Connect with us

সাহিত্য

মানব সম্বন্ধের দেবতা

Avatar photo

Published

on

thakurরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: এই সংসারে একটা জিনিস অস্বীকার করতে পারি নে যে, আমরা বিধানের বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের জীবন, আমাদের অস্তিত্ব বিশ্বনিয়মের দ্বারা দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। এ-সমস্ত নিয়মকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করতেই হবে, নইলে নিষ্কৃতি নেই। নিয়মকে যে পরিমাণে জানি ও মানি সেই পরিমাণেই স্বাস্থ্য পাই, স¤পদ পাই, ঐশ্বর্য পাই। কিন্তু জীবনে একটা সত্য আছে যা এই নিয়মের মধ্যে আপনাকে দেখতে পায় না। কেননা, নিয়মের মধ্যে পাই বন্ধন, আত্মার মধ্যে চাই সম্বন্ধকে। বন্ধন এক-তরফা, সম্বন্ধে দুই পক্ষের সমান যোগ। যদি বলি বিশ্বব্যাপারে আমার আত্মার কোনো অসীম সম্বন্ধের ক্ষেত্র নেই, শুধু কতকগুলি বাহ্যসম্পর্কসূত্রেই সে ক্ষণকালের জন্য জড়িত তা হলে জানব তার মধ্যে যে একটি গভীর ধর্ম আছে নিখিলের মধ্যে তার কোনো নিত্যকালীন সাড়া নেই। কেননা, তার মধ্যে যা আছে তা কেবল সত্তার নিয়ম নয়, সত্তার আনন্দ। এই যে তার আনন্দ এ কি কেবল সংকীর্ণভাবে তারই মধ্যে। অসীমের মধ্যে কোথাও তার প্রতিষ্ঠা নেই? এর সত্যটা তা হলে কোন্খানে। সত্যকে আমরা একের মধ্যে খুঁজি। হাত থেকে লাঠি পড়ে গেল, গাছ থেকে ফল পড়ল, পাহাড়ের উপর থেকে ঝরনা নীচে নেমে এল, এ-সমস্ত ঘটনাকে যেই এক তত্ত্বের মধ্যে দেখতে পেলে অমনি মানুষের মন বললে সত্যকে দেখেছি। যতক্ষণ এই ঘটনাগুলি আমাদের কাছে বিচ্ছিন্ন ততক্ষণ আমাদের কাছে তারা নিরর্থক। তাই বৈজ্ঞানিক বলেন, তথ্যগুলি বহু, কিন্তু তারা সত্য হয়েছে অবিচ্ছিন্ন ঐক্যে।
এই তো গেল বস্তুরাজ্যের নিয়মক্ষেত্র, কিন্তু অধ্যাত্মরাজ্যের আনন্দক্ষেত্রে কি এই ঐক্যতত্ত্বের কোনো স্থান নেই।
আমরা আনন্দ পাই বন্ধুতে, সন্তানে, প্রকৃতির সৌন্দর্যে। এগুলি ঘটনার দিক থেকে বহু, কিন্তু কোনো অসীম সত্যে কি এদের চরম ঐক্য নেই। এ প্রশ্নের উত্তর বৈজ্ঞানিক দেন না, দেন সাধক। তিনি বলেন, বেদাহমেতম্, আমি যে এঁকে দেখেছি, রসো বৈ সঃ, তিনি যে রসের স্বরূপ তিনি যে পরিপূর্ণ আনন্দ। নিয়মের বিধাতাকে তো পদে পদেই দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ঋষি যাঁকে বলছেন সনো বন্ধুর্জনিতা, কে সেই বন্ধু, কে সেই পিতা। যিনি সত্যদ্রষ্টা তিনি হৃদা মনীষা মনসা সকল বন্ধুর ভিতর দিয়ে সেই এক বন্ধুকে, সকল পিতার মধ্য দিয়ে সেই এক পিতাকে দেখছেন। বৈজ্ঞানিকের উত্তরে প্রশ্নের যেটুকু বাকি থাকে তার উত্তর তিনিই দেন। তখন আত্মা বলে, আমার জগৎকে পেলুম, আমি বাঁচলুম। আমাদের অন্তরাত্মার এই প্রশ্নের উত্তর যাঁরা দিয়েছেন তাঁদেরই মধ্যে একজনের নাম যিশু খৃষ্ট। তিনি বলেছেন, আমি পুত্র, পুত্রের মধ্যেই পিতার আবির্ভাব। পুত্রের সঙ্গে পিতার শুধু কার্যকারণের যোগ নয়, পুত্রে পিতারই আত্মস্বরূপের প্রকাশ। খৃষ্ট বলেছেন, আমাতে তিনি আছেন, প্রেমিক-প্রেমিকা যেমন বলতে পারে আমাদের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। অন্তরের সম্বন্ধ যেখানে নিবিড়, বিশুদ্ধ, সেখানেই এমন কথা বলতে পারা যায়; সেখানেই মহাসাধক বলেন, পিতাতে আমাতে একাÍতা। এ কথাটি নূতন না হতে পারে, এ বাণী হয়তো আরো অনেকে বলেছেন। কিন্তু যে বাণী সফল হল জীবনের ক্ষেত্রে, নানা ফল ফলালো, তাকে নমস্কার করি। খৃষ্ট বলেছিলেন, আমার মধ্যে আমার পিতারই প্রকাশ। এই ভাবের কথা ভারতবর্ষেও উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু সেটি শাস্ত্রবচনের সীমানা উত্তীর্ণ হয়ে প্রাণের সীমায় যতক্ষণ না পৌঁছয় ততক্ষণ সে কথা বন্ধ্যা। যতই বড়ো ভাষায় তাকে স্বীকার করি ব্যবহারের দৈন্যে তাকে ততই বড়ো আকারে অপমানিত করি। খৃষ্টান সম্প্রদায় পদে পদে তা করে থাকেন। কথার বেলায় যাকে তারা বলে, প্রভু, সেবার বেলায় তাকে দেয় ফাঁকি। সত্য কথার দাম দিতে হয় সত্য সেবাতেই। যদি সেই দিকেই দৃষ্টি রাখি তবে বলতে হয় যে, খৃষ্টের জন্ম ব্যর্থ হয়েছে; বলতে হয়, ফুল ফুটেছে সুন্দর, তার মাধুর্য উপভোগ করেছি, কিন্তু পরিণামে তাতে ফল ধরল না। এ দিকে চোখে দেখেছি বটে হিংসা রিপুর প্রাবল্য খৃষ্টীয় সমাজে। তৎসত্ত্বেও মানুষের প্রতি প্রেম, লোকহিতের জন্য আত্মত্যাগ খৃষ্টীয় সমাজে সাফল্য দেখিয়েছে এ কথাটি সাম্প্রদায়িকতার মোহে পড়ে যদি না মানি তবে সত্যকেই অস্বীকার করা হবে। খৃষ্টানের ধর্মবুদ্ধি প্রতিদিন বলছে মানুষের মধ্যে ভগবানের সেবা করো, তাঁর নৈবেদ্য নিরন্নের অন্নথালিতে, বস্ত্রহীনের দেহে। এই কথাটিই খৃষ্টধর্মের বড়ো কথা। খৃষ্টানরা বিশ্বাস করেন খৃষ্ট আপন মানবজন্মের মধ্যে ভগবান ও মানবের একাত্মা প্রতিপন্ন করেছেন।
