Connect with us

মতামত

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা নাকি করোনা বাজার?

Avatar photo

Published

on

নোভেল করোনা তথা কভিড-১৯ নামক ভাইরাস জ¦রে জর্জরিত প্রায় তামাম দুনিয়া। ইতোমধ্যে চীনের উহান শহর থেকে উৎপত্তি অদৃশ্য করোনাঘাতে মানবতার শহর ইতালিকে বাঁচার আকুতি নিয়ে আকাশপানে কাঁদতে দেখছে বিশ্ববাসী। বিধ্বস্ত হয়েছে বাণিজ্যিক শহর চীন। করোনা রোধে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে মেডিসিনের শহর সুইজারল্যান্ড। নিরূপায়ত্ব দেখিয়েছে প্রযুক্তির শহর জার্মান। দিশাহারা ক্ষমতার দেশ আমেরিকা, নিঃসঙ্গ শক্তিধর কানাডা, বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না ব্রিটিশের দেশ ইংল্যান্ড। নিস্তব্ধ অস্ত্রের রাজাখ্যাত রাসিয়া-ফ্রান্স। টালমাটালবস্থায় রক্ষণশীল সৌদি-ইরান-ইরাক-পাকিস্তান। করোনার ধাক্কায় বেদশায় নিমজ্জিত পোশাকের আমাদের বাংলাদেশ।

বলা যায়, হঠাৎ কে যেনো থামিয়ে দিল চলমান বিশ্বকে। অবস্থায় এমন যে, করোনার আঘাত থেকে রেহাই পেতে পারমাণবিক অস্ত্রের বাহাদুরি ফিকে। বিজ্ঞান ব্যর্থ। সভ্যতার আস্ফালন স্তমিত। ক্ষমতার দম্ভ পরাজিত। ফলে এগিয়ে যাওয়ার বিশ্ব যেনো চলছে এখন ব্যাক গিয়ারে! করোনা রোধে টীকা আবিষ্কারেও মুক্তির শতভাগ নিরাপদ পথ রুদ্ধ হওয়ায় আকাশের নিচের মানবক্ষমতার সকল কারামতি শেষ। একমাত্র আকাশে উপরের অধিপতির নিকট প্রার্থনা, হে জগত মালিক তুমি আমাদের উপর সহায় হও।

মহামারি করোনার এমন ভয়াবহ ছোঁবল থেকে আদম সন্তানকে বাঁচাবার একটিই উপায় হিসেবে চারিদিকে চাউর হচ্ছে ‘দূরত্ব থিওরি’। অর্থাৎ ‘দূরত্ব’ বজায় রাখা। মূলত একজন অপরজনের সাথে মধ্যকার নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করা। বিশ্বের সব দেশই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আবিষ্কারকৃত ‘দূরত্ব’ থিওরিটি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে চলছে। বাংলাদেশে বিশেষ করে করোনার প্রতিকারে টেলিভিশনে টকশোসহ পত্র-পত্রিকায় ওই ‘দূরত্ব’ থিওরিটি ব্যাপক আকারে আলোকপাত করা হচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার ছবি এঁকে এবং রাস্তায় দাগ কেটে দূরত্বের সংজ্ঞা সম্পর্কে জনতাকে অবহিত করছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, দূরত্ব থিওরিটার গোড়ায় গলদ পরিলক্ষিত। মূলত হওয়ার দরকার ছিল ‘শারীরিক দূরত্ব’। তা না হয়ে বলা হচ্ছে, ‘সামাজিক দূরত্ব’! অথচ সংকটকালে একদিকে প্রয়োজন সামাজিক নৈকট্য বিধান। শেষাবধি এ দূরত্ব থিওরিটির উননেও লেজেগোবরে পরিণত হচ্ছে। কেননা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ থাকলেও নির্বাচনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হরহামেশাই চলছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া করোনা ভাইরাসটি আর কোথাও বিস্তার করতে পারে না! যার জলজ্যান্ত উদাহরণ মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আগামী ২এপ্রিল এমবিবিএস ও ৩০শে এপ্রিল বিডিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কথা রয়েছে।

করোনা ঝুঁকির মধ্যেই ২০২০-২১ সালের শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ২ এপ্রিল। তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হার বেড়ে গেলে তারিখ পেছাতে পারে বলে গত ১৩ মার্চ স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়।

করোনার ঝুঁকি নিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে চান না এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। সেকারণেই ২ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা পেছানোর দাবি তুলেছেন তারা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি শেষ হয়নি। যারা ভর্তি পরীক্ষা দেবেন তাদের ভ্যাকসিনও দেয়া হয়নি। এ ছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আগামী ঈদের পর নেয়া হবে। সেখানে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা নিতে কেনো এত তাড়াহুড়ো? তবে, ২ এপ্রিলের পূর্বে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা হয় তাহলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে রাজি বলেও জানান তারা।

উল্লেখ্য, রাজধানীসহ দেশের ১৯টি কেন্দ্রের ৫৫টি ভেন্যুতে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এবার রেকর্ডসংখ্যক এক লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন। গত বছর আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৭২ হাজারেরও কম। ১৯টি কেন্দ্রে ভেন্যুর সংখ্যা ছিল ২৭টি। তবে করোনার কারণে এবার ভেন্যুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ পরীক্ষার হলে শারীরিক দূরত্ব মেনে আসনবিন্যাস করার কথা রয়েছে। বর্তমানে সরকারিভাবে পরিচালিত মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭টি। এগুলোতে মোট আসন সংখ্যা চার হাজার ৩৫০। এ বছর এক লাখ ২২ হাজার ৮৭৪টি আবেদনের হিসাবে আসনপ্রতি লড়বেন ২৮ জন।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, গত ১৯ মার্চ করোনা সংক্রমণ বাড়ার মধ্যেই ৪১তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পরীক্ষায় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষর্থী অংশ নেন। সেখানেও যেনো করোনা আঘাত হানতে হিম্মত দেখায়নি! দেশে করোনার সংক্রমণের হার যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন বিসিএস পরীক্ষা হলে আক্রান্তের হার বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা করে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন অনেক প্রার্থী। একদল পরীক্ষা স্থগিত চেয়ে আদালতে রিটও করেছিলেন। তবে, হাইকোর্ট সেই রিট খারিজ করে দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা আয়োজন করতে পিএসসিকে নির্দেশ দেন।

গত ১৭ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মিনি কনফারেন্স রুমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও বর্তমানে করণীয় সম্পর্কে এক জরুরি সভায় পাবলিক পরীক্ষা বন্ধসহ ১২টি নির্দেশনা পালন করতে সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

