Connect with us

সাহিত্য

যিশুচরিত

Avatar photo

Published

on

Untitled-6-7-639x336 (1)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


বাউল সম্প্রদায়ের একজন লোককে একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তোমরা সকলের ঘরে খাও না? সে কহিল, না। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে কহিল, যাহারা আমাদের স্বীকার করে না আমরা তাহাদের ঘরে খাই না। আমি কহিলাম, তারা স্বীকার না করে নাই করিল, তোমরা স্বীকার করিবে না কেন। সে লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সরল ভাবে কহিল, তা বটে, ঐ জায়গাটাতে আমাদের একটু প্যাঁচ আছে।
আমাদের সমাজে যে ভেদবুদ্ধি আছে তাহারই দ্বারা চালিত হইয়া কোথায় আমরা অন্ন গ্রহণ করিব আর কোথায় করিব না তাহারই কৃত্রিম গণ্ডিরেখা-দ্বারা আমরা সমস্ত পৃথিবীকে চিহ্নিত করিয়া রাখিয়াছি। এমন-কি, যে-সকল মহাপুরুষ সমস্ত পৃথিবীর সামগ্রী, তাঁহাদিগকেও এইরূপ কোনো-না-কোনো একটা নিষিদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করিয়া পর করিয়া রাখিয়াছি। তাঁহাদের ঘরে অন্ন গ্রহণ করিব না বলিয়া স্থির করিয়া বসিয়া আছি। সমস্ত জগৎকে অন্ন বিতরণের ভার দিয়া বিধাতা যাঁহাদিগকে পাঠাইয়াছেন আমরা স্পর্ধার সঙ্গে তাঁহাদিগকেও জাতে ঠেলিয়াছি।
মহাÍা যিশুর প্রতি আমরা অনেক দিন এইরূপ একটা বিদ্বেষভাব পোষণ করিয়াছি। আমরা তাঁহাকে হৃদয়ে গ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক।
কিন্তু এজন্য একলা আমাদিগকেই দায়ী করা চলে না। আমাদের খৃষ্টের পরিচয় প্রধানত সাধারণ খৃষ্টান মিশনরিদের নিকট হইতে। খৃষ্টকে তাঁহারা খৃষ্টানি-দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া আমাদের কাছে ধরিয়াছেন। এ পর্যন্ত বিশেষভাবে তাঁহাদের ধর্মমতের দ্বারা আমাদের ধর্মসংস্কারকে তাঁহারা পরাভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। সুতরাং আÍরক্ষার চেষ্টায় আমরা লড়াই করিবার জন্যই প্রস্তুত হইয়া থাকি।
লড়াইয়ের অবস্থায় মানুষ বিচার করে না। সেই মত্ততার উত্তেজনায় আমরা খৃষ্টানকে আঘাত করিতে গিয়া খৃষ্টকেও আঘাত করিয়াছি। কিন্তু যাঁহারা জগতের মহাপুরুষ, শত্র“ কল্পনা করিয়া তাঁহাদিগকে আঘাত করা আÍঘাতেরই নামান্তর।
বস্তুত শত্র“র প্রতি রাগ করিয়া আমাদেরই দেশের উচ্চ আদর্শকে খর্ব করিয়াছি আপনাকে ক্ষুদ্র করিয়া দিয়াছি।
সকলেই জানেন ইংরাজি শিক্ষার প্রথমাবস্থায় আমাদের সমাজে একটা সংকটের দিন উপস্থিত হইয়াছিল। তখন সমস্ত সমাজ টলমল, শিক্ষিতের মন আন্দোলিত। ভারতবর্ষে পূজার্চনা সমস্তই বয়ঃপ্রাপ্ত শিশুর খেলামাত্র এ দেশে ধর্মের কোনো উচ্চ আদর্শ, ঈশ্বরের কোনো সত্য উপলব্ধি কোনো কালে ছিল না। এই বিশ্বাসে তখন আমরা নিজেদের সম্বন্ধে লজ্জা অনুভব করিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। এইরূপে হিন্দু সমাজের কূল যখন ভাঙিতেছিল, শিক্ষিতদের মন যখন ভিতরে ভিতরে বিদীর্ণ হইয়া দেশের দিক হইতে ধসিয়া পড়িতেছিল, স্বদেশের প্রতি অন্তরের অশ্রদ্ধা যখন বাহিরের আক্রমণের সম্মুখে আমাদিগকে দুর্বল করিয়া তুলিতেছিল, সেই সময়ে খৃষ্টান মিশনরি আমাদের সমাজে যে বিভীষিকা আনয়ন করিয়াছিল তাহার প্রভাব এখনো আমাদের হৃদয় হইতে স¤পূর্ণ দূর হয় নাই।
কিন্তু সেই সংকট আজ আমাদের কাটিয়া গিয়াছে। সেই ঘোরতর দুর্যোগের সময় রামমোহন রায় বাহিরের আবর্জনা ভেদ করিয়া আমাদের দেশের নিত্য স¤পদ সংশয়াকুল স্বদেশবাসীর নিকট উদ্ঘাটিত করিয়া দিলেন। এখন ধর্মসাধনায় আমাদের ভিক্ষাবৃত্তির দিন ঘুচিয়াছে। এখন হিন্দুধর্ম কেবলমাত্র কতকগুলি অদ্ভুত কাহিনী এবং বাহ্য-আচার-রূপে আমাদের নিকট প্রকাশমান নহে। এখন আমরা নির্ভয়ে সকল ধর্মের মহাপুরুষদের মহাবাণী-সকল গ্রহণ করিয়া আমাদের পৈতৃক ঐশ্বর্যকে বৈচিত্র্যদান করিতে পারি।
কিন্তু দুর্গতির দিনে মানুষ যখন দুর্বল থাকে তখন সে এক দিকের আতিশয্য হইতে রক্ষা পাইলে আর-এক দিকের আতিশয্যে গিয়া উত্তীর্ণ হয়। বিকারের জ্বরে মানুষের দেহের তাপ যখন উপরে চড়ে তখনো ভয় লাগাইয়া দেয় আবার যখন নীচে নামিতে থাকে তখনো সে ভয়ানক। আমাদের দেশের বর্তমান বিপদ আমাদের পূর্বতন বিপদের উল্টাদিকে উন্মত্ত হইয়া ছুটিতেছে।
