Connecting You with the Truth

ভিক্ষুকদের ভিক্ষাবৃত্তি প্রসঙ্গে

এড বাবুল রবিদাস:
ভিক্ষাবৃত্তি কখন কোন সময় হতে প্রচলিত বা শুরু হয়েছে তার কোন সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় যে, মানুষ যখন মৌলিক অধিকার বা চাহিয়া পূরণে ব্যর্থ হয়েই লজ্জা শরম ত্যাগ করে পেটের দায়ে বঞ্চিত এক মানুষ অন্য মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য প্রার্থনা করাকেই সাধারণ ভাষায় ভিক্ষুক (ইবমমধৎ) বলে। ভিক্ষুকদের কোন কোন ভাষায় ফকির, মিসকিন, কাংগাল বা নিঃস্ব ব্যক্তি বলা হয়। একারণেই সম্ভবত ইংরেজী ভাষায় বলা হয় A beggar begs from door to door.

তাদের মধ্যে দেখা যায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পঙ্গু, অক্ষম, অন্ধ, বিকলাঙ্গ বা শারীরিকভাবে অক্ষম এতিম ব্যক্তিদের। অর্থাৎ যারা সম্পদ অর্জন করতে পারে না বা নিজের ও পরিবারের ভরন পোষন বহন করতেও পারে না তাদেরকেই ভিক্ষুক বলে গন্য করা যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে-এক শ্রেণীর পাষন্ড মানবতা বহির্ভূত হৃদয়হীন মানুষ ভাল মানুষকে অপহরণ করে ভিক্ষাবৃত্তি করিয়ে অর্থ উপার্জন করে। বিভিন্ন সিনেমা, নাটকে দেখা যায় ঐ সকল হৃদয়হীন নিম্নমানের ব্যবসায়ীগণ নাবালক সন্তানদের সাবালকদের ধরে অঙ্গহানী করে রাস্তায় ভিক্ষা করায়।

এছাড়া আমরা বিগত পত্র পত্রিকায় দেখেছি যে, লালমনিরহাট জেলায় ‘ভিক্ষুক সম্মেলন’। এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার উপ মন্ত্রী আহসান হাবিব দুলু। পৃথিবীতে আর কোথাও নজির আছে কিনা জানা নেই। তবে এ প্রসঙ্গে মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাহিনীটি মনে পড়ে গেল-কাহিনীটি নিম্নরুপঃ

একজন ভিক্ষুক এসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে ভিক্ষা চান। তিনি বলেন তোমার কি কোন সম্বল আছে? ভিক্ষুক বললেন আমার একটি কম্বল আছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার কম্বল আনতে বললেন। কম্বলটি বিক্রয় করে দিয়ে সেই অর্থ দিয়ে একটি কুড়াল ক্রয় করে দিলেন। আর উপদেশ দিলেন বন হতে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রয় করে যে অর্থ পাবে, সেই অর্থ দিয়েই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করবে। পরবর্তীতে বাস্তবে দেখা গেল উক্ত উপদেশ পালনের ফলে ভিক্ষুকের আর কোন অভাব থাকলো না। ভিক্ষুক ভিক্ষা থেকে বিরত থাকলো। এভাইে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

ভিক্ষুকদের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ ও টিভি সংবাদ পাঠে দেখা যায়। প্রকৃত পক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর সংবিধানে আমরা দেখি যে, “মৌলিক অধিকার” এর কথা উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ যে জিনিসগুলো না হলে জীবন অচলের মতো হয়। যেমন-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, মৌলিক অধিকার গুলোর মধ্যে অন্ন খাদ্য, বস্ত্র (কাপড়-চোড়র) না পেলেই মানুষ ক্ষুধায় কাতর হয়ে পরে এবং কাপড় ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারেনা।