নির্দেশনাগুলো হলো: ১. সম্ভব হলে কমপ্লিট লকডাউনে যেতে হবে। সম্ভব না হলে ইকোনমিক ব্যালান্স রেখে যেকোনো জনসমাগম বন্ধ করতে হবে। ২. কাঁচা বাজার, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, শপিংমল, মসজিদ, রাজনৈতিক সমাগম, ভোট অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, পবিত্র রমজান মাসের ইফতার মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠান সীমিত করতে হবে। ৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেগুলো বন্ধ আছে সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে। অন্যান্য কার্যক্রম সীমিত রাখতে হবে। ৪. যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা (বিসিএস, এসএসসি, এইচএসসি, মাদ্রাসা, দখিলসহ অন্যান্য) বন্ধ রাখতে হবে। ৫. কোভিড পজিটিভ রোগীদের আইসোলেশন জোরদার করতে হবে। ৬. যারা রোগীদের কন্ট্রাকে আসবে তাদের কঠোর কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে, ৭. বিদেশ থেকে বা প্রবাসী যারা আসবেন তাদের ১৪ দিনের কঠোর কেয়ারেন্টিনে রাখা এবং এ ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর সহায়তা নেওয়া, ৮. আগামী ঈদের ছুটি কমিয়ে আনা, ৯. স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আইন প্রয়োজনে জোরদার করা, ১০. পোর্ট অব এন্ট্রিতে জনবল বাড়ানোসহ মনিটরিং জোরদার করা, ১১. সব ধরনের সভা ভার্চুয়াল করা এবং ১২. পর্যটন এলাকায় চলাচল সীমিত করা।
এসব প্রস্তাবের পাশাপাশি কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও ৫টি প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন- ১. বইমেলা বাতিল করতে হবে, ২. বদ্ধস্থানে বা কক্ষে ইফতার পার্টি না করতে নির্দেশনা দিতে হবে, ৩. ঈদের ছুটি কমিয়ে ১ দিন করতে হবে, ৪. কক্সবাজারসহ পর্যটন এলাকায় যাতায়াত সীমিত করতে হবে, ৫. মসজিদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজের ব্যবস্থা করতে হবে।

সভায় আলোচিত ১২টি প্রস্তাবনার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র এবং রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নজমুল ইসলাম গণমাধ্যমে জানান, প্রস্তাবগুলো ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমে জানান, এই প্রস্তাবগুলো অবশ্যই ভালো। সংক্রমিত ব্যক্তিদের আইসোলেট করে রাখতে হবে। তারা নেগেটিভ হলে তবে ছাড়তে হবে। সামগ্রিকভাবে লকডাউন করা যাবে না।

দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকায় জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আগের মতো কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে আবারও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসবে। মাস্ক না পরলে-স্বাস্থ্যবিধি না মানলে জরিমানা করা হবে। এ বিষয়ে জেলা পর্যায়ে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে ইতোমধ্যে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত ১৩ মার্চ সারাদেশে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিতসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। উপসচিব মো. শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে সম্প্রতি করোনা সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হার গত কয়েক মাসের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবার মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বরের পর সংক্রমণের মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও চলতি মার্চের শুরু থেকে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার গত ১৫ মার্চ ৯ শতাংশ পেরিয়ে গেছে, যা দুই মাস আগে ৩ শতাংশের নিচে নেমেছিল। দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ শর ঘরে উঠেছে, যা এক মাস আগেও তিনশর ঘরে ছিল। দেশে করোনা শনাক্তের এক বছর পার হওয়ার পর দুই মাসের ব্যবধানে গত ১৭ মার্চ আবারও হাজারের ঘরে পৌঁছায় শনাক্তের সংখ্যা। এরপর থেকে করোনা শনাক্তের সংখ্যা হাজারের নিচে নামেনি। এর আগে ১৪ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১১৫৯ জনের করোনা শনাক্তের কথা জানিয়েছিল। ১৫ মার্চ শনাক্ত হয়েছিল ১৭৭৩ জন। এটি ছিল গত ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। শনাক্ত বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ১০০ নমুনায় ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত বিবেচনায় প্রতি ১০০ জনে সুস্থ্য হয়েছে ৯১ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং মৃত্যু হয়েছে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

অন্যদিকে, দেশে করোনার ৩৪টি নতুন রূপ ধরা পড়েছে এক গবেষণায়। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশে চার হাজার ৬০৪ বার মিউটেশন বা রূপ পরিবর্তন করেছে করোনা। এর মধ্যে ৩৪টি রূপ একেবারেই নতুন। অর্থাৎ পৃথিবীর আর কোনো দেশে এই রূপগুলো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের গবেষকরা মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যৌথভাবে ৩৭১টি জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ওই তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষকরা ভাইরাসের এই নতুন ৩৪টি রূপের নাম দিয়েছেন ‘বাংলা মিউটেশন’। এই রূপগুলোর বেশীরভাগই পাওয়া গেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে। এই তিন জেলার প্রত্যেকটিতে অন্তত তিনটি করে নতুন রূপ ধরা পড়েছে। করোনার চার হাজার ৬০৪টি রূপের মধ্যে সবচেয়ে বেশী রূপ পাওয়া গেছে চট্টগ্রামে। এই জেলায় পাওয়া করোনার পরিবর্তিত রূপগুলো সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ, ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া গেছে। দেশের অন্যান্য স্থানে পাওয়া রূপগুলোর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় মূলত ইউরোপের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদনান মান্নান, সহকারী অধ্যাপক মাহবুব হাসান এবং চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও বায়োটেকনোলজির সহকারী অধ্যাপক রাসেল দাশ ওই গবেষণার নেতৃত্ব দেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান এএমএএম জুনায়েদ সিদ্দিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এম মাহবুবুর রশীদ গবেষণা কাজে তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী হামিদ হোসেন ও নাজমুল হাসান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন, রাশেদুজ্জামান ও মেহেদী হাসান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে সহায়তা করেছেন। গত ২১ মার্চ এ-সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি নেদারল্যান্ডসের ‘এলসেভিয়ার’ ও ‘ভাইরাস রিসার্চ অব নেদারল্যান্ডস টুডে’ নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, ওই গবেষণাটি একটি নির্দেশিকার মতো। যার মাধ্যমে আরো গবেষণা করে জানা যাবে দেশে খুঁজে পাওয়া নতুন এই রূপগুলোর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতখানি। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বৃটেনে চিহ্নিত অতিসংক্রমণশীল করোনার ধরনটি বাংলাদেশে গত জানুয়ারিতেই প্রবেশ করে। এ ছাড়া আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের অতি সংক্রমণশীল ধরনসহ অন্তত ১২টি রূপ বাংলাদেশে বিদ্যমান বলে গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে। বৃটেন থেকে নতুন ধরনটি জানুয়ারিতে দেশে এলেও তা প্রকাশ হয় অতি সম্প্রতি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই তথ্য আগে প্রকাশ পেলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিল। দেশে আসা অতিসংক্রমণশীল ধরন ছড়িয়েছে কি-না তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, করোনার এমন ধরনের কারণেই হয়তো সম্প্রতি সংক্রমণ এবং মৃত্যু বেড়ে গেছে। আমরা বলতে চাই, করোনাকালীন যেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষাগুলো পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কী যুক্তিতে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের আয়োজন? ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, তাদের পরিবারও জড়িত। প্রতিটি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে পৌঁছে দিতে সাথে যদি অন্তত চারজন অভিভাবক পরীক্ষা কেন্দ্র এলাকায় হাজির হন, সেখানে শিক্ষার্থী ছাড়াই ৫ লক্ষাধিক অভিভাবকের সমাবেশ ঘটবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পর্বে কীভাবে সরকার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার মতো এত বড় এক পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবতে পারে? নাকি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে কি স্বাস্থ্যঝুঁকির বালাই নেই? ভাবতে অবাক লাগে যে, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা যেখানে অন্যসব পাবলিক পরীক্ষা জুনে হবে, সেখানে ৩ মাস আগে কেনো এ পরীক্ষার আয়োজন? নাকি সুস্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজন এখন আর নেই? আমরা মনে করি, অন্যসব পাবলিক পরীক্ষা যেসময় অনুষ্ঠিত হবে, ওই সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হোক। কারণ, ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে ভয়-ভীতিহীনভাবে নিরাপদে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের আয়োজনের বিকল্প নেই। নতুবা মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা হয়ে উঠতে পারে, নির্ভেজাল করোনা আমদানি করতেই করোনা বাজারে সহসাই প্রবেশ! সুতরাং, সাবধান ‘সাধু’।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