আমাদের দেশের মহত্ত্বের মূর্তিটি প্রকাশ করিয়া দিলেও তাহা গ্রহণ করিবার বাধা আমাদের শক্তির জীর্ণতা। আমাদের অধিকার পাকা হইল না, কিন্তু আমাদের অহংকার বাড়িল। পূর্বে একদিন ছিল যখন আমরা কেবল সংস্কারবশত আমাদের সমাজ ও ধর্মের সমস্ত বিকারগুলিকে পুঞ্জীভূত করিয়া তাহার মধ্যে আবদ্ধ হইয়া বসিয়াছিলাম। এখন অহংকারবশতই সমস্ত বিকৃতিকে জোর করিয়া স্বীকার করাকে আমরা বলিষ্ঠতার লক্ষণ বলিয়া মনে করি। ঘরে ঝাঁট দিব না, কোনো আবর্জনাকেই বাহিরে ফেলিব না, যেখানে যাহা-কিছু আছে সমস্তকেই গায়ে মাখিয়া লইব, ধুলামাটির সঙ্গে মণিমাণিক্যকে নির্বিচারে একত্রে রক্ষা করাকেই সমন্বয়নীতি বলিয়া গণ্য করিব এই দশা আমাদের ঘটিয়াছে। ইহা বস্তুত তামসিকতা। নির্জীবতাই যেখানে যাহা-কিছু আছে সমস্তকেই সমান মূল্যে রক্ষা করে। তাহার কাছে ভালোও যেমন মন্দও তেমন, ভুলও যেমন সত্যও তেমনি।
জীবনের ধর্মই নির্বাচনের ধর্ম। তাহার কাছে নানা পদার্থের মূল্যের তারতম্য আছেই। সেই অনুসারে সে গ্রহণ করে, ত্যাগ করে। এবং যাহা তাহার পক্ষে যথার্থ শ্রেয় তাহাকেই সে গ্রহণ করে এবং বিপরীতকেই বর্জন করিয়া থাকে।
পশ্চিমের আঘাত খাইয়া আমাদের দেশে যে জাগরণ ঘটিয়াছে তাহা মুখ্যত জ্ঞানের দিকে। এই জাগরণের প্রথম অবস্থায় আমরা নিজের সম্বন্ধে বার বার ইহাই লক্ষ্য করিয়া আসিতেছিলাম যে, আমরা জ্ঞানে যাহা বুঝি ব্যবহারে তাহার উল্টা করি। ইহাতে ক্রমে যখন আÍধিক্কারের সূত্রপাত হইল তখন নিজের বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহারের সামঞ্জস্য-সাধনের অতি সহজ উপায় বাহির করিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। আমাদের যাহা-কিছু আছে সমস্তই ভালো, তাহার কিছুই বর্জনীয় নহে, ইহাই প্রমাণ করিতে বসিয়াছি।
এক দিকে আমরা জাগিয়াছি। সত্য আমাদের দ্বারে আঘাত করিতেছেন তাহা আমরা জানিতে পারিয়াছি। কিন্তু দ্বার খুলিয়া দিতেছি না সাড়া দিতেছি, কিন্তু পাদ্য-অর্ঘ্য আনিয়া দিতেছি না। ইহাতে আমাদের অপরাধ প্রতিদিন কেবল বাড়িয়া চলিতেছে। কিন্তু সেই অপরাধকে ঔদ্ধত্যের সহিত অস্বীকার করিবার যে অপরাধ সে আরো গুরুতর। লোকভয়ে এবং অভ্যাসের আলস্যে সত্যকে আমরা যদি দ্বারের কাছে দাঁড় করাইয়া লজ্জিত হইয়া বসিয়া থাকিতাম তাহা হইলেও তেমন ক্ষতি হইত না, কিন্তু তুমি সত্য নও যাহা অসত্য তাহাই সত্য ইহাই প্রাণপণ শক্তিতে প্রমাণ করিবার জন্য যুক্তির কুহক বিস্তার করার মতো এত বড়ো অপরাধ আর কিছুই হইতে পারে না। আমরা ঘরের পুরাতন জঞ্জালকে বাঁচাইতে গিয়া সত্যকে বিনাশ করিতে কুণ্ঠিত হইতেছি না।
এই চেষ্টার মধ্যে যে দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাহা মূলত চরিত্রের দুর্বলতা। চরিত্র অসাড় হইয়া আছে বলিয়াই আমরা কাজের দিকটাতে আপনাকে ও সকলকে ফাঁকি দিতে উদ্যত। যে-সকল আচার বিচার বিশ্বাস পূজাপদ্ধতি আমাদের দেশের শতসহস্র নরনারীকে জড়তা মূঢ়তা ও নানা দুঃখে অভিভূত করিয়া ফেলিতেছে, যাহা আমাদিগকে কেবলই ছোটো করিতেছে, ব্যর্থ করিতেছে, বিচ্ছিন্ন করিতেছে, জগতে আমাদিগকে সকলের কাছে অপমানিত ও সকল আক্রমণে পরাভূত করিতেছে, কোনোমতেই আমরা সাহস করিয়া স্পষ্ট করিয়া তাহাদের অকল্যাণরূপ দেখিতে এবং ঘোষণা করিতে চাহি না নিজের বুদ্ধির চোখে সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার ধুলা ছড়াইয়া নিশ্চেষ্টতার পথে স্পর্ধা করিয়া পদচারণ করিতে চাই। ধর্মবুদ্ধি চরিত্রবল যখন জাগিয়া উঠে তখন সে এই-সকল বিড়ম্বনা-সৃষ্টিকে প্রবল পৌরুষের সহিত অবজ্ঞা করে। মানুষের যে-সকল দুঃখ-দুর্গতি সম্মুখে স্পষ্ট বিদ্যমান তাহাকে সে হৃদয়হীন ভাবুকতার সূক্ষ্ম কারুকার্যে মনোরম করিয়া তোলার অধ্যবসায়কে কিছুতেই আর সহ্য করিতে পারে না।
ইহা হইতেই আমাদের প্রয়োজন বুঝা যাইবে। জ্ঞানবৃদ্ধির দ্বারা আমাদের স¤পূর্ণ বলবৃদ্ধি হইতেছে না। আমাদের মনুষ্যত্বকে সমগ্রভাবে উদ্বোধিত করিয়া তোলার অভাবে আমরা নির্ভীক পৌরুষের সহিত পূর্ণশক্তিতে জীবনকে মঙ্গলের সরল পথে প্রবাহিত করিতে পারিতেছি না।
