,” বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মি. জয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য তার কণ্ঠে ভিন্ন সুর শোনা যায়।
“অবশ্যই তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশে ফিরবেন, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে,” বিবিসিকে দেওয়া আরেকটি সাক্ষাৎকারে বলেন মি. জয়।
এরপর একটি বিবৃতিতে গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে শোক দিবস পালনের জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। গোপালগঞ্জ ও বরিশালের দু’জন জেলা পর্যায়ের নেতার সঙ্গেও তখন কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি, যার কলরেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েও পড়েছিল।
এছাড়া মি. জয়ও জানিয়েছিলেন, তিনি রাজনীতিতে যোগ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তাদের তেমন কোনো নির্দেশনা দিতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকে। ফলে নেতৃত্বশূন্যতা অনুভব করছেন বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এমন অবস্থায় সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে, শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন আসতে পারে।
নতুন নেতৃত্বে কারা আসছেন, সে নিয়েও নানা আলোচনা শোনা যাচ্ছে। “এসব অপপ্রচার। কমিটি পরিবর্তনের এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি,” বলেছেন আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা। কিন্তু হঠাৎ এমন ‘অপপ্রচার’ ছড়ানোর কারণ কী? কারাই-বা এটি ছড়াচ্ছে?
“এটি ছড়ানোর উদ্দেশ্য হলো আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করা। দলকে ফাটল ধরানোর জন্যই বিএনপি-জামায়াত এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে, যা আগেও বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি,” বলেন ওই নেতা।
এছাড়া তৃণমূলের কর্মীরা শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটি স্বীকার করেছেন তিনি। “আমাদের যে ভুল আছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন কীভাবে সেই ভুল শুধরে দলকে আবারও সক্রিয় করা যায়, তা মিটিং হলে আলোচনা করবো,” বলেন আওয়ামী লীগের ওই শীর্ষ নেতা।