Connect with us

Highlights

বিটিআরসির নির্দেশ: বিজয় কিবোর্ড বাধ্যতামূলক করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন

Published

on

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কিবোর্ড স্মার্টফোনে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহারের নির্দেশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কি–বোর্ড বা অ্যাপ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) বাধ্যতামূলক তালিকার কোনো পণ্য নয়। তাই এটি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সুযোগ নেই। কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবার নাম উল্লেখ করে কোনো সরকারি সংস্থা বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহারের নির্দেশ দিতে পারে না।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ১৩ জানুয়ারি মুঠোফোন উৎপাদনকারী ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে বলেছে, আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে বিজয় কি–বোর্ড ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ জন্য সংস্থাটির কাছ থেকে বিনা মূল্যে বিজয় কিবোর্ডের অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ কিট (এপিকে) ফাইল নিয়ে মুঠোফোনে স্থাপন করতে হবে। নইলে মুঠোফোন বিক্রির অনাপত্তি দেওয়া হবে না।

বিজয় কিবোর্ডের আবিষ্কারক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আনন্দ কম্পিউটার্স বিজয় কিবোর্ড সরবরাহ করে। আনন্দ কম্পিউটার্সের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এটির মেধাস্বত্ব মোস্তাফা জব্বারের নামে। উল্লেখ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি।

বিটিআরসির দেওয়া চিঠিতে বিজয় কিবোর্ড বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে ‘সরকারের নির্দেশনা’র কথা বলা হয়েছে। তবে সরকারের কোন নির্দেশনা, কোন আইনে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে গত দুই দিন বিটিআরসির বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়। তবে সম্ভব হয়নি।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে গতকাল বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন। তা হলো, বিজয় কিবোর্ডকে ভিত্তি ধরে মুঠোফোনের জন্য কিবোর্ডের মানকাঠামো (স্ট্যান্ডার্ড) তৈরি করেছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। ২০১৮ সালে সেটা গ্রহণ করেছে বিএসটিআই। বিটিআরসি আইসিটি বিভাগের সেই মানটিই মুঠোফোনে বিনা মূল্যে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিটিআরসি আইসিটি বিভাগের মান মেনে চলতে বাধ্য।

টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার একটা মান ঠিক করে দিয়েছে। তাই সরকারি কাজ করতে গেলে সরকারের দেওয়া মান মেনে চলতে হবে।

কোনো একজন মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা তাঁর অধীন সংস্থা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দিলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব হয় কি না, জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার বলেন, কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। মন্ত্রী হিসেবে সরকারের ঠিক করে দেওয়া মান প্রয়োগ করা তাঁর দায়িত্ব।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, তথ্যপ্রযুক্তি–সংক্রান্ত পণ্য ও সেবার মান নির্ধারণে কারিগরি কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। সংস্থাটি যে মানকাঠামো তৈরি করে সেটি পর্যালোচনা শেষে ‘বাংলাদেশ মান’ হিসেবে ঘোষণার ক্ষমতা রয়েছে কেবল বিএসটিআইয়ের। সংস্থাটির সাড়ে চার হাজারের বেশি মান রয়েছে। তবে বাধ্যতামূলক পণ্য তালিকায় রয়েছে ২২৯টি পণ্য ও সেবা। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবা বিক্রি করতে হলে বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয় ও জাতীয় মান মেনে চলতে হয়। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা নেই।

বিএসটিআইয়ের সিএম (সার্টিফিকেশন মার্কস) শাখার উপপরিচালক মো. রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাধ্যতামূলক পণ্য তালিকায় স্মার্টফোনের কিবোর্ড নেই।

বিটিআরসির চিঠিতে সরাসরি বিজয় কিবোর্ডের কথা উল্লেখ করে তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি মুঠোফোন উৎপাদন ও আমদানিকারকদের চিঠি দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে বিটিআরসির কাছ থেকে বিজয় কিবোর্ডের এপিকে ফাইল সংগ্রহ করে মুঠোফোনে স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুস্তাফিজুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, কোন আইনের ভিত্তিতে নির্দেশ দেওয়া হয়, তা নির্দেশনায় থাকতে হয়। আর সরকারি কোনো সংস্থা কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবার নাম উল্লেখ করে নির্দেশনা জারি করতে পারে না। প্রয়োজনে তারা শুধু নির্দিষ্ট মানের কথা বলতে পারে। সেই মান মেনে চললে যেকোনো প্রতিষ্ঠান পণ্য ও সেবা সরবরাহের যোগ্য হতে পারে।