এই দুর্গতির দিনে সেই মহাপুরুষেরাই আমাদের সহায় যাঁহারা কোনো কারণেই কোনো প্রলোভনেই আপনাকে এবং অন্যকে বঞ্চনা করিতে চান নাই, যাঁহারা প্রবল বলে মিথ্যাকে অস্বীকার করিয়াছেন এবং সমস্ত পৃথিবীর লোকের নিকট অপমানিত হইয়াও সত্যকে যাঁহারা নিজের জীবন দিয়া প্রমাণ করিয়াছেন। তাঁহাদের চরিত চিন্তা করিয়া সমস্ত কৃত্রিমতা কুটিলতর্ক ও প্রাণহীন বাহ্য-আচারের জটিল বেষ্টন হইতে চিত্ত মুক্তিলাভ করিয়া রক্ষা পায়।
যিশুর চরিত আলোচনা করিলে দেখিতে পাইব যাঁহারা মহাÍা তাঁহারা সত্যকে অত্যন্ত সরল করিয়া সমস্ত জীবনের সামগ্রী করিয়া দেখেন তাঁহারা কোনো নূতন পন্থা, কোনো বাহ্য প্রণালী, কোনো অদ্ভুত মত প্রচার করেন না। তাঁহারা অত্যন্ত সহজ কথা বলিবার জন্য আসেন তাঁহারা পিতাকে পিতা বলিতে ও ভাইকে ভাই ডাকিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহারা এই অত্যন্ত সরল বাক্যটি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলিয়া যান যে, যাহা অন্তরের সামগ্রী তাহাকে বাহিরের আয়োজনে পুঞ্জীকৃত করিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা মাত্র। তাঁহারা মনকে জাগাইতে বলেন, তাঁহারা দৃষ্টিকে সরল করিয়া সম্মুখে লক্ষ করিতে বলেন, অন্ধ অভ্যাসকে তাঁহারা সত্যের সিংহাসন হইতে অপসারিত করিতে আদেশ করেন।
তাঁহারা কোনো অপরূপ সামগ্রী সংগ্রহ করিয়া আনেন না, কেবল তাঁহাদের দীপ্ত নেত্রের দৃষ্টিপাতে আমাদের জীবনের মধ্যে তাঁহারা সেই চিরকালের আলোক নিক্ষেপ করেন যাহার আঘাতে আমাদের দুর্বল জড়তার সমস্ত ব্যর্থ জাল-বুনানির মধ্য হইতে আমরা লজ্জিত হইয়া জাগিয়া উঠি।
জাগিয়া উঠিয়া আমরা কী দেখি? আমরা মানুষকে দেখিতে পাই। আমরা নিজের সত্যমূর্তি সম্মুখে দেখি। মানুষ যে কত বড়ো সে কথা আমরা প্রতিদিন ভুলিয়া থাকি; স্বরচিত ও সমাজরচিত শত শত বাধা আমাদিগকে চারি দিক হইতে ছোটো করিয়া রাখিয়াছে, আমরা আমাদের সমস্তটা দেখিতে পাই না। যাঁহারা আপনার দেবতাকে ক্ষুদ্র করেন নাই, পূজাকে কৃত্রিম করেন নাই, লোকাচারের দাসত্বচিহ্ন ধুলায় ফেলিয়া দিয়া যাঁহারা আপনাকে অমৃতের পুত্র বলিয়া সগৌরবে ঘোষণা করিয়াছেন, তাঁহারা মানুষের কাছে মানুষকে বড়ো করিয়া দিয়াছেন। ইহাকেই বলে মুক্তি দেওয়া। মুক্তি স্বর্গ নহে, সুখ নহে। মুক্তি অধিকারবিস্তার, মুক্তি ভূমাকে উপলব্ধি।
সেই মুক্তির আহ্বান বহন করিয়া নিত্যকালের রাজপথে ঐ দেখো কে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। তাঁহাকে অনাদর করিয়ো না, আঘাত করিয়ো না, তুমি আমাদের কেহ নও বলিয়া আপনাকে হীন করিয়ো না। তুমি আমাদের জাতির নও বলিয়া আপনার জাতিকে লজ্জা দিয়ো না। সমস্ত জড়সংস্কারজাল ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আইস, ভক্তিনম্র চিত্তে প্রণাম করো, বলো তুমি আমাদের অত্যন্ত আপন, কারণ, তোমার মধ্যে আমরা আপনাকে সত্যভাবে লাভ করিতেছি।
যে সময়ে কোনো দেশে কোনো মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন সে সময়কে আমরা তাঁহার আবির্ভাবের অনুকূল সময় বলিয়া গণ্য করি। এ কথা এক দিক হইতে সত্য হইলেও, এ সম্বন্ধে আমাদের ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা আছে। সাধারণত যে লক্ষণগুলিকে আমরা অনুকূল বলিয়া মনে করি তাহার বিপরীতকেই প্রতিকূল বলিয়া গণ্য করা চলে না। অভাব অত্যন্ত কঠোর হইলে মানুষের লাভের চেষ্টা অত্যন্ত জাগ্রত হয়। অতএব একান্ত অভাবকেই লাভসম্ভাবনার প্রতিকূল বলা যাইতে পারে না। বাতাস যখন অত্যন্ত স্থির হয় তখনই ঝড়কে আমরা আসন্ন বলিয়া থাকি। বস্তুত মানুষের ইতিহাসে আমরা বরাবর দেখিয়া আসিতেছি প্রতিকূলতা যেমন আনুকূল্য করে এমন আর কিছুতেই নহে। যিশুর জন্মগ্রহণকালের প্রতি লক্ষ করিলেও আমরা এই সত্যটির প্রমাণ পাইব।
মানুষের প্রতাপ ও ঐশ্বর্য যখন চোখে দেখিতে পাই তখন আমাদের মনের উপর তাহার প্রভাব যে কিরূপ প্রবল হইয়া উঠে তাহা বর্তমান যুগে আমরা স্পষ্টই দেখিতে পাইতেছি। সে আপনার চেয়ে বড়ো যেন আর কাহাকেও স্বীকার করিতে চায় না। মানুষ এই ঐশ্বর্যের প্রলোভনে আকৃষ্ট হইয়া কেহ বা ভিক্ষাবৃত্তি, কেহ বা দাস্যবৃত্তি, কেহ বা দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সমস্ত জীবন কাটাইয়া দেয় এক মুহূর্ত অবকাশ পায় না।