ধনী তাঁর গ্রামের লোকের জলাভাবকে উপেক্ষা করে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা দিলেন পুত্রের অন্নপ্রাশনে দেবমন্দিরে দেবপ্রতিমার গলায় রতœহার পরাতে। এই কথাটি তাঁর হৃদয়ে পৌঁছয় নি যে, যেখানে সূর্যের তেজ সেখানে দীপশিখা আনা মূঢ়তা, যেখানে গভীর সমুদ্র সেখানে জলগণ্ডূষ দেওয়া বালকোচিত। অথচ মানুষের তৃষ্ণার মধ্য দিয়ে ভগবান যে জল চাইছেন সে চাওয়া অতি ¯পষ্ট, অতি তীব্র; সেই চাওয়ার প্রতি বধির হয়ে এরা দেবালয়ে রতœালংকারের জোগান দেয়।
পুত্রের মধ্যে পিতাকে বিড়ম্বিত করে দানের দ্বারা তাঁকে ভোলাবার চেষ্টায় মানুষ তাঁকে দ্বিগুণ অপমানিত করতে থাকে। দেখেছি ধনী মহিলা পাণ্ডার দুই পা সোনার মোহর দিয়ে ঢাকা দিয়ে মনে করেছে স্বর্গে পৌঁছবার পূরা মাশুল চুকিয়ে দেওয়া হল; অথচ সেই মোহরের জন্য দেবতা যেখানে কাঙাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মানুষের প্রতি দৃষ্টিই পড়ল না।
আজ প্রাতে আমাদের আশ্রমবন্ধু অ্যানড্রুজের চিঠি পেলুম। তিনি যে কাজ করতে গেছেন সে তাঁর আÍীয়স্বজনের কাজ নয়, বরং তাদের প্রতিকূল। বাহ্যত যারা তাঁর অনাÍীয়, যারা তাঁর স্বজাতীয় নয়, তাদের জন্য তিনি কঠিন দুঃখ সইছেন, স্বজাতীয়দের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম করে দুঃখপীড়া পাচ্ছেন। এবার সেখানে যাবা মাত্র তিনি দেখলেন বসন্তমারীতে বহু ভারতীয় পীড়িত, মৃত্যুগ্রস্ত; তাঁর কাজ হল তাদের সেবা করা। মারীর মধ্যে ভারতীয় বণিক্দের এই যে তিনি সেবা করেছেন, এতে কিসে তাঁকে বল দিয়েছে। মানবসন্তানের সেবায় বিশ্বপিতার সেবার উপদেশ খৃষ্টানদেশের মধ্যে এতকাল ধরে এত গভীররূপে প্রবেশ করেছে যে সেখানে আজ যাঁরা নিজেকে নাস্তিক বলে প্রচার করেন তাঁদেরও নাড়ির রক্তে এই বাণী বহমান। তাঁরাও মানুষের জন্য প্রাণান্তকর দুঃখ স্বীকার করাকে আপন ধর্ম বলে প্রমাণ করেছেন। এ ফল কোন্ বৃক্ষে ফলল। কে এতে রসসঞ্চার করে। এ প্রশ্নের উত্তরে এ কথা অস্বীকার করতে পারি নে যে, সে খৃষ্টধর্ম।
লক্ষ্যে অলক্ষ্যে বিবিধ আকারে এই ধর্ম পশ্চিম মহাদেশে কাজ করছে। যাকে সেখানকার লোকে হিউম্যান ইন্টরেস্ট অর্থাৎ মানবের প্রতি ঔৎসুক্য বলে তা জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপে যেমন জাগরূক তেমন আর কোথাও দেখি নি। সে দেশে সর্বত্রই মানুষকে সেখানকার লোকে স¤পূর্ণরূপে চেনবার জন্য তথ্য অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে। যারা নরমাংস খায় তাদেরও মধ্যে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তুমি মানুষ, তুমি কী কর, তুমি কী ভাব। আর আমরা? আমাদের পাশের লোকেরও খবর নিই নে। তাদের সম্বন্ধে না আছে কৌতূহল, না আছে শ্রদ্ধা। উপেক্ষা ও অবজ্ঞার কুহেলিকায় আচ্ছন্ন করে দিয়ে অধিকাংশ প্রতিবেশীর সম্বন্ধে অজ্ঞান হয়ে আছি। কেন এমন হয়। মানুষকে যথোচিত মূল্য দিই নে বলেই আজকের দিনে আমাদের এই দুর্দশা। খৃষ্ট বাঁচিয়েছেন পৃথিবীর অনেককে, বাঁচিয়েছেন মানুষের ঔদাসীন্য থেকে মানুষকে। আজকে যারা তাঁর নাম নেয় না, তাঁকে অপমান করতেও কুণ্ঠিত হয় না, তারাও তাঁর সে বাণীকে কোনো-না-কোনো আকারে গ্রহণ করেছে।
মানুষ যে বহুমূল্য, তার সেবাতেই যে ভগবানের সেবা সার্থক, এই কথা ইউরোপ যেখানে মানে নি সেখানেই সে মার খেয়েছে। এ কথার মূল্য যে পরিমাণে ইউরোপ দিয়েছে সেই পরিমাণেই সে উন্নত হয়েছে। মানুষের প্রতি খৃষ্টধর্ম যে অসীম শ্রদ্ধা জাগরূক করেছে আমরা যেন নিরভিমানচিত্তে তাকে গ্রহণ করি এবং যে মহাপুরুষ সে সত্যের প্রচার করেছিলেন তাঁকে প্রণাম করি।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

