ভূ-মধ্যসাগরের মাল্টা উপকূলে পাঁচশ অভিবাসীবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয় দালালচক্র
প্রিয় মানুষের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, পরিবারে খানিকটা স্বচ্ছলতা ফেরানোর পাহাড়সম আশা বুকে বেঁধে সহস্র মাইল পাড়ি দিয়ে ভিনদেশে পাড়ি জমান অনেকে। এই পথ কখনোই সুগম হয় না।
বৈধ উপায়ে বিদেশযাত্রাটা খানিকটা স্বস্তির হলেও একেবারেই অনেকবেশি বিপদসঙ্কুল হতদরিদ্রদের অবৈধযাত্রা, বিশেষত দালাল বা পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়ে যারা দারিদ্র্য জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সুদূরে পাড়ি জমাতে চান।
প্রায়শঃই খবরে আসে, নৌকা বা ট্রলারযোগে উত্তর আফ্রিকার কোনো দেশ থেকে ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ, কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ থেকে বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশে রওয়ানা হন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষেরা।
কিন্তু এসব যাত্রার বেশিরভাগই অশুভ হয়। উপকূল পার না হতেই ঘটে নৌকা বা ট্রলারডুবির ঘটনা কিংবা যানটি যখন তীর ভিড়বে তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। আর এতে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সলিল সমাধি ঘটে অজুত সহস্র স্বপ্নেরও।
কিন্তু স্বপ্নের কি আসলে সমাধি ঘটে? নাকি ঘটানো হয়? হাজারো অভিবাসীর প্রাণহানি ঘটে? নাকি ঘটানো হয়?
এমন ‘ঘটানো’ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু মানুষকে উদ্ধৃত করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) দিয়েছে উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর।
আইওএম জানাচ্ছে, খবরে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাইয়ের কারণে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবির তথ্য দেওয়া হলেও মূল খবর অন্য। দালাল বা পাচারকারীচক্রই অর্থ সংক্রান্ত বিতর্কের জের ধরে শতো স্বপ্নবাজবাহী নৌকাগুলো ডুবিয়ে দেয়।
সংস্থাটির মুখপাত্র ক্রিস্টিয়ানে বার্থিউমে বলেন, অর্থ সংক্রান্ত বিতর্কের জের ধরে গত বুধবার ভূ-মধ্যসাগরের মাল্টা উপকূলে অভিবাসীবাহী একটি নৌকা ডুবিয়ে দেয় দালালচক্র।
ওই নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া দুই ফিলিস্তিনিকে উদ্ধৃত করে বার্থিউমে জানান, নৌকায় পাঁচশ’র মতো যাত্রী থাকলেও মাত্র নয় জন বাঁচতে পেরেছেন বলে জানা গেছে।
আইওএম’র আরেক মুখপাত্র লিওনার্দ দোয়লে বলেন, যদি এ তথ্য সত্য হয় তবে এটা চলতি বছরের সবচেয়ে বড় নৌযান দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিবৃতিতে দোয়লে বলেন, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, সেটা নৌকাডুবি ছিল না। অসহায় অভিবাসীদের কাছ থেকে অর্থ লুটে নেওয়ার পর দালালচক্র ইচ্ছাকৃতভাবে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়।
ওই দুর্ঘটনার পর ইতালির সিসিলি কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা বেশ কিছু লোককে উদ্ধার করেছে এবং ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।
আইওএম জানায়, সম্প্রতি ইউরোপগামী আরও একটি নৌকা লিবিয়া উপকূলে ডুবে যায়। নৌকাটিতে ২৫০ জন যাত্রী ছিলেন, যাদের বেশিরভাগেরই প্রাণহানি হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে পৃথক নৌকাডুবির ঘটনায় আরও প্রায় ৭০০ লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এই রুটটিতে যে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে তাতে চলতি বছরই নৌ দুর্ঘটনার সবরকম রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ২০১৩ সালে যেখানে অভিবাসীবাহী নৌকাডুবিতে মাত্র ৬০০ লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল সেখানে ২০১৪ সালে এখন পর্যন্ত ২৯০০ লোকের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র আদ্রিয়ান এডওয়ার্ডস বলেন, দুর্ঘটনাগুলোর তদন্ত করছে শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা। তবে, মাল্টা উপকূলে নৌকাটির ভাগ্যে কী ঘটেছে সেটি এখনও অস্পষ্ট।
মিশরের দামিয়েত্তা বন্দর এলাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ওই নৌকার যাত্রীদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া দুই ফিলিস্তিনি ইউএনএইচসিআরকে জানান, দালালচক্র তাদের হিউম্যান কার্গো থেকে ক্ষুদ্রাকৃতির নৌকায় বসতে নির্দেশ।
কিন্তু অভিবাসীরা ওসব ছোটো নৌকায় উঠতে প্রত্যাখ্যান করলে পাচারকারীরা জোরজবরদস্তি করে তাদের উঠিয়ে দেয়। এরপর অর্থকড়ি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আরও বেশি উত্তপ্ত হলে দালালচক্র বড় একটি নৌযান দিয়ে নৌকাটি চাপা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়।
ডুবে যাওয়া ওই নৌকার অভিবাসীরা ফিলিস্তিনি, সুদানি ও মিশরীয় ছিলেন। কিন্তু খোদ মিশরীয় পত্রিকাসহ সংবাদ মাধ্যমগুলোতে দুর্ঘটনার খবর এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এ ধরনের নৌকাডুবিতে অভিবাসীর প্রাণহানির ঘটনা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে ইতালিসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার।
এ লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মাল্টার ভালেত্তায় দেখা করেছেন হাইকমিশনার অ্যান্তোনিও গুটেরেস ও জাতিসংঘের বিশেষ দূত অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।