মতামত

সাঁওতালদের জন্য ‘‘অলচিকি লিপি ও রোমান লিপি’’ বিতর্কের অবসান প্রয়োজন

Avatar photo

Published

on

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৮৪ হাজার। সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আছে প্রায় ৪০টি। এগুলোর মধ্যে ৫টি দ্রাবিড়, ১৫টি চীনা তিব্বতি, ৯টি অস্ট্রো এশিয়াটিক, ১১টি ইন্দো-ইউরেপিয় ভাষা পরিবারভুক্ত। দেশের কত মানুষ মাতৃভাষা হিসাবে ঐসব ভাষা ব্যবহার করে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীখ্যায় কয়েকটি ভাষার জনগোষ্ঠী সংখ্যা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো-২৫টি ভাষায় কথা বলে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৭ জন। ৮টি গোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ কথা বলেন তাঁদের মাতৃভাষায়। ৪০টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন। যেমন বিপন্ন ভাষার মধ্যে রয়েছে প্রায় এক হাজার জনগোষ্ঠীর খারিয়া ভাষা। সৌরা ভাষা ব্যবহার করে প্রায় এক হাজার ব্যক্তি। কোড়া ভাষায় কথা বলে ২ হাজার ৮ শ ৪৩ জন। ৮ হাজার মানুষ ব্যবহারকরে মালতো ভাষা। খুমি ভাষায় কথা বলে ৩ হাজার ৬৬৯ জন। কন্দ ভাষাভাষি প্রায়৭০০ জন। পাংখো ভাষা ব্যবহার করে ২ হাজার ২৭৪ জন। চাক ভাষা ব্যবহারকারী ২ হাজার ৮৩৫ জন। প্রায় ৪ হাজার মানুষের কথ্য ভাষা খিয়াং/লালেং/ …ভাষায় কথা বলে ২হাজার ৩৩ জন। মাত্র ৯৫ জনের কথ্য ভাষা লুসাই। এছাড়া আরো এক তথ্যে জানা যায় ‘‘রেংমিটচ্য’’ ভাষা বলতে পারা ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠী মাত্র ছয়জন বেঁচে আছেন। বাংলাদেশে সাঁওতালী ভাষার হরফ নিয়ে খৃষ্টান ও নন-খৃষ্টান দ্বন্দ্বে আটকে আছে দীর্ঘকাল থেকে। সাঁওতাল এক গ্রুপ চান ‘বাংলা’ হরফ, অপর গ্রুপ চান রোমান হরফ এবং আরো এক গ্রুপ চান ‘‘অলচিকি’’ হরফ। ফলে সাঁওতালী ভাষার পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে আটকে আছে। এটা সাঁওতাল জাতির জন্য অমঙ্গলজনক ও বিভক্তির কারণও বটে। এমন সিদ্ধান্তে বলা যায় যে, নিম্নলিখিত হেতুবাদে ‘‘রোমান লিপি’’ (হরফ) চালু করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। কারণ রোমান হরফের সাথে ইংরেজি হরফের মিল আছে। বর্তমান যুগ জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তির যুগ। সকল কিছূ আবিস্কার হচ্ছে ইংরেজি মিডিয়ামে। আমি সামাজিক পেশাগত সুবিধার জন্য শিক্ষাদান, লেখালেখি, জ্ঞান চর্চায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করলে ভাল ফল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছাত্র-ছাত্রীরা করবে ভবিষ্যতে। কোন কোন যুক্তিতে ‘‘অলচিকি’’ ভাষা গ্রহণ যোগ্য নয়, তা ভারতের বিভিন্ন তথ্য থেকে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১। ‘‘অলচিকি’’ লিপি একটি মৌর্য যুগের ব্রাহ্মী লিপিমালা, গথিক লিপিমালা, দক্ষিণ ভারতীয় লিপিমালা ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত
২। অলচিকি লিপির উচ্চারণ প্রকৃত সানতালী বর্ণমালার উচ্চারণ নয়।
৩। সি.এস উপাসক লিখিত ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ গ্রন্থের।১৯১,২৪১,২৮৪,২৮৮,২৮৯,৩০৯ পৃষ্ঠায় দর্শিত লিপিমালার সঙ্গে অলচিকি লিপির হুবহু মিল আছে।
৪। গোথিক লিপিমালার ‘ডি’ এবং ‘পি’ প্রতিরূপ লিপি অলচিকি ‘ইর’ এবং‘ ই্ঞ’ লিপির হুুবহু মিল আছে।
৫। এল, ব্লুমফিল্ড এর ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে অবস্থিত চারটি লিপির সঙ্গে অলচিকি লিপির মিল দেখতে পাওয়া যায়।
৬। অবশিষ্ট অলচিকির লিপিগুলি দক্ষিণ ভারতীয় লিপিচিত্রের সঙ্গে অবিকল মিল দেখা যায়।
৭। রঘুনাথ মুরমু ‘দ্য’ হিস্ট্রি এ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি অফ মোরিয়ান ব্রাহ্মী স্ক্রিপ্ট’ ও অন্যান্য গ্রন্থের লিপিমালা থেকে অবৈজ্ঞানিকভাবে লিপি সংগ্রহ করেছেন এবং রোমান সানতালী ধারা ও চিহ্ন অনুকরণ করেছেন।
৮। অলচিকিতে ‘ক’ কে ‘আক্’, ‘জ’ ‘আজ্’, ‘ল’ কে ‘অল্’, ‘গ’ কে ‘অগ্’, ‘র’ কে ‘ইর’, ‘দ’ কে উদ্, ‘প’ কে ‘এপ্’, ‘ন’কে এন্’, ‘ত’ কে ‘অত্’, ‘ঙ’কে ‘অং’, ‘ম’কে ‘আম্’, ‘ঞ’ কে ‘ইঞ’ ইত্যাদি উচ্চারণ করা হয়।
৯। অলচিকি কোন ভাষা নয়, এটি একটি উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক লিপিমাত্র। সানতালদের মাতৃভাষা সানতালী, যা বহুকাল থেকে রোমান বাংলা দেবগণাগরী লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। অলচিকির আগে ও পরে ১৭ জন ব্যক্তি সানতালী ভাষার জন্য নিজ নিজ বিভিন্ন ধরণের লিপি অথবা অক্ষরগুলোকে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে ৪৭টি ধ্বণি আছে। এ জন্যে ৪৭টি অক্ষরের প্রয়োজন । কিন্তু ১৭ জন ব্যক্তির লিপিতে ৪৭ টি ধ্বনির জন্য ৪৭টি অক্ষন নেই। এছাড়া শুধু ঝাড়খন্ড বাসি শ্রী বাবুধন মুর্মু-এর ‘‘নাওয়া সানতালী আখর’’ বইতেই সানতালী ভাষাতে যতগুলি ধ্বনি আছে ততগুলো অক্ষরই তৈরী করেছেন। যদি আমরা অলচিকি লিপিকে গ্রহণ করি, তবে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র এবং উচ্চ শিক্ষিত সানতাল সমুদয় একই বিন্দুতে অর্থাৎ অ, আ, ক, খ স্তরেই আবদ্ধ হয়ে থাকবে। যদি উপরি লিখিত অক্ষরগুলো দ্বারা অথবা অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি হতে শুধু ১০০ (একশো) বছরই কেন ১০০০(এক হাজার) বছর পিছিয়ে যেতে হবে। অতএব মূল কথা হলো এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যের মানুষের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ স্থাপন এবং সানতালী ভাষা সাহিত্যের উন্নতি, শুধু রোমান লিপিতেই সম্ভব এবং আগেও হবে।