প্রবন্ধ

কবিতা: বাংলা সাহিত্যের দ্রৌপদী

Avatar photo

Published

on

সবুজ ভট্টাচার্য্য
শিরোনাম দেখে যদি কারো চোখ শিরে উঠে বসে, তাহলে তার জন্য লেখককে দোষারোপ করা যাবেনা। সার্বিক ধারনায় দ্রৌপদী যাঁর নিকট পরিচিত, তার নিকট শিরোনামের শিরচ্ছেদ করার কোনো প্রয়োজন আপাত দৃষ্টিতে নেই। তবে সূর্যদয়ের সময়ে যে কবিজাতী রাতের ঘুমের ব্যবস্থা করেন তাদের ভাবোদয়েও সূর্যাস্তের সময় হয়ে যায়। শিরোনামের উদ্দেশ্য উপসংহারে প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করছি।

পল্লিকবি জসিমউদ্দীন একান্ত নিজস্ব কোনো এক দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছিলেন, “সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি।” আলোচনা সমালোচনার কোনো কমতি হয়নি এর পর। যুগের পর যুগ ধরে চলতে লাগলো এ নিঃসীম আলোচনা। এই আলোচিত আলোচনার আলোচ্য বিষয়ের উপর জোড় দিতে পরিশেষে কিনা কবি শামসুর রাহমানও ঐ সমালোচকদের দলে যোগ দিলেন! তবে তিনি সমালোচনার নামে সমান ভাবে আলোচনা না করেই বলে বসলেন “যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।” তবে কবি যে, পক্ষে গিয়ে গেয়েছেন বিপক্ষের গান তা আমরা টের পাইনি। কবি যে ‘ইচ্ছে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তার শাব্দিক অর্থ, ভাবার্থ এবং কাব্যিক অর্থ সম্পুর্ণই ভিন্ন। ভাবার্থে কবি পছন্দ-অপছন্দের কথা বললেও, কাব্যিক অর্থে তিনি কবির বাকস্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক সিদ্ধান্তের উপর জোরারোপ করেছেন। কবিতাকে তিনি দিয়েছেন মতামত প্রকাশের সর্বোত্তম স্থান। তাই তিনি বলেছিলেন তাঁর কবিতার খাতায় তিনি যেমন ইচ্ছে তেমন লিখবেন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে নয়।

তাং: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রিয় প্রধান শিক্ষক, মাত্রাহীন উচ্চ বিদ্যালয়, কল্পনানগর, ছন্দখালি।
আশা করি ভালো আছেন কিন্তু আমি তো ভালো নেই। তবে আজ একটু ভালো বোধ করছি বলেই বিদ্যালয়ে এলাম। গত দুই দিন প্রলাপবাক্য বকেছি জ্বরের প্রতাপে। (মা বলেছেন, গণিত শিক্ষক স্নেহোত্তর চক্রবর্তী- কে প্রলাপকালিন আলাপে অশ্রাব্য গালিও দিয়েছি।)
অতএব, মহোদয় নিকট সবিনয় বিনীত নিবেদন এই যে, গণিত শিক্ষক স্নেহোত্তর চক্রবর্তীর স্নেহহীন শাসন এবং আমার শারীরিক অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে গত দু’দিন ছুটি দানে বাধিত করবেন।
নিবেদক
অষ্টম শ্রেণির খ শাখার নিয়মিত ছাত্র
“অকবি নাথ দুর্যোধন”