এসকল ভিক্ষুকেরা খাদ্যের জন্য বা কাপড়ের জন্য পথে পথে সাহায্য সহযোগিতার করুণভাবে সহানুভুতির আবেদন করে। দয়ালু ব্যক্তিরা নিঃস্ব ব্যক্তিদের টাকা পয়সা এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি দান করে থাকেন। দান গ্রহিতাকারীরাই মূলতঃ ভিক্ষুক বলে সমাজে চিহ্নিত, উপেক্ষিতে ও নিন্দিত। ভিক্ষুকদের সাথে আমাদের সমাজ জীবনে যে ব্যবহার করা হয় তাহা ‘মানুষ’ কবিতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভিক্ষুকদের সাথে আমাদের সমাজে মানুষের আচার আচরণের কথা তুলে ধরেছেন। তার ‘মানুষ’- কবিতার মধ্যে পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠেছে যে, আমাদের সমাজে ভিক্ষুক বা নিঃস্ব ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভুতি না দেখিয়ে তাদের প্রতি খারাপ আচরণ করা হয়। তাই কবি নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন যেমন পূজারী দুয়ার খোল, ক্ষুধার ঠাকুর দাড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো! স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয় দেবতার বরে আজ রাজা টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয়! জীর্ণ-বস্ত্র, শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ-ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনি তো সাত দিন!’ সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভুখারি ফিরিয়া চলে, তিমিররাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে! ভূখারি ফুকারি’ কয়, ‘ঐ মন্দির পুজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়! পক্ষান্তরে আরও লিখেছেন মসজিদে কাল শিরনি ছিল-অঢেল গোস্ত রুটি বাঁছিয়া গিয়াছে মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি, এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন বলে, বাবা আমি ভুখা আছি আজ নিয়ে নিয়ে সাত দিন! তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা ভ্যালা হলো দেখি ল্যঠা, ভুখা আছ মর গো-ভাগারে গিয়ে নমাজ পরিস বেটা ? ভুখারি কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল-‘তা হলে শালা সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়ে মসজিদে দিল তালা। ভূখারি ফিরিয়া চলে, চলিতে চলিতে বলে আশিটা বছর কেটে গেল আমি ডাকিনি তোমায় কভূ, আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করেনি প্রভূ।

আমরা জানি মানুষের জীবনে উত্থান পতন আসে। নদীর এক কূল ভাঙ্গে আর অপর কূল গড়ে। ভিক্ষুকেরাও আমাদের সমাজের মানুষ। তাদের প্রতি ঘৃনা নয়, অত্যন্ত সহানুভূতির মাধ্যমে দেখা দরকার। তাদের মৌলিক অধিকার দিয়ে বিকশিত করে তুলতে হবে। তারাও দেশের নাগরিক, ভোট প্রদান করেন। তাই তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে বলে অনেক সুধী জনই তা মনে করেন। এই ভিক্ষা বৃত্তি দূরীকরণের জন্য নিম্নলিখিত উপায়ে ভিক্ষুক সমস্যা সমাধানকল্পে পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

১। প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে সর্ব প্রথমে প্রকৃত ভিক্ষুকদের তালিকা তৈরী করতে হবে। প্রথা ভিত্তিক, মহল্লা ভিত্তিক, ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রকৃত গরীব, ফকির, মিছকিনদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। তবে দেখা যাবে যখনই তালিকা তৈরী করার কাজ চলছে তখনই ধিরে ধিরে ভিক্ষুকদের খাতায় নাম তালিকাভুক্ত হোক তা চাবেনা। যার ফলে যারা ছদ্মবেশে ভিক্ষা করে তাঁরা ধরা পরে যাবে।

২। আর একটি নিয়ম চালু করা যায়। তালিকা অনুযায়ী এলাকা ভিত্তিক ফকির বা ভিক্ষুককে ভিক্ষা প্রদান করতে হবে এবং আলাদা বা অঞ্চলের ফকির অন্য এলাকায় যেতে পারবেনা। প্রয়োজনে হলে সরকার কর্তৃক আইন প্রনয়ন করে এলাকা ভিত্তিক ভিক্ষার অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে বাস্তবে দেখা যায় ভিক্ষুকেরা নিজেরাই অলিখিত ভাবে মৌখিক তালিকা তৈরী করেছে। তার ফলে প্রকৃত ভিক্ষুকেরা যার যার এলাকা ভিত্তিক ভিক্ষা করে।

৩। উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আপনা আপনি ভিক্ষুকের সংখ্যা কমে যাবে। যখন ভিক্ষুকের সংখ্যা কমে যাবে তখন সমস্যা সমাধান করতে সহজ হবে, ছদ্মবেশী ভিক্ষুকেরা ধরা পরে যাবে।

৪। এক জরীপ থেকে জানা গেছে অনেকে ছদ্মবেশে অন্য এলাকায় অথবা অন্য জেলায় গিয়ে ভিক্ষা করে। তারপর একটি কাপড় চোপড় পরে নিজ গ্রামে এসে প্রকাশ করে সে চাকুরী করে। এই ভাবে ছদ্মবেশে অনেকেই ভিক্ষা বৃত্তিকে বেছে নেয়।