১০। ধ্বনি বিদ্যা অনুযায়ী সানতালী ভাষায় ৪৭টি ধ্বণি আছে। সানতালী ভাষা যথাযথভাবে প্রকাশের জন্য রোমান, বাংলা ও দেবনাগরী লিপিতে ৪৭টি পৃথক অক্ষর বর্তমান। কিন্তু অলচিকি বর্ণমালায় মাত্র ৩০টি অক্ষর আছে, যাতে ১৭টি অক্ষরের অভাব থাকায় অলচিকি অক্ষরের সানতালী ভাষা যথাযথভাবে লেখা যায় না। বানান ও উচ্চারণগত বিকৃতি ঘটে।
১১। অলচিকি বর্ণমালায় একটি ধ্বনিকেই দুইটি পৃথক অক্ষর দ্বারা এবং দুই টি পৃথক ধ্বনিকে একটি মাত্র অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ভাষাবিজ্ঞান বা ধ্বণিবিদ্যা সম্মত নয়।
১২। অবদমিত ব্যঞ্জন ধ্বণি ‘ক্’, ‘চ্’, ‘ত্’ (ৎ), ‘প্’-এর পরিবর্তে অলচিকিতে ‘গ’, ‘জ’, ‘দ’, ‘ব’ লেখা হয়। এতে উচ্চারণ নিরূপণে অবাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং ভাষার বিকৃতি ঘটেছে। (যেমন- ‘দাক্’ কে ‘দাগ্’, ‘লাচ্’ কে লাজ্’, ‘মেৎ’ কে ‘মেদ্’,‘উপ্’কে ‘উব্’, ‘আপ্’কে ‘আব’, ‘দেচ’ কে ‘দেজ্’, ‘রেচ্’ ‘রেজ’ ইত্যাদি।
১৩। ডায়াক্রিটিকেল মার্কস্ ( টুডীক্ আর টয়ৎ) ব্যবহারেও রোমান সানতালী লিপির অনুকরণ ঘটেছে।
১৪। অলচিকি অক্ষরগুলির নামকরণ এবং তাদের উচ্চারণ শুধু যে বিদ্ঘুটেমাত্র তা নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে অক্ষরগুলির নামের সানতালী অর্থ অশ্লীল শব্দও বোঝায়। যেমন -এড় (ব), উপরোক্ত কারণে সানতাল জনসাধারণ অলচিকি লিপিকে অস্বীকার করেন এবং গ্রহণও করেন না। অবৈজ্ঞানিক অলচিকি লিপি সানতালী ভাষার পক্ষে উপযোগী নয়। সানতালী ভাষার ধ্বনি অনুযায়ী অলচিকি লিপির ধ্বনি বিন্যাস নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অলচিকি লিপির বাস্তব গ্রহণ যোগ্যতা না থাকা স্বতে¦ও, সংকীর্ন রাজনৈতিক কারণে অলচিকির সমর্থকের দ্বারা অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ এবং অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সানতালী ভাষার সাধারণ জনগণের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আশ্চয্যের কথা হলো, যারা না বুঝে অলচিকির প্রচার প্রসারে লেগে আছেন, ঐ সব লোকেরা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার (হক) কে না বুঝে হনন করে চলেছে। অলচিকির সমর্থকেরা নিজেরাই অলচিকি জানেন না এবং তাদের নিজেদের সন্তানরাও অলচিকি লিপির মাধ্যমে সানতালী ভাষা লিখতে পড়তে জানে না। এই তথাকথিত অলচিকি সমর্থক সমাজ দরদীরা গরীব ও সরল গ্রামীণ জনতার সন্তানদের জন্য অলচিকি লিপিতে সানতালী ভাষায় পঠন-পাঠনের কথা বলে থাকে, কিন্তু অলচিকি সমর্থকেরা ক্রিশ্চিয়ান মিশনের ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে রোমান লিপিতে নিজের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য পাঠায়। এঁরা রোমান লিপির মাধ্যমে নিজ সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে কোনও চেষ্টাই আর বাকি রাখেননি, অথচ রোমান লিপির মাধ্যমেই সানতালী শিক্ষা দানের ব্যবস্থার কথা উঠলেই এনাদের গা জ্বলে ওঠে কেন? পরিবর্তনের পর, আশা করা গিয়েছে যে সানতালী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এই সরকারী বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, কতিপয় ভেকধারী তথাকথিত সমর্থকদের দ্বারা এই জনদরদী সরকারও ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন। এই ভেকধারীরা পরিবর্তনের পরে রাতারাতি ডিগবাজি খেয়ে নিজেদের বর্তমান সরকারের প্রকৃত সমর্থক বলে তুলে ধরতে সক্ষম হন, এবং আগের মতোই অবৈজ্ঞানিক, ত্রুটিপূর্ণ ও অনুকরণকৃত অলচিকি লিপিকে সাধারণ সানতালী ভাষী জনগণের উপর চাপিয়ে দেবার কাজে বর্তমান সরকারকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
১৫। কোনও ভাষা লেখার জন্য কি লিপি বা কি কি লিপি সরকার বা আম জনতা দ্বারা ব্যবহৃত হবে, এই বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানের ‘রাজ্য তালিকা’’ বা ‘যৌথ’ ( রাজ্য-কেন্দ্র) তালিকায় কখনও অন্তুর্ভূক্ত করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।