এখন হয়তো এটাই মূখ্য প্রশ্ন যে, এটা আদৌ কি ধরনের পত্র। আরে মশাই বুঝতেই তো পারছেন এটা আবেদনপত্র। শতভাবে বুঝালেও আপনি বলবেন এটি আবেদনপত্র হয়নি। কারন জানতে চাইলেও বড় একটা নিয়মনীতির তালিকা আমার হাতে ধরিয়ে দেয়া হতে পারে। কিন্তু কি এমন ভুল আছে এতে? তারিখের ক্ষেত্রে ইংরেজি মাসের নাম বাংলায় বানান করে লেখার চেয়ে এই তো ঢের ভালো ছিলো। নামের পরে প্রধান শিক্ষকের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ঠিকানাসহ তো দেয়াই হয়েছে। আর এ আবেদন তো উনি নিজেই পরবেন। তাই ওনাকে ওনার অবস্থান বিস্তারিত জানাতে আমি নারাজ; উনি নিজেই এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। শিক্ষক- ছাত্রের এতো মধুর একটা সম্পর্কের মাঝে প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ নামের ফরমালিটি কতটা সুন্দর দেখায় বা তার প্রভাবটাও বা কতটা ভালো, সে প্রশ্ন আমি রাখতেই পারি। কিন্তু পরিশেষে সবাই জাতীয় জোট বেঁধে এটাই প্রমাণ করবেন যে এটা আবেদনপত্রের নিয়মে পরেনি। তার মানে নিয়মের বাইরে দুটো শব্দ বা প্রদত্ত তথ্যের ভুল অবস্থানে যদি একে আবেদনপত্রের শ্রেণীচ্যুত করা হয় তাহলে পূর্বের আলোচনায় ফিরে যাওয়াটা আমার নিকট খুবই সহজ হয়।

হ্যাঁ, পল্লিকবি যথার্থই ভলেছেন। সবাই মোটেও কবি নন। আর কবি শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার সংবিধানে যে ধারা লিখে গেছেন তাতে শুধুমাত্র কি বিষয়ে লিখবো বা লিখবোনা তার ইচ্ছে বা স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে উপধারা প্রদত্ত হবার দরকার ছিলো অনেক বেশি।

তিনটি বাহু ত্রিকোনী অবস্থায় অবস্থান করা স্বত্বেও তাকে জ্যামিতিক ভাষায় ত্রিভুজ বলা যাবেনা যতক্ষণ না পর্যন্ত ঐ তিনটি বাহু পরস্পর যুক্ত হয়ে একটি আবদ্ধ ক্ষেত্র তৈরি না করে। ঠিক একইভাবে কবিতা বিষয়টাকে এতটা সহজ করে দেখলে হবেনা। কবিতার মাঝেও থাকতে হবে ছন্দ-মাত্রা এর শক্ত বাঁধন। যে বাঁধন তাকে দাঁড় করাবে উন্নত কবিতার কাতারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে স্বঘোষিত কবিদের স্বরচিত কবিতাগুলো যত দেখি ততই বর্তমান কবিদের পূর্বপুরুষদের কথা ভেবে চোখে জল আসে। এটাই চিন্তার শিরে উঠে বসে যে কি পরিমান কষ্টই না তারা করেছিলেন ছন্দ-মাত্রা ঠিক রাখতে। আমার এটা ভেবেও কষ্ট হয় যে, কি পরিমান কাগজ-কালি যে তাঁরা নষ্ট করেছিলেন শুধু এই ভেবে যে, তাঁর লেখা কবিতাটি কোনো এক চরনে/স্তবকে মাত্রাভ্রম/ছন্দভ্রম হয়েছে। তাঁরা ছন্দের বাঁধনে বাঁধতে গিয়ে মাত্রা ব্যবহারের যে নিম্নমাত্রা থেকে উচ্চমাত্রায় উঠানামা করতেন হয়তো তার গল্প শুধু ঐ দোয়াতকলম আর ময়লার স্তুপে জমায়িত কাগজের খন্ডিত টুকরো গুলোই জানে। জ্ঞানের জোড়ে হারাতে না পারলেও বুদ্ধির জোরে অত্যাধুনিক কবিরা তাঁদের শুধু হারিয়ে দিয়েছে বললেও ভীষণ ভুল হবে। বরং এটা বললেই ভালো হবে যে, অত্যাধুনিক কবিরা এই কথাই প্রমান করে ছেড়েছেন যে, “আবেগেটাই মূখ্য, ছন্দ-মাত্রা গৌন বিষয়।” অতি আবেগে মানুষ ভাষা হারিয়ে ফেলে; এসব কবিরা তো মাত্র মাত্রা আর ছন্দ হারিয়েছেন। যাই হোক, তাদের কবিতার খাতায় তারা কিভাবে কি লিখবেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই; সমস্যা শুধু তখনই হয় যখন দেখি এসব কবিতা কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই স্বজনপ্রিতির কোমল জালে আবদ্ধ সংবাদপত্রসমূহের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। তারাও কি তবে বলবেন, “যেমন ইচ্ছে ছাপানোর আমার সাহিত্যের পাতা।”