Continue Reading
Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

প্রবন্ধ

কবিতা: বাংলা সাহিত্যের দ্রৌপদী

Avatar photo

Published

on

সবুজ ভট্টাচার্য্য
শিরোনাম দেখে যদি কারো চোখ শিরে উঠে বসে, তাহলে তার জন্য লেখককে দোষারোপ করা যাবেনা। সার্বিক ধারনায় দ্রৌপদী যাঁর নিকট পরিচিত, তার নিকট শিরোনামের শিরচ্ছেদ করার কোনো প্রয়োজন আপাত দৃষ্টিতে নেই। তবে সূর্যদয়ের সময়ে যে কবিজাতী রাতের ঘুমের ব্যবস্থা করেন তাদের ভাবোদয়েও সূর্যাস্তের সময় হয়ে যায়। শিরোনামের উদ্দেশ্য উপসংহারে প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করছি।

পল্লিকবি জসিমউদ্দীন একান্ত নিজস্ব কোনো এক দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছিলেন, “সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি।” আলোচনা সমালোচনার কোনো কমতি হয়নি এর পর। যুগের পর যুগ ধরে চলতে লাগলো এ নিঃসীম আলোচনা। এই আলোচিত আলোচনার আলোচ্য বিষয়ের উপর জোড় দিতে পরিশেষে কিনা কবি শামসুর রাহমানও ঐ সমালোচকদের দলে যোগ দিলেন! তবে তিনি সমালোচনার নামে সমান ভাবে আলোচনা না করেই বলে বসলেন “যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।” তবে কবি যে, পক্ষে গিয়ে গেয়েছেন বিপক্ষের গান তা আমরা টের পাইনি। কবি যে ‘ইচ্ছে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তার শাব্দিক অর্থ, ভাবার্থ এবং কাব্যিক অর্থ সম্পুর্ণই ভিন্ন। ভাবার্থে কবি পছন্দ-অপছন্দের কথা বললেও, কাব্যিক অর্থে তিনি কবির বাকস্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক সিদ্ধান্তের উপর জোরারোপ করেছেন। কবিতাকে তিনি দিয়েছেন মতামত প্রকাশের সর্বোত্তম স্থান। তাই তিনি বলেছিলেন তাঁর কবিতার খাতায় তিনি যেমন ইচ্ছে তেমন লিখবেন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে নয়।

তাং: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রিয় প্রধান শিক্ষক, মাত্রাহীন উচ্চ বিদ্যালয়, কল্পনানগর, ছন্দখালি।
আশা করি ভালো আছেন কিন্তু আমি তো ভালো নেই। তবে আজ একটু ভালো বোধ করছি বলেই বিদ্যালয়ে এলাম। গত দুই দিন প্রলাপবাক্য বকেছি জ্বরের প্রতাপে। (মা বলেছেন, গণিত শিক্ষক স্নেহোত্তর চক্রবর্তী- কে প্রলাপকালিন আলাপে অশ্রাব্য গালিও দিয়েছি।)
অতএব, মহোদয় নিকট সবিনয় বিনীত নিবেদন এই যে, গণিত শিক্ষক স্নেহোত্তর চক্রবর্তীর স্নেহহীন শাসন এবং আমার শারীরিক অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে গত দু’দিন ছুটি দানে বাধিত করবেন।
নিবেদক
অষ্টম শ্রেণির খ শাখার নিয়মিত ছাত্র
“অকবি নাথ দুর্যোধন”

এখন হয়তো এটাই মূখ্য প্রশ্ন যে, এটা আদৌ কি ধরনের পত্র। আরে মশাই বুঝতেই তো পারছেন এটা আবেদনপত্র। শতভাবে বুঝালেও আপনি বলবেন এটি আবেদনপত্র হয়নি। কারন জানতে চাইলেও বড় একটা নিয়মনীতির তালিকা আমার হাতে ধরিয়ে দেয়া হতে পারে। কিন্তু কি এমন ভুল আছে এতে? তারিখের ক্ষেত্রে ইংরেজি মাসের নাম বাংলায় বানান করে লেখার চেয়ে এই তো ঢের ভালো ছিলো। নামের পরে প্রধান শিক্ষকের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ঠিকানাসহ তো দেয়াই হয়েছে। আর এ আবেদন তো উনি নিজেই পরবেন। তাই ওনাকে ওনার অবস্থান বিস্তারিত জানাতে আমি নারাজ; উনি নিজেই এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। শিক্ষক- ছাত্রের এতো মধুর একটা সম্পর্কের মাঝে প্রাতিষ্ঠানিক আচরণ নামের ফরমালিটি কতটা সুন্দর দেখায় বা তার প্রভাবটাও বা কতটা ভালো, সে প্রশ্ন আমি রাখতেই পারি। কিন্তু পরিশেষে সবাই জাতীয় জোট বেঁধে এটাই প্রমাণ করবেন যে এটা আবেদনপত্রের নিয়মে পরেনি। তার মানে নিয়মের বাইরে দুটো শব্দ বা প্রদত্ত তথ্যের ভুল অবস্থানে যদি একে আবেদনপত্রের শ্রেণীচ্যুত করা হয় তাহলে পূর্বের আলোচনায় ফিরে যাওয়াটা আমার নিকট খুবই সহজ হয়।