১৬। অলচিকির সমর্থকেরা এবং নেতা, নেত্রী, মন্ত্রীরা দুটি মিথ্যা কথা পরিষ্কার ভাবে বলে থাকেন-(ক) অলচিকি ভাষা এবং (খ) অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অলচিকি লিপি সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি, কিন্তু শুধু সানতালী ভাষা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ভাতরীয় সংবিধানে অষ্টম তপশীলে অদ্যাবধি মোট ২২টি ভাষা ‘সরকারী ভাষা’ রূপে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, যার মধ্যে সানতালী ভাষা একটি। এই ভাষাগুলি মধ্যে ভারত সরকার কেবলমাত্র ‘হিন্দী’ এবং ‘ইংরেজি’ ভাষা দুটি সরকারী কাজকর্ম লেখার ক্ষেত্রে লিপি হিসাবে যথাক্রমে ‘দেবনাগরী’ এবং ‘ রোমান’ লিপি দুটিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, বাকি ভাষাগুলি লেখার ক্ষেত্রে তেমন কোনও কেন্দ্রীয় সরকারী আদেশনামা নেই। অর্থাৎ, সানতালী ভাষাসহ অন্যান্য ‘সরকারী ভাষা’গুলি লেখার ক্ষেত্রে কোনও একটি ‘ বিশেষ’ লিপি নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই, এবং দেশে ‘(ভারত বর্ষে) প্রচলিত সবকটি লিপিই এই ক্ষেত্রে সমানভাবে স্বীকার করা হয়েছে।
১৭। অলচিকির সমর্থকেরা বলে থাকেন যে, ‘রোমান’ লিপি একটি অ-সানতাল লিপি, যা কিনা ‘সাহেবদের দ্বারা’, তাঁদের ভাষা চর্চার কাজে ব্যবহৃত না হলে নাকি সানতালদের জাত যাবে, মানে, তাঁরে জাতীত্ত্বাই নাকি বিপন্ন হয়ে পড়বে, এই কথাটা ঠিক নয়, এটি অসত্য কথা।
১৮। এই কু-যুক্তি শুনে মনে প্রশ্ন জাগে-বহুকাল থেকেই তো আসাম, মণিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের অ-বাঙালী জনগণ বাংলা লিপিকে আশ্রয় করেই তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা করে আসছেন, কই তাঁরাতো নিজেদের জাতিসত্ত্বা হারিয়ে বাঙ্গালি হয়ে যাননি? একইভাবে দেখা যাবে, পশ্চিম বাংলার সানতাল জনগণ বহুদিন থেকেই বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপির মাধ্যমে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশুনা করে আসছেন, অনেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, কই তাঁরা তো নিজেদের জাতকূল হারিয়ে মুরমু থেকে মুখার্জী, বেসরা বা বাস্কে থেকে ব্যানার্জী হয়ে যাননি! একই কথা খাটে ঝাড়খন্ড বিহারের সানতালদের ক্ষেত্রে, যাঁরা হিন্দী ভাষা ও দেবনাগরী লিপির মাধ্যমে পড়াশুনা করেও সেই সানতালী রয়ে গেছেন। কই তাঁরা তো সানতাল থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ, হিন্দু পণ্ডিত বা হিন্দু কায়স্তে পরিনত হননি? তবে? রোমান লিপির বিরোধীতায় এরকম সংকীর্ণ মনোভাব কেন? রোমান লিপি তো রোমানদের কাছ থেকে নেওয়া, কই ইংরেজ, ফরাসী, স্পেনীয়, ডাচ্, ওলন্দাজ, স্কট, জার্মান প্রভৃতি জাতির লোকেরা তো রোমীয় বা ইতালীয় হয়ে যাননি। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি রোমান লিপির মাধ্যমে ইংরেজি পড়াশুনা করছে, সেই সব জাতি তো ইংরেজ হয়ে যাননি? অথচ সানতালদের ক্ষেত্রেও তাঁদের মাতৃভাষা চর্চার জন্য রোমান লিপি ব্যবহার তাঁদেরকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে উন্নতির পথিক করে তুলবে, তাঁদের জাতিসত্ত্বা বিপন্ন হবার পরিবর্তে আরোও উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
১৯। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এখানে যেকোনও ব্যক্তি নিজ রুচি ও ইচ্ছা অনুযায়ী অবাধে যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন। রাজনৈতিক নেতাটি সরলমতি সানতাল আদিবাসীদের এই বলে বিভ্রান্ত করছেন যে, সানতালদের একমাত্র স্বীকৃত ধর্মের নাম হলো ‘সারণা’ যে বা যারা এই ধর্ম পালন করেন না তাঁরা সানতাল বা আদিবাসী বলে পরিগণিত হতে পারে না। অথচ , সত্যি কথাটা হলো-সানতালদের আদি ধর্মের নাম হলো ‘সৗরি ধরম’, ‘সারণা’ নয়। এছাড়াও সানতালরা বর্তমানে অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস অনুশীলন করছেন, যে অধিকার ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রশ্নাতীতভাবে তাঁদের বা যে কারোরই রয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকে যে, মহামান্য পাটনা হাইকোর্টের রায়ে বহু পূর্বেই এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে- একজন আদিবাসী সানতাল তাঁর পছন্দ অনুযায়ী যে কোনও ধর্ম পালন করতে পারেন, তাতে তাঁর আদিবাসীত্বের বা তদানুযায়ী অধিকারসমূহের কোনও হেরফের ঘটে/ঘটবে না। এই বিভ্রান্তকারী ও বিভেদকারী রাজনৈতিক অশুভ শক্তির ধারক, বাহক ও দালালদের থেকে সাধারণ সানতাল জনগণ সতর্ক থাকুন।
২০। অনেক ভাষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞের মতে , অলচিকিলিপি একটি বিকলাঙ্গ শিশুর মতো,শুনতে, বলতে, দেখতে, ঘ্রাণে, স্পর্শে ও চলতে অক্ষম। অলচিকির সমর্থকগণ অলচিকিকে সরকারী সহায়তায় জীবনদায়ী ভেন্টিলেটরে রেখেছেন বটে, কিন্তু নিকটভবিষ্যৎতে এর মৃত্যূ সুনিশ্চিত। অলচিকির নির্মাণকর্তা রঘুনাথ মুর্মুর ধ্বনি বিজ্ঞান এবং অক্ষর বিজ্ঞানে কোন জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল না। জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি সানতালী ভাষার ৪৭টি অক্ষরের পরিবর্তে মাত্র ৩০টি অক্ষরই বানাতে পেরেছেন, এই কারণেই অক্ষরের উচ্চারণও কাল্পনিক এবং আন্দাজে তৈরী করেছেন। সানতালী ভাষাতে কত স্বরবর্ণ এবং কত ব্যঞ্জণবর্ণ আছে তা রঘুনাথ মুর্মুর জানা ছিল না। অলচিকি একটি অবৈজ্ঞানিক (Unscintific) লিপি, তাতে কোন আধার (Base) ও নিয়ম-নীতি(System) নেই। রঘুনাথ মুর্মূকে পণ্ডিত উপাধি ফুটবল খেলার সময় দেওয়া হয়েছিল। কোন বিশ্ব বিদ্যালয় তাঁকে পণ্ডিত উপাধি দেয়নি।