কবিতা লেখাটাকে যতটা সহজ করা হবে, ততটাই গ্রহণ যোগ্যতা পাবে, তবে হারাবে তার রাজকীয় অবস্থান ছন্দে শেখা কবিতাগুলো বৃদ্ধ বয়সেও মনে থাকে বাঁধনের জোড়েই।

কথায় আছে ‘‘স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’’ বাঙ্গালি অত্যাধুনিক কবিরা স্বাধীনতা অর্জন করেনি, দখল করেছে তবে তাও রক্ষা করতে পারবে কি না বেশ সন্দেহ। স্বাধীনতার প্রগারতা এতটা বেশি হয়ে গেছে যে, ‘কবিতা’ কে আমরা রাজ দরবারে রাখতে নারাজ আর তাই আজ আমরা ‘কবিতা’কে বর্তমান সাহিত্য বাজারের সস্তা পণ্যে পরিণত করেছি; যে চায় সেই কিনতে পারে। কবিতা লেখাটা বাঙ্গালি কবির মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। আমি কারো অধিকার হরণ করার কথা কলছিনা। তবে কোনো গদ্যকে খন্ডিত করে মাঝ পথে স্পেসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে অহেতুক স্তবকের আবর্তন ঘটিয়ে তাকে কবিতা দাবী করাটা মোটেও মানতে পারিনা। তবে স্ব স্ব সাহিত্য সভায় স্বরচিত সাহিত্য গৃহিত না হলে বর্তমান কবিরা স্বেচ্ছায় সভা ত্যাগ করেন আর এই ভয়ে অন্য কবিরাও তাতে “কেয়া বাত, কেয়া বাত” বলে বহ্বা দিয়ে বসেন।

বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বাজারে এই সহজ উৎপাদন পদ্ধতির কারনে সর্বজনস্বীকৃত সহজপ্রাপ্য কবিতা হারিয়েছে তার রাজবেস, রাজমুকুট ছেড়ে হয়েছে আজ জটাধারী পাগল। আর আমরা সেই জটাধাধারী পাগলের জটাকে জ্ঞানের ঘণিভূত অবস্থা ভেবে সন্যাসী রূপে পুজো করছি।
কোনো এক সময়ে বোধ হয় কবি শামশুর রহমান নিজেও টের পেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই মিথ্যে আলোর ঝকমকির আড়ালে লুকিয়ে থাখা বাংলা কাব্যের অন্ধকার যুগ। তাই হয়তো বারকার বলেছিলেন “রাত পোহাতে কত দেরি পাঞ্জেরী?” এই রাত বাংলা সাহিত্যের কাব্য জগতের অন্ধকার রাত। আমি বলছিনা কবিতা লিখতে হলে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করতে হবে। মহান কবিদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার স্বীকৃতি ছিলোনা তবে ধ্বনিতত্বের যে বাধনে তারা আপন ইচ্ছেয় নিজেদের বন্দি রেখেছিলেন তার কারনেই এখনো আমরা বাংলা সাহিত্য নিয়ে গর্ব করি।

নিয়মিত কিছু শব্দের অনিয়মিত প্রয়োগ ঘটিয়ে যে কবিদল বাংলা সাহিত্যকে রাজ মুকুট পড়ালেন, তাদের উত্তরসুরীরা জীবনের অনিয়মিত কিছু শব্দের নিয়মিত প্রয়োগ ঘটিয়ে ভাবছেন এই শব্দবৃষ্টিই হলো কাব্য সাগর। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রাথমিক কিছু ধারনা থাকা বাঞ্চনীয়। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতেই হয় অন্তত ‘‘অক্ষর”, ‘‘মাত্রা”, ‘‘মুক্তাক্ষর”, ‘‘বদ্ধাক্ষর বা যুক্তাক্ষর”, ‘‘পর্ব”, ‘‘অতিপর্ব” ইত্যাদি সম্পর্কে ন্যুনতম ধারনা থাকা উচিত।

অক্ষর
সাধারণ ভাবে আমরা বুঝি, প্রতিটি বর্ণই একেকটি অক্ষর/’সিলেবল’ (Syllable)। কিন্তু, বাংলা ব্যকরণের ভাষায় তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। আমরা জানি, মানুষ কোন শব্দ উচ্চারণ করার সময়, একবারে যত গুলো কম সংখ্যক বর্ণ উচ্চারণ করে, তাদের একেকটিকে একেকটি অক্ষর বলে। চলুন, আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি। এর জন্য আমি ‘‘কলম” শব্দটি বাছাই করলাম। খেয়াল করে দেখুন, ‘‘কলম’’ শব্দটি আমরা দুই ভাগ করে উচ্চারণ করছি ‘‘ক”, ‘‘লম্” এভাবে। শুধুমাত্র ‘‘কলম” শব্দটিই নয়, প্রতিটি শব্দই, আমরা এমন ভাগ ভাগ করেই উচ্চারণ করি। আর এই প্রতিটি ভাগই হল একেকটি অক্ষর। তাহলে, চলুন আমরা মাত্রা শিখে ফেলি।

মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর
যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে, তখন তাকে মুক্তাক্ষর/ওপেন সিলেবল (Open Syllable) বলে। যেমন, ‘‘কলম” শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি অক্ষর ‘‘ক’’, ‘‘লম্’’ পাওয়া যায়। এতে, ‘‘ক” একাই একটি অক্ষর, সুতরাং এটি মুক্তাক্ষর।
এবার, যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তাকে বদ্ধাক্ষর/ক্লোজড সিলেবল (Closed Syllable) বলে। সুতরাং, ‘‘কলম” এর ‘‘লম্’’ হল বদ্ধাক্ষর। এখন, একটি বড় শব্দের ক্ষেত্রে বোঝানোর চেষ্টা করি। যেমন, প্রত্যুৎপন্নমতি = প্রত্, তুৎ, পন্, ন, ম, তি। এখানে, ন, ম, তি এই তিনটি মুক্তাক্ষর এবং প্রত্, তুৎ, পন্, এই তিনটি বদ্ধাক্ষর। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
যে সব সিলেবল উচ্চারণের সময়মুখের ভেতর প্রবাহমান বাতাস জিভের দেয়ালে আটকে যায়তাদের ক্লোজড সিলেবল বলা হয়। যেমন : দাগ্, ভাগ্, ঘুষ্, হাঁস্, ঝাঁক্, আজ্, থাক্, কাল্, দিন্, চিন্, কই, ইত্যাদি।
যে সব সিলেবল উচ্চারণের সময়মুখের ভেতর প্রবহমান বাতাস জিভের দেয়ালের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের ওপেন সিলেবল বলে। যেমন: জা, ঝা, ছা, গু, চা, দি, দা, বা, বু ইত্যাদি।

পর্ব ও অতিপর্ব
এবার পর্ব নিযয়ে আলোচনা শুরু করছি। পর্বের সংজ্ঞা অনেকটা অক্ষরের মতই। এক নিঃশ্বাসে যতগুলো কম সংখ্যক শব্দ একবারে পড়া যায়, তাদের সমষ্টি হল একটি পর্ব। যেমন,
ঐ খানে তোর / দাদির কবর /
ডালিম গাছের / তলে /
যখন, একটি শব্দ নিয়ে একটি পর্ব বুঝাবে, তখন তাকে আমরা অতিপর্ব বলব। সুতরাং, এখানে ‘‘তলে” হল, অতিপর্ব। একে অপূর্ণ পর্বও বলা যেতে পারে। এখন চলুন আমরা আরেকটি কবিতা দেখি,
এই নেয়েছে / ঐ নিল যাঃ / কান নিয়েছে / চিলে /
চিলের পিছে / মরছি ঘুরে / আমরা সবাই / মিলে /
নিশ্চই বুঝতে পারছেন, ‘‘চিলে” এবং ‘‘মিলে” হল অতিপর্ব, বাকি গুলো পর্ব। সুতরাং, এই দুটি লাইনে ছয়টি পর্ব এবং দুইটি অতিপর্ব আছে।

ছন্দ
বাংলা কবিতার তিন ছন্দ সনাতনী ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। কবিতার উৎকৃষ্টতার জন্যে ছন্দ একমাত্র উপজিব্য না হলেও এটি যে প্রধানতম একটি দিক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিল্প সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, কবিতা, সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই তাল-লয়-সুর ইত্যাদির সংমিশ্রণে ভাষার মালা হয়ে মানুষের মনে দোলা দিয়ে আসছে। অক্ষর ও শব্দের নানামুখি চালে এই মালা তৈরীর প্রক্রিয়া বা নিয়মই আদতে ছন্দ।

এবার চলুন ভিন্ন ছন্দের বিশ্লেষনে আমারা মাত্রা সম্পর্কে জানার নিমিত্তে শব্দের শরীরের ভেতরে অক্ষরকে/সিলেবলকে খুঁজি।
উত্তম = উত্+তম্
(এখানে দুটিই ক্লোজড সিলেবল।)
জাঝা = জা+ঝা
(এখানে দুটিই ওপেন সিলেবল।)
বাহুবন্ধন = বা+হু+বন্+ধন্
(এখানে ‘বা’ ও ‘হু’ ওপেন সিলেবল কিন্তু ‘বন্’ ও ‘ধন্’ ক্লোজড সিলেবল।)
যুক্তাক্ষও = যুক্+তাক্+খর্
(এখানে তিনটিই ক্লোজড সিলেবল।)
ভিন্ন ছন্দে মাত্রা
অক্ষরবৃত্ত এর ক্ষেত্রে ওপেন সিলেবল সবসময়পাবে ১ মাত্রা। তবে শব্দের শুরুতে কিম্বা মধ্যে থাকলে ক্লোজড সিলেবল পাবে ১ মাত্রা, শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা।
যেমন-
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যায়দণ্ড’)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
চিত্ত যেথা/ ভয়শূন্য/ উচ্চ যেথা/ শির/
চিত্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ ভ(১)য়(১)শূন্(১)নো(১),/ উচ্(১)চো(১) যে(১)থা(১)/ শির্(২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।
জ্ঞান যেথা/ মুক্ত, যেথা/ গৃহের প্রা/চীর
জ্ঞা(১)ন(১) যে(১)থা(১)/ মুক্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ গৃ(১)হের্(২) প্রা(১)/ চীর্র (২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।