হ্যাঁ, পল্লিকবি যথার্থই ভলেছেন। সবাই মোটেও কবি নন। আর কবি শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার সংবিধানে যে ধারা লিখে গেছেন তাতে শুধুমাত্র কি বিষয়ে লিখবো বা লিখবোনা তার ইচ্ছে বা স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে উপধারা প্রদত্ত হবার দরকার ছিলো অনেক বেশি।

তিনটি বাহু ত্রিকোনী অবস্থায় অবস্থান করা স্বত্বেও তাকে জ্যামিতিক ভাষায় ত্রিভুজ বলা যাবেনা যতক্ষণ না পর্যন্ত ঐ তিনটি বাহু পরস্পর যুক্ত হয়ে একটি আবদ্ধ ক্ষেত্র তৈরি না করে। ঠিক একইভাবে কবিতা বিষয়টাকে এতটা সহজ করে দেখলে হবেনা। কবিতার মাঝেও থাকতে হবে ছন্দ-মাত্রা এর শক্ত বাঁধন। যে বাঁধন তাকে দাঁড় করাবে উন্নত কবিতার কাতারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে স্বঘোষিত কবিদের স্বরচিত কবিতাগুলো যত দেখি ততই বর্তমান কবিদের পূর্বপুরুষদের কথা ভেবে চোখে জল আসে। এটাই চিন্তার শিরে উঠে বসে যে কি পরিমান কষ্টই না তারা করেছিলেন ছন্দ-মাত্রা ঠিক রাখতে। আমার এটা ভেবেও কষ্ট হয় যে, কি পরিমান কাগজ-কালি যে তাঁরা নষ্ট করেছিলেন শুধু এই ভেবে যে, তাঁর লেখা কবিতাটি কোনো এক চরনে/স্তবকে মাত্রাভ্রম/ছন্দভ্রম হয়েছে। তাঁরা ছন্দের বাঁধনে বাঁধতে গিয়ে মাত্রা ব্যবহারের যে নিম্নমাত্রা থেকে উচ্চমাত্রায় উঠানামা করতেন হয়তো তার গল্প শুধু ঐ দোয়াতকলম আর ময়লার স্তুপে জমায়িত কাগজের খন্ডিত টুকরো গুলোই জানে। জ্ঞানের জোড়ে হারাতে না পারলেও বুদ্ধির জোরে অত্যাধুনিক কবিরা তাঁদের শুধু হারিয়ে দিয়েছে বললেও ভীষণ ভুল হবে। বরং এটা বললেই ভালো হবে যে, অত্যাধুনিক কবিরা এই কথাই প্রমান করে ছেড়েছেন যে, “আবেগেটাই মূখ্য, ছন্দ-মাত্রা গৌন বিষয়।” অতি আবেগে মানুষ ভাষা হারিয়ে ফেলে; এসব কবিরা তো মাত্র মাত্রা আর ছন্দ হারিয়েছেন। যাই হোক, তাদের কবিতার খাতায় তারা কিভাবে কি লিখবেন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই; সমস্যা শুধু তখনই হয় যখন দেখি এসব কবিতা কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই স্বজনপ্রিতির কোমল জালে আবদ্ধ সংবাদপত্রসমূহের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। তারাও কি তবে বলবেন, “যেমন ইচ্ছে ছাপানোর আমার সাহিত্যের পাতা।”

কবিতা লেখাটাকে যতটা সহজ করা হবে, ততটাই গ্রহণ যোগ্যতা পাবে, তবে হারাবে তার রাজকীয় অবস্থান ছন্দে শেখা কবিতাগুলো বৃদ্ধ বয়সেও মনে থাকে বাঁধনের জোড়েই।

কথায় আছে ‘‘স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’’ বাঙ্গালি অত্যাধুনিক কবিরা স্বাধীনতা অর্জন করেনি, দখল করেছে তবে তাও রক্ষা করতে পারবে কি না বেশ সন্দেহ। স্বাধীনতার প্রগারতা এতটা বেশি হয়ে গেছে যে, ‘কবিতা’ কে আমরা রাজ দরবারে রাখতে নারাজ আর তাই আজ আমরা ‘কবিতা’কে বর্তমান সাহিত্য বাজারের সস্তা পণ্যে পরিণত করেছি; যে চায় সেই কিনতে পারে। কবিতা লেখাটা বাঙ্গালি কবির মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। আমি কারো অধিকার হরণ করার কথা কলছিনা। তবে কোনো গদ্যকে খন্ডিত করে মাঝ পথে স্পেসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে অহেতুক স্তবকের আবর্তন ঘটিয়ে তাকে কবিতা দাবী করাটা মোটেও মানতে পারিনা। তবে স্ব স্ব সাহিত্য সভায় স্বরচিত সাহিত্য গৃহিত না হলে বর্তমান কবিরা স্বেচ্ছায় সভা ত্যাগ করেন আর এই ভয়ে অন্য কবিরাও তাতে “কেয়া বাত, কেয়া বাত” বলে বহ্বা দিয়ে বসেন।

বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বাজারে এই সহজ উৎপাদন পদ্ধতির কারনে সর্বজনস্বীকৃত সহজপ্রাপ্য কবিতা হারিয়েছে তার রাজবেস, রাজমুকুট ছেড়ে হয়েছে আজ জটাধারী পাগল। আর আমরা সেই জটাধাধারী পাগলের জটাকে জ্ঞানের ঘণিভূত অবস্থা ভেবে সন্যাসী রূপে পুজো করছি।
কোনো এক সময়ে বোধ হয় কবি শামশুর রহমান নিজেও টের পেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই মিথ্যে আলোর ঝকমকির আড়ালে লুকিয়ে থাখা বাংলা কাব্যের অন্ধকার যুগ। তাই হয়তো বারকার বলেছিলেন “রাত পোহাতে কত দেরি পাঞ্জেরী?” এই রাত বাংলা সাহিত্যের কাব্য জগতের অন্ধকার রাত। আমি বলছিনা কবিতা লিখতে হলে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করতে হবে। মহান কবিদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার স্বীকৃতি ছিলোনা তবে ধ্বনিতত্বের যে বাধনে তারা আপন ইচ্ছেয় নিজেদের বন্দি রেখেছিলেন তার কারনেই এখনো আমরা বাংলা সাহিত্য নিয়ে গর্ব করি।

