বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন, নেই পর্যাপ্ত ত্রাণ, ছড়িয়ে পড়ছে রোগবালাই
দেশেরপত্র ডেস্ক:
দেশের বড় বড় নদীগুলোতে বেড়েই চলেছে পানি। অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা নদীর পানিতে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় পানি নদীর দুই কূল ছাপিয়ে চলে এসেছে বসতবাড়িতে। ঘরে প্রবেশ করেছে পানি। গবাদি পশুর খাবার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। খাবার পানির উৎস দূষিত পানির সাথে মিশে যাওয়ার ফলে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো রোগব্যাধি। মওসুমি বায়ু বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বেশ সক্রিয় রয়েছে। ফলে এসব স্থানে গত দুই সপ্তাহ মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের সব বড় নদীর উৎস ভারতে। শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশে এসে পড়েছে এমন প্রায় সব নদীতেই বাঁধ নির্মাণ করে পানি আটকে দিলেও বর্ষা মওসুমে ভারত সব নদীর বাঁধ খুলে দেয়। ফলে বর্ষা এলেই বাংলাদেশের নদীগুলো দ্রুত ভরে গিয়ে দুই কূল উপচে বন্যার সৃষ্টি করে। এবারো এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশের সব বড় নদীই বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়া নদীর পানি অপরিবর্তিত থাকলেও তিস্তার পানি গত ২৪ ঘন্টায় আবারও ২০ সে.মি. বেড়েছে। গতকাল সকালে ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ২৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঐ সময়ে যমুনা নদীর পানি বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধীর গতিতে পানি কমলেও, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ধলিরকান্দি থেকে রৌহাদহ পর্যন্ত পৌনে ৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাঁধের ৫টি পয়েন্টে প্রায় ৩০০ মিটার ধসে গেছে। যমুনায় পানি অপরিবর্তিত থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি থাকায় এ ঝুঁকি আরো বেড়ে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে নতুন নতুন এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সারিয়াকান্দির উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল মোতালেব জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বৃদ্ধি না পেলেও এখনো বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকালে বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলার ধলিরকান্দি থেকে রৌহাদহ পর্যন্ত পৌনে ৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুরোটাই হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁধের ৫টি পয়েন্টে ৩০০ মিটার ধসে গেছে। টপ থেকে এখন যমুনার পানি ২মিটার উপরে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের চন্দনবাইশার শেখ পাড়া ও রৌহাদহ এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
জামালপুরে যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ির ২৫টি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। জামালপুর জেলার বিভন্ন ইউনিয়নের ৩৫টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদিকে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ, চুকাইবাড়ী, চিকাজানী ৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে। ইসলামপুর উপজেলার যমুনার তীরবর্তী ৭টি ইউনিয়ন, বিশেষ করে পার্থর্শী, কুলকান্দি, বেলগাছা, চিনাডুলী, নোয়ারপাড়া, ইসলামপুর সদর ও সাপধরী ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে অত্যন্ত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ সব ইউনিয়নের মধ্যে চিনাডুলী ও নোয়ারপাড়া ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যমুনার উলিয়ার পয়েন্টে ১২শ মিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পানিতে বিলিন হয়েছে। অপর দিকে যমুনার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। ইসলামপুর উপজেলার ১২টি ইউনিয়েনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী ৫টি ইউনিয়ন রয়েছে। ইউনিয়ন গুলোর মধ্যে পলবান্ধা,গোয়ালের চর, গাইবান্ধা, চরগোয়ালিনী ও চরপুটিমারী ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর উঠতি ফসল রোপা আমন ধান, বীজতলা, তরিতরকারী, পুকুরের মাছ। এছাড়া জেলার বকসিগঞ্জ উপজেলার নিলক্ষিয়া, বগারচর, মেরুরচর ও সাধুরপাড়া ইউয়িন, মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর, ঘোষের পাড়া, ঝাউগড়া ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খান এরইমধ্যে ইসলামপুর বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে ২৪ মে. টন চাউল ও ৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ শুকনা খাবর বিতরণ করেছেন।