মাত্রাবৃত্ত এর ক্ষেত্রে ওপেন সিলেবল সবসময় পাবে ১ মাত্রা আর ক্লোজড সিলেবল পাবে ২ মাত্রা।
যেমন
ধনুকের মতো টংকার দিলো টাকা
তোমার উষ্ণ লাল কিংখাবে ঢাকা
(শহীদ কাদরী, প্রেমিকের গান)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
ধনুকের মতো/ টংকার দিলো/ টাকা/
ধ(১)নু(১)কের্(২) ম(১)তো(১)/ টং(২)কার্(২) দি(১)লো(১)/টা(১)কা(১)
দুইটি সম্পূর্ণ পর্ব ও একটি অতিপর্বে মাত্রাবৃত্তের ৬+৬+২ চাল।
তোমার উষ্ণ/ লাল কিংখাবে/ ঢাকা/
তো(১)মার্(২) উষ্(২) নো(১)/ লাল্(২) কিং(২)খা(১)বে(১)/ ঢা(১)কা(১)/
অর্থাৎ, ৬+৬+২ চাল।

স্বরবৃত্ত এর জন্য ওপেন, ক্লোজড উভয়সিলেবলই পাবে ১ মাত্রা।
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয়পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।
(আল মাহমুদ, ‘পাখির মতো’)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
তোমরা যখন/ শিখছো পড়া/
তোম্(১)রা(১) য(১)খন্(১)/ শিখ্(১)ছো(১) প(১)ড়া(১)/
অর্থাৎ ৪+৪ চাল।
মানুষ হওয়ার/ জন্য,/
মা(১)নুষ্(১) হও(১)য়ার্র(১) জন্(১)নো(১)/
অর্থাৎ, ৪+২ চাল।
আমি না হয়পাখিই হবো,
আ(১)মি(১) না(১)হয়্(১)/ পা(১)খিই(১) হ(১)বো(১)/
অর্থাৎ ৪+৪ চাল।
পাখির মতো বন্য।
পা(১)খির্(১) ম(১)তো(১)/ বন্(১)নো(১)/
অর্থাৎ, ৪+২ চাল।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে, আমি গদ্যছন্দের কথা ভূলে গেছি। কিন্তু খেয়ালের দরুন আমাদের বেখায়ালী মনে যে বোধটির উদয় হতে পারে তা হলো, গদ্য ছন্দে লেখা কবিতারও শব্দ সমূহের মধ্যে আভ্যন্তরীয় সম্পর্ক এবং সুরের প্রবাহ থাকে।
যেমন- “ যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না” বলেই আদালতে আমরা “মিথ্যাসভা” এর উদ্ভোধনী ফিতা কাটি আর জমিয়ে রাখা কথার জাবর কাটি। অথ্যাধুনিক কবিরাও তাই তাদের ব্যর্থ চরনের ভ্রান্তি ঢাকতে কবিতার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। তবে তাঁরা চাইলে অনশনও করতে পারেন; তাতে বাংলারই মঙ্গল।
অনেকের মাঝে আবার একটি ভ্রান্ত প্রবাহের বিভ্রান্ত কবিতাকুল মনোভাব দেখা যায়; তারা মনে করেন দূর্বোধ্য কিছু শব্দের পাশাপাশি অবস্থানেই সৃষ্টি হয় অমর কবিতা। কাব্য জগতকে অমর করতে গিয়ে যে তারা কাব্যের জন্যেই কবর কুড়ে বসেন তাতে পাঠক সমাজ খুবই মর্মাহত হয়ে কবিতাকে অন্য গ্রহের ভাষা মনে করেন।

যদি কেউ লেখেন,
মনগোলাপের পাপড়িমাল্যে সুবাসচাদরের ক্রিয়ামূল
শুভ্রসকালে উথিত সূর্য!
মালিরূপ মন, আবেগের জল-
থামিল বাগান দুয়ারে
(কালপনিক কবিতা)

কোনো সাধারন পাঠককে যদি বলি কবি ‘বিখ্যাতবিমল রায়’-এর এই অখ্যাত কবিতাটি সাপ্তাহিক ‘অবিবেচিত’ পত্রিকার তথাকথিত সাহিত্য সাময়ীকিতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে বলে বসবেন, “বাহ! খ্বুই সুন্দর” অথচ উপরিউক্ত কবিতাটি বিন্দুমাত্র না ভেবে শুধুমাত্র কিছু অপরিচিত রূপক শব্দের পাশাপাশি অবস্থান। যা কবিতার ‘ক’ তেও নয় ‘তা’ তেও নয়, ‘বি’ তে এসে বিশ্রিভাবে বিনষ্ট হয়েছে।
এবার সমাপ্তি রেখা টানতেই হয়। অতি নিয়মে খেলার আনন্দ মাটি হয় বলে যে, কোনো নিয়ম ছাড়াই আমরা খেলায় মাতবো এটা কেমন কথা? নিয়মের অভাবেই যত দ্বন্দের উৎপত্তি। তাই সার্বিক ধারনা মাথায় নিয়েই কলমের আঁচর খাতায় দেয়া উচিৎ।

“কবিতা” রাজদরবারের বিষয় বলে আমি তার গন্ডিকে চারদেয়ালের মাঝে রাখতে রাজি নই। তবে এও আমার চাহিদা নয় যে, তাকে আমি পথের ধুলিতে পরিণত করবো। আমি চাই কবিতাকে আমরা রাজদরবারের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকরূপ প্রজাদের মাঝে নিয়ে আসবো কিন্তু তার স্বাদে কোনো ভিন্নতা থাকবেনা।