সানতালী ভাষার জন্য প্রচলিত বিভিন্ন লিপির মধ্যে কেবলমাত্র রোমান লিপিরই ব্যবহারিক উপযোগীতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এই লিপিটি কোনো দেশ বিশেষ, কোনো জাতি বিশেষ, কোনো ধর্ম বিশেষ ও কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষের নয়। রোমান লিপির কার্যকারিতা এবং সার্বজনিন গ্রহণযোগ্যতা আজ কারোরই সুপারিশের অপেক্ষা রাখে না, তা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। মানবসভ্যতার অধিকাংশ জ্ঞানভাণ্ডার, সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা চর্চা, সবই প্রায় এই বিশ্বজনিন লিপিকে আশ্রয় করেই উন্নতির পথে এগিয়েই চলেছে। মানব জাতির ভবিষ্যতেও এই লিপিতে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে এবং এগিয়ে চলছে, ইতিহাসের অমোঘ গতিকে রুখবে, প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্বেষীদের সেই সাধ্য কোথায়? জয় চিরকালই সত্যের হয়েছে এবং হবেই। তথ্যসূত্র: ভারত পত্রিকা/ লিফলেট অবলম্বনে।

আরো বিষদে জানার জন্য নিম্নলিখিত বইগুলি অবশ্যই পড়ুন-
১। অলচিকি একটি মৌর্য্যযুগীয় লিপি-দুরবীন সরেন, ২। অলচিকি কী ক্রটিয়াঁ- সুকুমার হেমব্রম, ৩। সানতালী ভাষার জন্য লিপির নির্বাচন- ড. অনিমেষ কান্তি পাল,৪। অলচিকি এক অবৈজ্ঞানিক লিপি- হানুক হাঁসদাক, ৫। সানতালী ভাষার জন্য অলচিকি কেন?-ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক, ৬। ‘‘সংবিধানের অষ্টম তপশিলীতে সানতালী ভাষার স্বীকৃতি’’ ২২ ডিসেম্বর ২০০৩ সরকারী আদেশনামা দেখুন।

বাবুল রবিদাস
এ্যাডভোকেট
জজকোর্ট, জয়পুরহাট।

Continue Reading

মতামত

কোথা থেকে এল বাংলা লিপি

Avatar photo

Published

on

এড. বাবুল রবিদাস
মনের ভাব প্রকাশের জন্য লিখিত খোদিত বা অঙ্কিত সাংকেতিক চিহ্নকে লিপি বলে। মাটির ঘর লেপন করতে গিয়ে দাগ সৃষ্টি হয়। এই লেপা থেকে জন্ম হয়েছে লিপি শব্দের। লেপনের কাজে যখন রং বা বর্ণের ব্যবহার শুরু হয়, তখন তার আরেক নাম হলো বর্ণ। বর্ণ যখন গাছের পাতায় বা পত্রে লাগানো হতো, তখন তা হলো পত্রলেখা। লেখায় বা রেখায় ধ্বনি স্থায়ী রুপ লাভ করায় এর নাম হয়ে গেল অক্ষর। অর্থাৎ, যার কোনো ক্ষরণ বা ক্ষয় নেই। অক্ষর, বর্ণ আর লিপি শব্দগুলো তাই প্রায় সমার্থক হয়ে রয়েছে।

১০-১২ হাজার বছর আগের গুহাচিত্র দেখে সিদ্ধান্তে পৌছানো গেছে, চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপির উৎপত্তি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে ছবি আঁকা ছাড়া অন্য পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে পাওয়া যায় গ্রন্থিলিপি। দড়িতে গিট দিয়ে তারা মনের ভাব ধরে রাখত। বাংলা লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় The Origin of the Bengali Script (১৯৬৯) গ্রন্থে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে। অশোকের সময়কার ব্রাহ্মী লিপি গুপ্ত যুগে এসে নানা আঞ্চলিক বিশিষ্টতা লাভ করে। পূর্ব ভারতের বিশেষ ব্রাহ্মী বর্ণমালার পূর্ব প্রান্তীয় রুপের নাম কুটিল। এই কুটিল লিপি থেকে দশ এগারো শতকে বাংলা, উড়িয়া, অসমিয়া, নেওয়ারি, মৈথিলী ইত্যাদি বর্ণমালার উদ্ভব ঘটে। অবশ্য বাংলা-অসমিয়ার কোনো কোনো বর্ণ দশ শতকের অনেক আগেই দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্ণমালার গুচ্ছ বা সেট মোটামুটি এই সময়ে একটা নির্দিষ্ট আকার নেয়।

চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপি-
ভাবনাকে ধরে রাখার জন্য গুহাবাসী মানুষ পর্বতের গায়ে ছবি আঁকত। গুহায় আঁকা ছবিগুলো ছিল বাক্যনির্ভর। অর্থাৎ, প্রতিটি ছবি একটি কথা বা ভাবকে প্রকাশ করত। কিন্তু এর সমস্যা ছিল-অল্প কথা বোঝানোর জন্য অনেক বেশি আঁকতে হতো। প্রকৃত বর্ণনার যথাযথ চিত্রণও সহজ ছিল না। এর পরবর্তী পর্যায়ে তৈরী হয় Pictogram বা চিত্রলিপি। উত্তর আমেরিকার আদিম মানুষের লেখায় চিত্রলিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে। চিত্রলিপি পদ্ধতিতে একেকটি চিত্র হতো এককটি বস্তুর প্রতীক। পরপর আঁকা কয়েকটি বস্তুচিত্রের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য বা ভাবকে প্রকাশ করা হতো। এই পদ্ধতিতে মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি বোঝানো সম্ভব ছিল না। এর ধারাবারিকতায় Ideogram বা ভাবলিপির জন্ম হয়।

ভাবলিপিতে একেকটি প্রতিকৃতি সংক্ষিপ্ত বা সাংকেতিক হয়ে একটি বিশেষ চিহ্ন হয়ে দাড়ায়। চিত্রলিপিতে প্রতিটি চিত্র ছিল বস্তুচিত্র। ভাবলিপিতে প্রতিটি চিহ্ন সে বস্তুকে না বুঝিয়ে বস্তুর নামবাচক শব্দকে নির্দেশ করত। যেমন, প্রাচীন সুমেরীয় লিপিতে প্রথমে ‘মাছ’ বোঝাতে মাছের চিত্রই আাঁকা হতো। পরবর্তীতে স্তরে লিপি বিবর্তনের ফলে মাছের চিত্র একটি বিশেষ চিহ্নে রুপান্তরিত হয়, যার সঙ্গে মাছেরআকৃতির কোনো মিল নেই। লিপিবিজ্ঞানীরা এই স্তরের লিপিকে Logogram বা শব্দলিপি আখ্যা দিয়েছেন।

শব্দলিপি বিবর্তিতত হয়ে নাম নিল অক্ষরলিপি। শব্দলিটিতে ভাষায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের জন্য আলাদা প্রতীক বা চিহ্ন মনে রাখা সহজ ছিল না। পরবর্তী সময়ের লিপিতে বিভিন্ন ‘চিহ্ন’ একটি শব্দের সব ধ্বনিকে না বুঝিয়ে একটি Syllable বা অক্ষরকে নির্দেশ করতে থাকে। এই লিপিই Syllabogram বা অক্ষরলিপি নামে পরিচিত। অক্ষরলিপিতে চিহ্ন ব্যবহারের সংখ্যাও অনেক কমে আসে। অক্ষরলিপির পরিবর্তিত রুপের নাম হলো ধ্বনিলিপি বা Alphabetic Script প্রথমে একেকটি শব্দকে চিহ্নিত করা হতো একেকটি প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে। তারপর শব্দের প্রথম অংশ বা প্রথম সিলেবল ধরে একেটি প্রতীক বা ছবি ব্যবহৃত হতো। পরে প্রথম ধ্বনির প্রতীক হয়ে ওঠে সেই চিহ্ন। এভাবে লিপির বিকাশের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাওয়া গেল বর্ণলিপি।

ভারত ছাড়া অধিকাংশ দেশের ভাষার লিপিতে ধরা পড়ে ধ্বনিমূলক বর্ণ। আর ভারতীয় লিপি সম্পূর্ণ ধ্বনিমূলকও নয়, সম্পূর্ণ অক্ষরমূলকও নয়। বাংলা লিপিও তা-ই। সাতটি লিপিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম লিপি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো সুমেরীয় লিপি, মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি, ক্রিট দ্বীপবাসীর লিপি, হিত্তিলিপি, চীনালিপি, এলামবাসীর প্রাচীন লিপি ও সিন্ধু লিপি।

সিন্ধু লিপি-
সিন্ধু লিপি এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম লিপি। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া বিভিন্ন সিলমোহরে এই লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে জন মার্শাল সম্পাদিত Mohenjo-daro and the Indus Civilisation (১৯৩১) গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে সিন্ধু লিপির উৎস ও পাঠ সম্পর্কে প্লিতদের মন্তব্য বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। লিপিতত্ত্ববিদ গ্যাডগিল মনে করেন, সিন্ধু লিপি লেখা হতো ডান থেকে বাঁ দিকে। লিপিতত্ত্ববিদেরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন লিপির সঙ্গে সিন্ধু লিপির সাদৃশ্য পেয়েছেন। সুমেরীয়, আফ্রিকা ও আরব দেশের কোনো কোনো ভাষার অক্ষরের সঙ্গে এই লিপির সাদৃশ্য রয়েছে।
খরোষ্ঠি লিপি-

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বর্ণমালা দুটি-খারোষ্ঠি ও ব্রাহ্মী। ‘খারোষ্ঠি’ শব্দের মূল-খরপোস্তা। ভারতীয় আর্য ভাষার শব্দ ‘খর’ এবং ফারসি ভাষার শব্দ ‘পোস্তা’ মিলে খরপোস্তা শব্দ তৈরী হয়েছে। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গাধার চামড়া। খরোষ্ঠি লিপির প্রাচীনতম যে কয়েকটি নির্দশন মধ্য এশিয়ায় পাওয়া গেছে, তার অধিকাংশই উট, ঘোড়া বা গাঁধার চামড়ার পান্ডুলিপি। পাকিস্তানের প্রাচীনতম লিপি খরোষ্ঠি। খ্রিষ্টপূর্ন তিন শতক থেকে খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতক পর্যন্ত খরোষ্ঠি লিপির ব্যবহার ছিল। বিভিন্ন স্থানে আবিস্কৃত খরোষ্ঠি লিপির নিদর্শন এ লিপির বহুল ব্যবহার প্রমাণ করে। খরোষ্ঠি লিপি ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লিখতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে মধ্য এশিয়াও খরোষ্ঠি লিপির প্রচলন ছিল।