অ্যাপ স্টোরে যত কিবোর্ড-

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল (অ্যালফাবেট) মুঠোফোনের অপারেটিং সিস্টেম (ওএস) অ্যান্ড্রয়েড তৈরি করে। মুঠোফোন উৎপাদনকারীরা গুগলের এই অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে মুঠোফোন তৈরি করে বাজারে ছাড়ে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপল ইনকরপোরেশনের তৈরি আইফোন পরিচালিত হয় তাদের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম আইওএস দিয়ে।

গুগলের প্লে স্টোরে বাংলা কিবোর্ডের বেশ কিছু অ্যাপ রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত হিসাবে, রিদমিক নামের একটি কিবোর্ড ডাউনলোড হয় পাঁচ কোটির বেশি বার। রিদমিক ক্ল্যাসিক কিবোর্ড ডাউনলোড হয়েছে এক কোটির বেশি। ‘বাংলা কিবোর্ড: বাংলা টাইপিংয়ের’ ডাউনলোড সংখ্যা এক কোটি। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রতিষ্ঠিত আনন্দ কম্পিউটার্সের বিজয় অ্যান্ড্রয়েড কিবোর্ড ডাউনলোড হয়েছে এক লাখের বেশি। তার মানে হলো, জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বিজয় কিবোর্ড অনেক পিছিয়ে। এদিকে অ্যাপলের আই-স্টোর ঘেঁটে দেখা যায়, বিজয় কিবোর্ড নেই। রিদমিক আছে।

বিজয় কিবোর্ড ডাউনলোড করে মুঠোফোনে স্থাপন করতে গিয়ে দেখা যায়, গুগল একটি সতর্কতামূলক বার্তা দিচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, এই অ্যাপটি স্থাপন করলে এই আশঙ্কা আছে যে অ্যাপটি সব লেখা (টেক্সট) সংগ্রহ করার সক্ষমতা রাখে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত উপাত্ত (পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ড নম্বরও হতে পারে) থাকতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মুহাম্মদ এরশাদুল করিম প্লে স্টোরে পাওয়া বিজয় কিবোর্ডের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতি বিশ্লেষণ করে প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো মুঠোফোন অ্যাপ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে গোপনীয়তার নীতিমালা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যবহারকারীর অধিকার এবং সেবাদাতার দায়দায়িত্ব বর্ণনা করা থাকে। বিজয়ের গোপনীয়তার নীতিতে মৌলিক অনেক বিষয় নেই। কিবোর্ডটির নিরাপত্তাব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র নয়, সেটা তারা নিজেদের গোপনীয়তার নীতিতেই উল্লেখ করেছে। নীতিটি মূলত বিনা মূল্যের একটি ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া, সেটাও বলা আছে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটি কিবোর্ড গ্রাহক বা ভোক্তা হিসেবে আমি কেন নিতে চাইব, আমাকে কেন বাধ্য করা হবে। আমার তথ্যের নিরাপত্তার দায় কে নেবে?’

প্রযুক্তিবিদেরা জানান, মুঠোফোনের অ্যান্ড্রয়েড ভার্সনে গুগলের নিজস্ব কিবোর্ড স্থাপিত থাকে, যেটির নাম জি-বোর্ড। সেটি দিয়ে বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় লেখা যায়। আলাদা করে অন্য কোনো অ্যাপ ডাউনলোড না করলেও চলে। তবে ব্যবহারের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অনেকে বিভিন্ন কিবোর্ড ব্যবহার করেন। কোনো কিবোর্ড চাইলে মুছে দেওয়া (ডিলিট) যায়।

মোস্তাফা জব্বার বলছেন, বিটিআরসি বিজয় কিবোর্ড বিনা মূল্যে দিচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অন্য কিবোর্ডও বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। আর সব মুঠোফোনে কোনো কিবোর্ড বাধ্যতামূলক করার সঙ্গে প্রচার ও প্রসারের বিষয় থাকে।

ঝক্কি ও ব্যয় ‘বাড়বে’-

দেশে ১৪টির মতো প্রতিষ্ঠান স্মার্টফোন উৎপাদন করে। আবার কেউ কেউ মুঠোফোন আমদানিও করে। বছরে স্মার্টফোন বিক্রি হয় এক কোটির মতো। এ খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলেছে, মুঠোফোনে বিজয় কিবোর্ড স্থাপন করে বাজারে ছাড়তে গেলে তাদের ঝক্কি বাড়বে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও ট্রানশান বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা বিশ্বে অ্যান্ড্রয়েডের জন্য একই এপিকে প্যাকেজ থাকে। কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্য আলাদা করা হয় না।’ তিনি বলেন, প্রতিটি অ্যাপকে প্যাকেজের আওতায় আনতে গেলে গুগলের অনুমতি নিতে হয় এবং নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। এখন বিজয়কে এই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে ফির পরিমাণও বাড়বে।

সংবাদসূত্র : প্রথম আলো

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *