বিএনপি দুর্বল হলে দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে?
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে দলটি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দলটি প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার পাশাপাশি রাজনীতিতে দলটির শক্ত অবস্থানও ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি দৃশ্যত দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বিএনপি’র মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সেটি বাংলাদেশের রাজনীতিকে কিভাবে প্রভাবিত করবে?
২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে রাজনীতিতে বিএনপি’র শক্ত অবস্থান দেখা যাচ্ছেনা বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে দলটির টানা অবরোধ কর্মসূচী রাজনৈতিক সফলতার মুখ দেখেনি।
সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি’র সরব উপস্থিতি নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল মনে করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি’র দুর্বল হয়ে পড়া দেশের সার্বিক রাজনীতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
তিনি মনে করেন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র দুর্বল হয়ে পড়া শুধু দলটির জন্য সংকট নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সংকট। বিএনপি’র দুর্বল হয়ে পড়া ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে একটি বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করছে।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, ” ১৯৯১ সালের পর থেকে একটা ভারসাম্যমূলক দ্বি-দলীয় শাসন ব্যবস্থা দেখে এসেছি। বিএনপি এখন এতো দুর্বল হয়ে গেছে যে এদেশে এখন প্রায় একদলীয় একটা শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়ে গেছে। ”
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশগ্রহণ করতো, তাহলে দলের অবস্থান শক্তিশালী থাকতো কিনা সেটি নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। কেউ-কেউ মনে করেন, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। আবার এমন ধারনাও বেশ জোরালো যে নির্বাচন বয়কট করা ছাড়া বিএনপি’র সামনে আর কোন রাস্তা খোলা ছিলনা।
সম্প্রতি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর দলটিতে নানা অসন্তোষের চিত্র সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। দলের কোন -কোন সিনিয়র নেতা প্রকাশ্যে নতুন কমিটিগুলোর সমালোচনা করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতির অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন বলছেন রাজনীতির মাঠে বিএনপি নীরব হলেও তাদের জনসমর্থনে ভাটা পড়েনি।
বিএনপি’র সাংগঠনিক কাঠামো যে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে মনে করেন এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
অধ্যাপক নাসিম আক্তার হোসাইন বলেন, ” একটি দলের সাংগঠনিক কাঠামো বিপর্যয় হলেই সে দলটি যে ভিত্তিহীন হয়ে পড়বে সেটি বলার মতো কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করিনা। ”
রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি কেন দুর্বল হয়ে পড়লো সেটি নিয়ে নানা ধরনের মূল্যায়ন আছে। কেউ মনে করেন, বিগত বছরগুলোতে বিএনপি’র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল ছিল। আবার অনেকে মনে করেন, সরকারের দমন-পীড়ন ও মামলার কারণে বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা সক্রিয় হচ্ছেন না। আবার অনেকে ভাবছেন, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় বাইরে থাকার কারণে নেতা-কর্মীদের মাঝে হতাশা রয়েছে।
বিএনপি’র শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি স্তিমিত হয়ে যাবার একটি বড় কারণ হচ্ছে সরকারের ‘দমন-পীড়ন।’ এমন পরিস্থিতিতে চাইলেও বিএনপি’র পক্ষে সক্রিয় থাকা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ। তবে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নিষ্ক্রয় হয়ে পড়ার উদাহরণ রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, ” আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আইয়ুব খানের আমলে আওয়ামী লীগের এ ধরনের অবস্থা হয়েছিল।” তিনি মনে করেন, একটি দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকারের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা তৈরি হয়।
তবে রাজনীতিতে বিএনপি’র নিষ্ক্রিয় থাকার বিষয়টি শক্তি সঞ্চয়ের একটি কৌশলও হতে পারে বলে তিনি ধারনা করছেন।
তিনি বলেন, ” আক্রান্ত হয়েছেন, যার ফলে আপনি পিছু হটছেন। এবং পিছু হটে আবার শক্তি সঞ্চয়ে করে যদি কিছু কর যায় ভবিষ্যতে। সেটার জন্য প্রস্তুতি নেয়া”
সমালোচনা রয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছিল এবং সেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর গুরুত্ব বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় উপলব্ধি করতে পারেনি। সেজন্যই বিএনপিকে এখন রাজনৈতিক মূল্য দিতে হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন এ ধারণা আংশিক সত্য, পুরোপুরি সত্য নয়।
তিনি বলেন, “একটা দল যখন রাজনীতিতে অসুবিধার মধ্যে পড়ে তখন তার নানা সমালোচনা হয়। আবার যখন একটা দল বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে তখন কিন্তু আবার আমরা সে ধরনের কথা বলি না।”
তবে বিশ্লেষক আসিফ নজরুল মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ‘অনুল্লেখ্য’ হয়ে যাবার পেছনে প্রধানত দায়ী বিএনপি’র রাজনৈতিক কৌশল। তিনি মনে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দু’টি বড় ভুল করেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জ্যির সাথে সাক্ষাৎ না করা এবং আলোচনার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে টেলিফোন করেছিলেন সেখানে সাড়া না দেয়া – এ দু’টি বিষয়কে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বড় ভুল হিসেবে বর্ণনা করছেন।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, ” বর্তমান রাজনীতি , তরুণ প্রজন্মের মনোভাব এবং আন্তর্জাতিকভাবে রাজনীতির যে মেরুকরণ ঘটছে…. আমার কেন যেন মনে হয় ওনারা (বিএনপি) এ পুরো বিষয়গুলো রিয়েলাইজ (অনুধাবন) করতে পারেন না।”
রাজনীতিতে বিএনপি’র অবস্থানকে বিশ্লেষকরা নানাভাবে মূল্যায়ন করলেও দলটি কী মনে করছে?
বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন বিএনপি কখনোই দুর্বল হয়নি। সরকারের নানা ধরনের ‘দমন-পীড়নের’ পরেও বিএনপি শক্তভাবে টিকে আছে বলে উল্লেখ করেন দলটির মহাসচিব।
মি: আলমগীর বলেন, ” যদি একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, সে নির্বাচনে কিন্তু বিএনপি এ কথাগুলোর উত্তর দিতে প্রস্তুত রয়েছে।”
বিএনপি’র অনেক নেতাই মনে করেন দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্যে আছে। এ চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে তারা সামনের দিকে কিভাবে এগুতে পারে সেটি মূল লক্ষ্য দলটির।