ব্রাহ্মী লিপি-

ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে প্রচলিত প্রায় সব লিপিই ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকে উদ্ভৃত। উপমহাদেশের বাইরের কয়েকটি লিপি, যেমন সিংহলী, বর্মি, যবদ্বীপি ও তিব্বতি লিপি এই বর্ণমালা থেকে এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতকে সম্রাট অশোকের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তর-পশ্চিমাংশ ছাড়া সব জায়গায় ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ছিল। এই লিপি ‘অশোক লিপি’ নামেও পরিচিত। অনেকের মতে, ব্রহ্মার কাছ থেকে পাওয়া বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ব্রাহ্মণদের লিপি বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। ব্রাহ্মী লিপির নামকরণের সঙ্গে ব্রহ্মা বা ব্রাহ্মণদের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা, এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

কানিংহামের মতে, ব্রাহ্মী লিপি ভারতীয় উপমহাদেশেই উদ্ভূত। তিনি এ যুক্তির সমর্থনে বিভিন্ন বর্ণের সঙ্গে কোনো না কোনো বস্তুর আকৃতিগত সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ধনুকের চিত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির ‘ধ’ মাছের আকৃতির সঙ্গে ‘ম’ বর্ণের সাদৃশ্য রয়েছে। ব্রাহ্মী লিপির পূর্ববর্তী কোনো লিপ এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ-এ লিপি, লিপিকর, বর্ণ, অক্ষর প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, পাণিনির সময়ে খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকে লিপির প্রচলন ছিল। অশোকের অনুশাসনে ব্রাহ্মী লিপির যে নির্দশন পাওয়া যায, তা সুগঠিত ও পরিণত। সুতরাং, এর আগে ব্রাহ্মী লিপির কোনো প্রাচীনতর রূপ থাকা স্বাভাবিক।

ব্রাহ্মী লিপি বাংলা লিপি-
ভারতে প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপি দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পরিবর্তিত হয়ে আজকের বাংলা লিপিতে রুপান্তরিত হয়েছে। খ্রিষ্টীয় এক শতক থেকে লিপির বিবর্তন শুরু হয়। ব্রাহ্মী লিপির বিবর্তনের ইতিহাসে পরবর্তী দুটি স্তরের নাম-কুষাণ লিপি ও গুপ্ত লিপি। খ্রিষ্টীয় এক থেকে তিন শতক পর্যন্ত কুষাণ রাজাদের আমলে কুষাণ লিপি প্রচলিত ছিল। এই লিপিতে ব্রাহ্মী লিপির বিভিন্ন বর্ণের বির্তন লক্ষ করা যায়। কুষাণ লিপির ছ, জ, থ, ধ, ট, ঠ বর্ণ ব্রাহ্মী লিপির অনুরুপ। এি লিপিতে ক, চ, ঝ, ড, দ, ন, প য বর্ণে সংক্ষিপ্ত মাত্রার ব্যবহার দেখা যায়। কুষাণ লিপির চ এবং ঢ বর্ণ দুটিতে বাংলা চ এবং ঢ বর্ণের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্তলিপি ভাতরীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। গুপ্তবংশীয় রাজাদের দ্বারা এ লিপি প্রচারিত হওয়ায় এর নাম হয়েছে গুপ্ত লিপি। গুপ্ত লিপির অধিকাংশ বর্ণ সংক্ষিপ্ত মাত্রাবিশিষ্ট। এই লিপির কোনো কোনো বর্ণে কুষাণ লিপির প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ বর্ণেরই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।

খ্রিষ্টীয় ছয় শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে যেসব লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে পূর্বাঞ্চল লিপি, উত্তরাঞ্চল লিপি ও দক্ষিণাঞ্চল লিপি। সাত শতকে পূর্বাঞ্চল লিপির দুটি ভাগ দেখা যায়া-পূর্বী ও পশ্চিমী। পশ্চিমী শাখার নগর লিপির প্রসার ঘটে সমগ্র উত্তর ভারতে। পরে এই নাগর লিপি থেকে দেবনাগরী লিপির জন্ম হয়। ৯ শতক পর্যন্ত ভারতের পূর্বাংশে পূর্বী লিপির প্রচলন ছিল। বর্ণের আকৃতি কিছুটা জটিল বা কুটিল ছিল বলেই এ লিপির নামকরণ করা হয় কুটিল লিপি। এই লিপির ব, ম, ন, জ, ক বর্ণে বাংলা বর্ণের প্রাচীন রূপ বিদ্যমান।

পূর্বী শাখার লিপি-
দশ শতকের শেষ দিকের রাজা প্রথম মহীপালের সময়ের কিছু পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এর অনেক অক্ষরের রূপ বাংলার কাছাকাছি। এই লিপিকে ১০ শতকের বর্ণলিপির নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। ১১ শতকের বাংলা লিপির নমুনা পাওয়া যায় বিজয় সেনের দেওপাড়া লিপিতে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এ সময়ের লিপির প্রায় ২২টি বর্ণে বাংলা হরফের রূপ পরিণত অথবা প্রায় পরিণত। ১২ শতকের লিপির নিদর্শন দেখা যায় লক্ষ্মণ সেনের আনুসুয়া লিপি, বিশ্বরূপ সেনের দানপত্র লিপি প্রভৃতি উপকরণে। ১৫ শতকের লিপির নমুনা মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ‘পুঁথিতে’।

১৬ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত বাংলা লিপির কিছু বৈচিত্র্য দেখা যায়। হস্তলিখনের দ্রুততার জন্য বা লিপিকারের লিপি-বিশিষ্টতার জন্য এ সময় কোনো কোনো বর্ণের আকৃতিগত পার্থক্য তৈরী হয়েছে। উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলনের পর বাংলা হরফ স্থায়ী রূপ লাভ করে। এর আগে ১৭৭৮ সালে নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের ব্যাকরণ গ্রন্থে প্রথম বাংলা অক্ষর মুদ্রিত হয়। (তথ্য সূত্রঃ বিজ্ঞান চিন্তা, ফেব্রুয়ারী-২০২১।

লেখক: আইনজীবি, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট।

Continue Reading

মতামত

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আনন্দ মোহন কলেজে আনন্দ র‍্যালি

Avatar photo

Published

on

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রলীগের আনন্দ র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার সকালে আয়োজিত র‍্যালিটি আনন্দ মোহন কলেজের ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় আনন্দমোহন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. নাজমুল ইসলাম সাকিব নেতৃত্ব দেন।

এ সময় তিনি বলেন, জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাবে ও শেখ মুজিবের আদর্শে কাজ করে যাবে ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিট। সকল অপশক্তিকে রোধকল্পে আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্রলীগ ইউনিট সবসময় প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।

Continue Reading