নিয়মিত কিছু শব্দের অনিয়মিত প্রয়োগ ঘটিয়ে যে কবিদল বাংলা সাহিত্যকে রাজ মুকুট পড়ালেন, তাদের উত্তরসুরীরা জীবনের অনিয়মিত কিছু শব্দের নিয়মিত প্রয়োগ ঘটিয়ে ভাবছেন এই শব্দবৃষ্টিই হলো কাব্য সাগর। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রাথমিক কিছু ধারনা থাকা বাঞ্চনীয়। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতেই হয় অন্তত ‘‘অক্ষর”, ‘‘মাত্রা”, ‘‘মুক্তাক্ষর”, ‘‘বদ্ধাক্ষর বা যুক্তাক্ষর”, ‘‘পর্ব”, ‘‘অতিপর্ব” ইত্যাদি সম্পর্কে ন্যুনতম ধারনা থাকা উচিত।

অক্ষর
সাধারণ ভাবে আমরা বুঝি, প্রতিটি বর্ণই একেকটি অক্ষর/’সিলেবল’ (Syllable)। কিন্তু, বাংলা ব্যকরণের ভাষায় তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। আমরা জানি, মানুষ কোন শব্দ উচ্চারণ করার সময়, একবারে যত গুলো কম সংখ্যক বর্ণ উচ্চারণ করে, তাদের একেকটিকে একেকটি অক্ষর বলে। চলুন, আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি। এর জন্য আমি ‘‘কলম” শব্দটি বাছাই করলাম। খেয়াল করে দেখুন, ‘‘কলম’’ শব্দটি আমরা দুই ভাগ করে উচ্চারণ করছি ‘‘ক”, ‘‘লম্” এভাবে। শুধুমাত্র ‘‘কলম” শব্দটিই নয়, প্রতিটি শব্দই, আমরা এমন ভাগ ভাগ করেই উচ্চারণ করি। আর এই প্রতিটি ভাগই হল একেকটি অক্ষর। তাহলে, চলুন আমরা মাত্রা শিখে ফেলি।

মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর
যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে, তখন তাকে মুক্তাক্ষর/ওপেন সিলেবল (Open Syllable) বলে। যেমন, ‘‘কলম” শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি অক্ষর ‘‘ক’’, ‘‘লম্’’ পাওয়া যায়। এতে, ‘‘ক” একাই একটি অক্ষর, সুতরাং এটি মুক্তাক্ষর।
এবার, যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তাকে বদ্ধাক্ষর/ক্লোজড সিলেবল (Closed Syllable) বলে। সুতরাং, ‘‘কলম” এর ‘‘লম্’’ হল বদ্ধাক্ষর। এখন, একটি বড় শব্দের ক্ষেত্রে বোঝানোর চেষ্টা করি। যেমন, প্রত্যুৎপন্নমতি = প্রত্, তুৎ, পন্, ন, ম, তি। এখানে, ন, ম, তি এই তিনটি মুক্তাক্ষর এবং প্রত্, তুৎ, পন্, এই তিনটি বদ্ধাক্ষর। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
যে সব সিলেবল উচ্চারণের সময়মুখের ভেতর প্রবাহমান বাতাস জিভের দেয়ালে আটকে যায়তাদের ক্লোজড সিলেবল বলা হয়। যেমন : দাগ্, ভাগ্, ঘুষ্, হাঁস্, ঝাঁক্, আজ্, থাক্, কাল্, দিন্, চিন্, কই, ইত্যাদি।
যে সব সিলেবল উচ্চারণের সময়মুখের ভেতর প্রবহমান বাতাস জিভের দেয়ালের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে তাদের ওপেন সিলেবল বলে। যেমন: জা, ঝা, ছা, গু, চা, দি, দা, বা, বু ইত্যাদি।

পর্ব ও অতিপর্ব
এবার পর্ব নিযয়ে আলোচনা শুরু করছি। পর্বের সংজ্ঞা অনেকটা অক্ষরের মতই। এক নিঃশ্বাসে যতগুলো কম সংখ্যক শব্দ একবারে পড়া যায়, তাদের সমষ্টি হল একটি পর্ব। যেমন,
ঐ খানে তোর / দাদির কবর /
ডালিম গাছের / তলে /
যখন, একটি শব্দ নিয়ে একটি পর্ব বুঝাবে, তখন তাকে আমরা অতিপর্ব বলব। সুতরাং, এখানে ‘‘তলে” হল, অতিপর্ব। একে অপূর্ণ পর্বও বলা যেতে পারে। এখন চলুন আমরা আরেকটি কবিতা দেখি,
এই নেয়েছে / ঐ নিল যাঃ / কান নিয়েছে / চিলে /
চিলের পিছে / মরছি ঘুরে / আমরা সবাই / মিলে /
নিশ্চই বুঝতে পারছেন, ‘‘চিলে” এবং ‘‘মিলে” হল অতিপর্ব, বাকি গুলো পর্ব। সুতরাং, এই দুটি লাইনে ছয়টি পর্ব এবং দুইটি অতিপর্ব আছে।

ছন্দ
বাংলা কবিতার তিন ছন্দ সনাতনী ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। কবিতার উৎকৃষ্টতার জন্যে ছন্দ একমাত্র উপজিব্য না হলেও এটি যে প্রধানতম একটি দিক তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিল্প সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, কবিতা, সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই তাল-লয়-সুর ইত্যাদির সংমিশ্রণে ভাষার মালা হয়ে মানুষের মনে দোলা দিয়ে আসছে। অক্ষর ও শব্দের নানামুখি চালে এই মালা তৈরীর প্রক্রিয়া বা নিয়মই আদতে ছন্দ।