তাই কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বাংলা কবিতাকে বাংলা সাহিত্যের দ্রোপদী বলে আক্ষ্যায়িত করা। আমার এই কাল্পনিক কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধন একজন নয়, হাজারে দুর্যোধন একইসাথে যে পাশা খোলায় মেতেছে, তার পরিণতীতে আমাদের অমর কবিরাই পঞ্চপান্ডব হয়ে বনবাসে চলে যাবে। খেলা শেষে চারপাশ থেকে ছুটে আসছে অগণিত দুর্যোধনের হাত আর তারা যেমন ইচ্ছে তেমন করেই বাংলার এই দ্রোপদীর ক্রমাগত বস্ত্রহরণ করছে। আমাদের সন্তানরা হয়তো তা পুথি হিসেবে পড়বে।

পরিশেষে অত্যাধুনিক কবিদের কাছে করজোর প্রার্থনা যেমন ইচ্ছে তেমন বিষয় নিয়ে লিখুন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে নয়।

লেখক : গবেষক, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

Continue Reading

কবিতা

কবিতা: ছুটে এসে মিশে যাও

Avatar photo

Published

on

ছুটে এসে মিশে যাও
প্রকাশ চন্দ্র রায়

ক্যামন করে তোমার হস্তগত হলাম,
ক্যামন করে পৌঁছলাম এসে যৌবনের ঘাটে,
কোনদিকে পালালো বাল্য-কৈশোর আমার
জানি না তা! জানি না সঠিকভাবে!
যৌবনের ডালে ফুল ফুটেছে,
বসন্ত এসে ভর করেছে দেহ-মনে;
ক্ষণে ক্ষণে এখন মনে জাগে কেবল
তোমাকে কাছে পাওয়ার অতল আকুলতা।
সুস্মিতা! সামান্য ক্ষণের ছোঁয়া-ছুঁয়িতে
আর অনধিক কালের আলিঙ্গনে,
তুমি আমাকে উন্মাদিত এক প্রেমিক বানালে।
প্রাসঙ্গিক ভাবনার ব্যূহ ভেদ করে
তোমার ভাবনারা’ই এখন উঁকিঝুঁকি মারে
অপ্রাসঙ্গিকভাবে মস্তিস্কের মণিকোটরে।
এভাবে কতদিন!কতক্ষণ আর সহ্যের সীমানায়
পুষে রাখা যায় অম্লমধুর স্বাদের অমলিন যাতনাকে।
যমযাতনা’র অবসান কল্পে তুমি আসছ না কেন ছুটে?
আমি তো বুক পেতে রেখেছিই অহর্নিশি
তোমাকে আপনার করে রেখে দেবার ছলে।
কেন যে হারালো বাল্য-কৈশোর!
কেন যে আসলো উন্মত্ত যৌবন!
কেন যে তোমার সান্নিধ্য-সুখ পেলাম যৌবনের ঘাটে!
এখন আর দিন কাটে না-রাত কাটে না!
অচেনা আতঙ্কে বয়ে চলছে অস্থির সময়।
সুস্মিতা!তুমি ছুটে এসে মিশে যাও আমার আত্মায়-সত্ত্বায়;
নইলে আমার প্রাণ যায় প্রাণ যায়।

রচনাকাল- ৭ আগস্ট ২০২১, শনিবার।

Continue Reading

কবিতা

পান্ডুলিপির কবিতা- সাইফ সাত্তার

Avatar photo

Published

on

পান্ডুলিপির কবিতা
সাইফ সাত্তার

আসুন, এই চক্রান্তকারী সন্ধ্যায় চায়ের লিকারের মতো
ব্যক্তিগত ব্যার্থতায় চুমুক দিই।

সিগ্রেটে আগুন দেবার আগে মনে করার চেষ্টা করি-
আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে অসহ্য অগ্নিঝড়।
আর রাতেই আমরা ঘরে ফিরবো।

দরজায় অপেক্ষমান অন্ধকারের মুখোশ পরে আমাদের স্ত্রীগণ জেগে থাকবেন-
আগামী বছরের প্রতিশ্রুতি পূরণের আশায় এক সাথে ঘুমিয়ে পড়বেন দুজন।

শ্রবনবিদ্ধ শব্দের ভেতর তবুও জেগে থেকে আমি (যেহেতু পুরুষ)
সেহেতু ঘরের মধ্যে আমিই দন্ডিত বৃক্ষ।
আমার সক্ষম ছায়ায় বেড়ে উঠবে আমার ভবিষ্যত

রমনীময় হয়ে উঠবে আগামী বছর।
একটা সূক্ষ্ণ লিলেনের জামা
বাবুটার স্কুলের টিফিনে একটা অরেঞ্জকেক
একজোড়া সিটি গোল্ডের রিং
বাতাসে আমাদের স্ত্রীগণের হাসির মতো দুলে উঠবে।

আমি জানি, এই দেশ তাঁর সর্বস্হটুকু হারিয়ে ফেলেছে রাজনীতির মধ্যে-
রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে।

প্রথম প্রেমিকের জন্য স্ত্রীরা যা হারিয়েছে
তা তাদের অলৌকিক বিস্ময়।

আসুন, এসব ব্যক্তিগত আগামী বছরগুলো
আমরা বিনিময় করি।
মনেরাখি, ফার্মের ডিমের মতো পৃথিবীটা গোলাকার।
আর সেখানে কমলালেবুর সংজ্ঞাটা
প্রমানিত রাজনীতির মতো!

বিডিপত্র/সাহিত্য

Continue Reading