৫। আমাদের দেশে যেরুপ রাজনীতিকে ব্যবসা হিসাবে অনেকেই বেছে নিয়েছে তদরুপ পাশাপাশি ভিক্ষা বৃত্তিকেও অনেকে বেছে নিয়েছে। রাজনীতিতে যদি এরুপ ব্যবস্থা থাকতো রাষ্ট্রে বিজ্ঞান পরে জ্ঞান চর্চার করে রাজনীতি করতে হবে। তৎপর শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়সসীমা ইত্যাদি নিয়ম কানুন থাকলে রাজনীতিতে এতো বেশী লোকের ভীড় দেখা যেত না। যে সে রাজনীতি করতো না। তখন উচ্চ শিক্ষিত রাষ্ট্রে বিজ্ঞানের উপর ডিগ্রীধারী জ্ঞানীগুনি বয়স্ক লোকের আবির্ভাব হত। তদরুপ প্রকৃত ফকিরের তালিকা তৈরী করে ভিক্ষুক কমাতে হবে। সখ করে অথবা ব্যবসা হিসাবে অথবা ছদ্ম বেশে কেউ আর ভিক্ষাবৃত্তিতে আসবে না। ফলে ভিক্ষুকের সংখ্যা কমে যেত এবং তাদের সমস্যা সমাধান করতে সহজ হতো।

৬। সরকারিভাবে, বেসরকারী ভাবে বিভিন্ন এনজিও এর মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য সাহায্য সহানুভুতির প্রয়োজন আছে। সুদ মুক্ত ক্ষুদ্র লোনের মাধ্যমে ও ভিক্ষা বৃত্তি হতে মানুষকে ফিরিয়ে আনা যায়।

৭। ভিক্ষুকদের কল্যানে শিল্প ও কলকারখানার স্থাপন করে তথায় তাদের বিভিন্ন চাকুরী দিয়ে ও ভিক্ষা বৃত্তি দমন করা যেতে পারে।

৮। সরকারী খাস জমি ও রেলওয়ের পরিত্যাক্ত জমি ও পতিত আবাদযোগ্য ভূমি বা জমি ভিক্ষুকদের মধ্যে বন্টন করা যেতে পারে এবং তা হবে তালিকা ভিত্তিক ভিক্ষুকদের মধ্যে।

৯। আমরা জানি মানুষ শুধু পেট নিয়ে জন্ময় না-তাদের সাথে হাত পা ও জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে। কাজেই ভিক্ষুকদের কর্মঠ করে তৈরী করতে হবে। ভিক্ষা করতে করতে তারা অলস হয়ে পড়ে। সেই অভ্যাস হতে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। চিত্ত বিনোদন, বিভিন্ন এলাকায় সফর ও অন্যান্য পদ্ধতিতে তাদের কর্মমুখী করতে হবে। ভিক্ষা বৃত্তির উপর তাদের যেন আর নেশা না থাকে সেই ভাবে তৈরী করতে হবে। নিজের শক্তি বলে চলার মধ্যে যে সাধ আছে তা তাদের বুঝার মত মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। কর্মের মধ্যে থাকতে যেন তারা আনন্দ পায় সেইভাবে গড়ে তুলতে হবে। অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানায় যেন পরিণত না হয়।

১০। যারা প্রকৃত ভিক্ষার ফকির তারা নিজ এলাকায় থাকবে। অন্য এলাকায় যেতে পারবে না। এ আইন বলবৎ করতে হবে। ধনী দানশীল ব্যক্তিরা যেন নিজ নিজ এলাকার ফকির ব্যতিত অন্য এলাকার ফকিরদের ভিক্ষা প্রদান না করে এবং নিজ নিজ এলাকায় যেন শিল্প কারখানা তৈরী করে তালিকাভুক্ত ভিক্ষুকদের চাকুরী বাকুরী কাজ কর্মের ব্যবস্থা করে দেয়।

১১। আমাদের অবশ্যই ভিক্ষুক পরিবারকে সাহায্য প্রদান করে নিয়ন্ত্রন করতে হবে।

১২। সচ্ছল, অবস্থাশালী ধনী ব্যক্তিরা যে সাহায্য প্রদান করে থাকে।

মতামত- উক্ত সাহায্য প্রদান যেন তালিকাভুক্ত প্রকৃত ভিক্ষুকদের মধ্যে ব্যয় করা হয় এবং ধনী ব্যক্তিরা যেন সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন ফার্ম, কল কারখানা স্থাপন করে প্রকৃত অভাবী ভিক্ষুকদের চাকুরীতে নিয়োগ প্রদান করেন এমন ব্যবস্থা করতে হবে। ভিক্ষুক কোন বিশেষ ধর্মের ভেতর থেকে সৃষ্টি হয়না-ভিক্ষুক সর্ব দলীয় সর্ব ধর্মীয়, সকল শ্রেণীর হতে পারে। তাই নিরপেক্ষ ভাবে তাদের মঙ্গল এবং দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য সমবেত ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভিক্ষুক সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।

লেখক: এডভোকেট

Comments
Loading...