এবার চলুন ভিন্ন ছন্দের বিশ্লেষনে আমারা মাত্রা সম্পর্কে জানার নিমিত্তে শব্দের শরীরের ভেতরে অক্ষরকে/সিলেবলকে খুঁজি।
উত্তম = উত্+তম্
(এখানে দুটিই ক্লোজড সিলেবল।)
জাঝা = জা+ঝা
(এখানে দুটিই ওপেন সিলেবল।)
বাহুবন্ধন = বা+হু+বন্+ধন্
(এখানে ‘বা’ ও ‘হু’ ওপেন সিলেবল কিন্তু ‘বন্’ ও ‘ধন্’ ক্লোজড সিলেবল।)
যুক্তাক্ষও = যুক্+তাক্+খর্
(এখানে তিনটিই ক্লোজড সিলেবল।)
ভিন্ন ছন্দে মাত্রা
অক্ষরবৃত্ত এর ক্ষেত্রে ওপেন সিলেবল সবসময়পাবে ১ মাত্রা। তবে শব্দের শুরুতে কিম্বা মধ্যে থাকলে ক্লোজড সিলেবল পাবে ১ মাত্রা, শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা।
যেমন-
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যায়দণ্ড’)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
চিত্ত যেথা/ ভয়শূন্য/ উচ্চ যেথা/ শির/
চিত্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ ভ(১)য়(১)শূন্(১)নো(১),/ উচ্(১)চো(১) যে(১)থা(১)/ শির্(২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।
জ্ঞান যেথা/ মুক্ত, যেথা/ গৃহের প্রা/চীর
জ্ঞা(১)ন(১) যে(১)থা(১)/ মুক্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ গৃ(১)হের্(২) প্রা(১)/ চীর্র (২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।

মাত্রাবৃত্ত এর ক্ষেত্রে ওপেন সিলেবল সবসময় পাবে ১ মাত্রা আর ক্লোজড সিলেবল পাবে ২ মাত্রা।
যেমন
ধনুকের মতো টংকার দিলো টাকা
তোমার উষ্ণ লাল কিংখাবে ঢাকা
(শহীদ কাদরী, প্রেমিকের গান)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
ধনুকের মতো/ টংকার দিলো/ টাকা/
ধ(১)নু(১)কের্(২) ম(১)তো(১)/ টং(২)কার্(২) দি(১)লো(১)/টা(১)কা(১)
দুইটি সম্পূর্ণ পর্ব ও একটি অতিপর্বে মাত্রাবৃত্তের ৬+৬+২ চাল।
তোমার উষ্ণ/ লাল কিংখাবে/ ঢাকা/
তো(১)মার্(২) উষ্(২) নো(১)/ লাল্(২) কিং(২)খা(১)বে(১)/ ঢা(১)কা(১)/
অর্থাৎ, ৬+৬+২ চাল।

স্বরবৃত্ত এর জন্য ওপেন, ক্লোজড উভয়সিলেবলই পাবে ১ মাত্রা।
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয়পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।
(আল মাহমুদ, ‘পাখির মতো’)
বিশ্লেষণ করলে পাই-
তোমরা যখন/ শিখছো পড়া/
তোম্(১)রা(১) য(১)খন্(১)/ শিখ্(১)ছো(১) প(১)ড়া(১)/
অর্থাৎ ৪+৪ চাল।
মানুষ হওয়ার/ জন্য,/
মা(১)নুষ্(১) হও(১)য়ার্র(১) জন্(১)নো(১)/
অর্থাৎ, ৪+২ চাল।
আমি না হয়পাখিই হবো,
আ(১)মি(১) না(১)হয়্(১)/ পা(১)খিই(১) হ(১)বো(১)/
অর্থাৎ ৪+৪ চাল।
পাখির মতো বন্য।
পা(১)খির্(১) ম(১)তো(১)/ বন্(১)নো(১)/
অর্থাৎ, ৪+২ চাল।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে, আমি গদ্যছন্দের কথা ভূলে গেছি। কিন্তু খেয়ালের দরুন আমাদের বেখায়ালী মনে যে বোধটির উদয় হতে পারে তা হলো, গদ্য ছন্দে লেখা কবিতারও শব্দ সমূহের মধ্যে আভ্যন্তরীয় সম্পর্ক এবং সুরের প্রবাহ থাকে।
যেমন- “ যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না” বলেই আদালতে আমরা “মিথ্যাসভা” এর উদ্ভোধনী ফিতা কাটি আর জমিয়ে রাখা কথার জাবর কাটি। অথ্যাধুনিক কবিরাও তাই তাদের ব্যর্থ চরনের ভ্রান্তি ঢাকতে কবিতার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। তবে তাঁরা চাইলে অনশনও করতে পারেন; তাতে বাংলারই মঙ্গল।
অনেকের মাঝে আবার একটি ভ্রান্ত প্রবাহের বিভ্রান্ত কবিতাকুল মনোভাব দেখা যায়; তারা মনে করেন দূর্বোধ্য কিছু শব্দের পাশাপাশি অবস্থানেই সৃষ্টি হয় অমর কবিতা। কাব্য জগতকে অমর করতে গিয়ে যে তারা কাব্যের জন্যেই কবর কুড়ে বসেন তাতে পাঠক সমাজ খুবই মর্মাহত হয়ে কবিতাকে অন্য গ্রহের ভাষা মনে করেন।

যদি কেউ লেখেন,
মনগোলাপের পাপড়িমাল্যে সুবাসচাদরের ক্রিয়ামূল
শুভ্রসকালে উথিত সূর্য!
মালিরূপ মন, আবেগের জল-
থামিল বাগান দুয়ারে
(কালপনিক কবিতা)

কোনো সাধারন পাঠককে যদি বলি কবি ‘বিখ্যাতবিমল রায়’-এর এই অখ্যাত কবিতাটি সাপ্তাহিক ‘অবিবেচিত’ পত্রিকার তথাকথিত সাহিত্য সাময়ীকিতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে বলে বসবেন, “বাহ! খ্বুই সুন্দর” অথচ উপরিউক্ত কবিতাটি বিন্দুমাত্র না ভেবে শুধুমাত্র কিছু অপরিচিত রূপক শব্দের পাশাপাশি অবস্থান। যা কবিতার ‘ক’ তেও নয় ‘তা’ তেও নয়, ‘বি’ তে এসে বিশ্রিভাবে বিনষ্ট হয়েছে।
এবার সমাপ্তি রেখা টানতেই হয়। অতি নিয়মে খেলার আনন্দ মাটি হয় বলে যে, কোনো নিয়ম ছাড়াই আমরা খেলায় মাতবো এটা কেমন কথা? নিয়মের অভাবেই যত দ্বন্দের উৎপত্তি। তাই সার্বিক ধারনা মাথায় নিয়েই কলমের আঁচর খাতায় দেয়া উচিৎ।