গতকাল যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা যায়। সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর ও তাড়াশ উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি। এদিকে যমুনার প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণাবাতে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে এনায়েতপুরের সলিড ¯পার ও রিং বাঁধের প্রায় ২শ মিটার এলাকা। হুমকির মুখে উপমহাদেশের বৃহৎ এনায়েতপুর হাসপাতাল ও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েক হাজার ঘর-বাড়ী। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে পানি গত ২৪ ঘণ্টায় দুই সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে গত ১২ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি না পেয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এদিকে জেলা জুড়ে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে যমুনার ভাঙন অব্যহত রয়েছে। বন্যার পানিতে জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় সিরাজগঞ্জ জেলার দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় দুই লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। কাজিপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নেই অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কাজিপুরের মেঘাই-সোনামুখী আঞ্চলিক সড়কের ধারে বন্যার পানি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। নদীর পানি আর সামান্য বাড়লেই এই সড়কে পানি উঠতে পারে বলে এলাকাবাসী জানায়। এই সড়কে পানি উঠলে কাজিপুর থেকে বগুড়া যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষ তাদের সাধারন কাজকর্ম না করতে না পারায় কষ্টে জীবন যাপন করছে। বিশেষ করে ব্রক্ষ্মপূত্র বাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া মানুষ এখন বেশি কষ্টে রয়েছে। খাবার ও পানির অভাবের পাশাপাশি গবাদি পশু নিয়ে কোনো রকম তারা জীবন যাপন করছে। এখন পর্যন্ত তাদের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি বলে অভিযোগ করেছে বন্যা কবলিত মানুষ। এদিকে অব্যাহত পানির প্রবল চাপে বেলকুচি উপজেলার কয়েকটি গ্রাম এখন প্রচণ্ড ভাঙনের কবলে পড়েছে। এই উপজেলার আগুরিয়া, রান্ধুনীবাড়ি, হরিনাথপুর, আগুরিয়াচর, বিল মহিষা গ্রামগুলো এখন প্রচণ্ড ভাঙনের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে চৌহালী উপজেলার নদীতীরবর্তী অঞ্চলেও শুরু হয়েছে ভাঙন। এসব এলাকার মানুষ একদিকে ভাঙন অন্যদিকে বন্যার মধ্য পড়ে নাজেহাল অবস্থায় জীবন যাপন করছে।
কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধরলার পানি সামান্য কমলেও ১৬ সেন্টিমিটার বেড়েছে তিস্তার পানি। দুর্গত এলাকার প্রায় ৫০ হাজার পরিবার গত ৭ দিন ধরে পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন। বন্যায় তলিয়ে আছে জেলার নয় উপজেলার ৫০ ইউনিয়নের চর, দ্বীপচর ও গ্রাম। অনেক পরিবার উঁচু মাচা ও কলা গাছের ভেলায় অবস্থান নিয়ে দুর্বিসহ দিন পার করছে। এসব পরিবারের মাঝে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানি তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি সংকট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের। গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। কলা গাছের ভেলা ও নৌকাই তাদের এখন একমাত্র ভরসা। সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা না পাওয়া বানভাসী মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেক পরিবারের। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের আছিয়া বেগম জানান, গত শনিবার থেকে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। কোন মেম্বার চেয়ারম্যান এ পর্যন্ত খোঁজ নিল না। এদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ৩০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন, শাক-সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ জানান, বন্যার্তদের জন্য ১০০ মেট্রিক টন চাউল ও এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ মেট্রিক টন চাউল ও নগদ ৭০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আরো বরাদ্ধ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান জানায়, গত ২৪ ঘন্টায় চিলমারী ব্রহ্মপুত্রের পানি সাত সেন্টিমিটার হ্রাস পেলেও এখনও বিপদসীমার চার সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা বেড়ে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সরকারি সহযোহিতা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ দুর্যোগ কবলিত এসব মানুষ। প্রথম দফা বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই রংপুরে দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। নতুন করে পানি বেড়ে যাওয়ায় তিস্তা তীরবর্তী গংগাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বেড়েছে নদীভাঙ্গন।
এদিকে আবহাওয়া অফিস আগামী পাঁচ দিনের আবহাওয়া বার্তায় ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে। তার মানে আরো কিছু নদীর পানি বৃদ্ধি পাবে এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।