সচিবদের ভুয়া সনদ: চিঠির অপেক্ষায় জনপ্রশাসন
স্টাফ রিপোর্টার:
জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেওয়া চার সচিব ও একজন যুগ্ম-সচিবের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী এদের বিরুদ্ধে আদৌ ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা স্পষ্ট না করে জনপ্রশাসন সচিব বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিঠির অপেক্ষা করছেন তারা। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী জানিয়েছেন, ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে তারা মামলা করবেন।
দুদকের সুপারিশ অনুযায়ী গত ১৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব এ কে এম আমির হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের (বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান) মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী (বর্তমানে ওএসডি) এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদারের মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্তও আসে গত রোববার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের সভায়। তবে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত এই পাঁচ কর্মকর্তার মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করে আদেশ জারি করেনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “ফাইল রেডি আছে, রোববার এদের সনদ ও গেজেট বাতিল করে আদেশ জারি করা হবে।” মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগে কোনো মামলা করবে কি না- এ প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যদি মামলা না-ই করে, তবে আমরা মামলা করব।” প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের এই কর্মকর্তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন কি না- এই প্রশ্নে দৃঢ়তার সঙ্গেই মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল বলেন, “মন্ত্রিত্ব চলে যাক, তবুও কথার হেরফের হবে না।” জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেকের কাছে বৃহস্পতিবার দুপুরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে তিনি সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীও জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে ‘কোনো আপডেট নেই’ জানিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। পরে মন্ত্রণালয় ছাড়ার সময় সচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “দেখা যাক কী করা যায়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের চিঠির অপেক্ষা করছি।”এর আগে সোমবার ইসমত আরা বলেছিলেন, “তাদের (পাঁচ কর্মকর্তা) সনদ বাতিল হয়েছে মাত্র, এখন এদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি, হবে না, সেটাও বিবেচনার বিষয়।”
সরকারের এই পাঁচ কর্মকর্তা অবৈধ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেন বলে দুদকের এক তদন্তে বেরিয়ে আসার পর তাদের সনদ বাতিলের সুপারিশ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। ’৮১ ব্যাচের কর্মকর্তা মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান গত জানুয়ারিতে পিআরএল-এ যাওয়ার পর গত ১৯ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে চুক্তিতে নিয়োগ পান। ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা মাসুদ সিদ্দিকী আগামী ৩০ অক্টোবর অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাবেন। আর ’৮২ বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তা নিয়াজউদ্দিনের আগামী ৩০ ডিসেম্বর অবসরত্তোর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম-সচিব আবুল কাশেমকে বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির অভিযোগে গত গত ২১ এপ্রিল ওএসডি করা হয়েছে। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, জালিয়াতি করে সনদ নিলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে চার সচিব ও এক যুগ্ম-সচিব চাকরির মেয়াদ এখনো বাড়েনি। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরির বয়স ৫৭ থেকে ৫৯ বছর করা হয়। তবে অধ্যাদেশ জারির কারণে তা ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হচ্ছে। এর আগে ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বয়স ৫৯-এ উন্নীত করা হয়। গত বছরের ২১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়সসীমা এক বছর বাড়িয়ে ৬০ বছর করার ঘোষণা দেন। জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেয়া পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তা কর্মজীবনের শেষ সময়ে এসে চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়াতেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেন বলে অভিযোগ। মাসুদ সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেওয়ার সময় ওই মন্ত্রণালয়েরই সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। সরকারি কর্মচারী বিধি অনুযায়ী, এই পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা-ভঙ্গের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা ছাড়াও প্রতারণার মামলা হতে পারে।