“কবিতা” রাজদরবারের বিষয় বলে আমি তার গন্ডিকে চারদেয়ালের মাঝে রাখতে রাজি নই। তবে এও আমার চাহিদা নয় যে, তাকে আমি পথের ধুলিতে পরিণত করবো। আমি চাই কবিতাকে আমরা রাজদরবারের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকরূপ প্রজাদের মাঝে নিয়ে আসবো কিন্তু তার স্বাদে কোনো ভিন্নতা থাকবেনা।

তাই কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বাংলা কবিতাকে বাংলা সাহিত্যের দ্রোপদী বলে আক্ষ্যায়িত করা। আমার এই কাল্পনিক কুরুক্ষেত্রে দুর্যোধন একজন নয়, হাজারে দুর্যোধন একইসাথে যে পাশা খোলায় মেতেছে, তার পরিণতীতে আমাদের অমর কবিরাই পঞ্চপান্ডব হয়ে বনবাসে চলে যাবে। খেলা শেষে চারপাশ থেকে ছুটে আসছে অগণিত দুর্যোধনের হাত আর তারা যেমন ইচ্ছে তেমন করেই বাংলার এই দ্রোপদীর ক্রমাগত বস্ত্রহরণ করছে। আমাদের সন্তানরা হয়তো তা পুথি হিসেবে পড়বে।

পরিশেষে অত্যাধুনিক কবিদের কাছে করজোর প্রার্থনা যেমন ইচ্ছে তেমন বিষয় নিয়ে লিখুন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে নয়।

লেখক : গবেষক, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

Continue Reading

কবিতা

কবিতা: ছুটে এসে মিশে যাও

Avatar photo

Published

on

ছুটে এসে মিশে যাও
প্রকাশ চন্দ্র রায়

ক্যামন করে তোমার হস্তগত হলাম,
ক্যামন করে পৌঁছলাম এসে যৌবনের ঘাটে,
কোনদিকে পালালো বাল্য-কৈশোর আমার
জানি না তা! জানি না সঠিকভাবে!
যৌবনের ডালে ফুল ফুটেছে,
বসন্ত এসে ভর করেছে দেহ-মনে;
ক্ষণে ক্ষণে এখন মনে জাগে কেবল
তোমাকে কাছে পাওয়ার অতল আকুলতা।
সুস্মিতা! সামান্য ক্ষণের ছোঁয়া-ছুঁয়িতে
আর অনধিক কালের আলিঙ্গনে,
তুমি আমাকে উন্মাদিত এক প্রেমিক বানালে।
প্রাসঙ্গিক ভাবনার ব্যূহ ভেদ করে
তোমার ভাবনারা’ই এখন উঁকিঝুঁকি মারে
অপ্রাসঙ্গিকভাবে মস্তিস্কের মণিকোটরে।
এভাবে কতদিন!কতক্ষণ আর সহ্যের সীমানায়
পুষে রাখা যায় অম্লমধুর স্বাদের অমলিন যাতনাকে।
যমযাতনা’র অবসান কল্পে তুমি আসছ না কেন ছুটে?
আমি তো বুক পেতে রেখেছিই অহর্নিশি
তোমাকে আপনার করে রেখে দেবার ছলে।
কেন যে হারালো বাল্য-কৈশোর!
কেন যে আসলো উন্মত্ত যৌবন!
কেন যে তোমার সান্নিধ্য-সুখ পেলাম যৌবনের ঘাটে!
এখন আর দিন কাটে না-রাত কাটে না!
অচেনা আতঙ্কে বয়ে চলছে অস্থির সময়।
সুস্মিতা!তুমি ছুটে এসে মিশে যাও আমার আত্মায়-সত্ত্বায়;
নইলে আমার প্রাণ যায় প্রাণ যায়।

রচনাকাল- ৭ আগস্ট ২০২১, শনিবার।

Continue Reading

কবিতা

পান্ডুলিপির কবিতা- সাইফ সাত্তার

Avatar photo

Published

on

পান্ডুলিপির কবিতা
সাইফ সাত্তার

আসুন, এই চক্রান্তকারী সন্ধ্যায় চায়ের লিকারের মতো
ব্যক্তিগত ব্যার্থতায় চুমুক দিই।

সিগ্রেটে আগুন দেবার আগে মনে করার চেষ্টা করি-
আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে অসহ্য অগ্নিঝড়।
আর রাতেই আমরা ঘরে ফিরবো।

দরজায় অপেক্ষমান অন্ধকারের মুখোশ পরে আমাদের স্ত্রীগণ জেগে থাকবেন-
আগামী বছরের প্রতিশ্রুতি পূরণের আশায় এক সাথে ঘুমিয়ে পড়বেন দুজন।

শ্রবনবিদ্ধ শব্দের ভেতর তবুও জেগে থেকে আমি (যেহেতু পুরুষ)
সেহেতু ঘরের মধ্যে আমিই দন্ডিত বৃক্ষ।
আমার সক্ষম ছায়ায় বেড়ে উঠবে আমার ভবিষ্যত

রমনীময় হয়ে উঠবে আগামী বছর।
একটা সূক্ষ্ণ লিলেনের জামা
বাবুটার স্কুলের টিফিনে একটা অরেঞ্জকেক
একজোড়া সিটি গোল্ডের রিং
বাতাসে আমাদের স্ত্রীগণের হাসির মতো দুলে উঠবে।

আমি জানি, এই দেশ তাঁর সর্বস্হটুকু হারিয়ে ফেলেছে রাজনীতির মধ্যে-
রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে।

প্রথম প্রেমিকের জন্য স্ত্রীরা যা হারিয়েছে
তা তাদের অলৌকিক বিস্ময়।

আসুন, এসব ব্যক্তিগত আগামী বছরগুলো
আমরা বিনিময় করি।
মনেরাখি, ফার্মের ডিমের মতো পৃথিবীটা গোলাকার।
আর সেখানে কমলালেবুর সংজ্ঞাটা
প্রমানিত রাজনীতির মতো!

বিডিপত্র/সাহিত্য

Continue Reading