আমার মনে ঈদ আসে না
মোখলেছুর রহমান
বছর ঘুরে আবার দিনটি চলে এসেছে। প্রতিবারের মতো এবারও আমেজটা শুরু হয় রমজানের শুরু থেকেই। সারাদিন রোযা রেখে ইফতারির মধ্য দিয়ে একেকটি দিন পার হয়েছে, আর প্রতীক্ষার একেকটি ধাপ অতিক্রান্ত হয়েছে। এভাবে এক মাসের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজ দুয়ারে দাঁড়িয়ে ঈদ। ঈদের দিনগুলোকে উৎসবময় করে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই কমবেশি প্রস্তুত। সবাই নাড়ির টানে ঘরে ফিরেছে। দীর্ঘ নয়দিনের অবকাশ! কত দিন পর সবাই একসাথে হচ্ছি! যান্ত্রিকতার এই যুগে পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশি-আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব সবাই এক হওয়ার এত বড় উপলক্ষ আর কই? সকালে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহে যাওয়া, জামাতে নামাজ শেষে কোলাকুলি করা, দলবেধে বাড়ি ফেরা, ফেরার পথে পূর্বপুরুষদের কবর জেয়ারত করা, মুরুব্বিদের পা-ছুঁয়ে সালাম করে দোআ নেওয়া, পিচ্ছিগুলোর ‘সালামি’র আবদার পূরণ করা, পরিবারের সবাই একসাথে বসে আয়েশ করে ভালো-মন্দ খাওয়া, বিকালে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-আড্ডায় মেতে ওঠা, রাতে টিভিতে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান দেখা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যাওয়া, আরো কত কী! আহা, কত দিন হয় না এমন আনন্দ।
এই দিনটিতে আমার চারপাশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে এক
অকৃত্রিম আনন্দ লক্ষ্য করি আমি। এত ভোগান্তি, এত অশান্তি, এত যন্ত্রণার মাঝেও এই একটি দিনকে ঘিরে তাদের মধ্যে কি যে উচ্ছ্বাস! দৃশ্যগুলো আমার চিরচেনা। মফস্বলের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের সদস্য হিসেবে বাল্যকাল থেকেই এই সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই আমি বেড়ে ওঠেছি। কিন্তু সত্যি করে বলছি, ইদানীং চিরচেনা এই দৃশ্যগুলো, চারপাশের মানুষের এই ভাবাবেগ, তাদের উচ্ছ্বাস-আনন্দ সব আমার কাছে বড় রহস্যময় ঠেকে। নিজের মনে বার বার প্রশ্ন জাগে, এত আনন্দ, এত উচ্ছ্বাস, এত কৌতুক, কোলাহল করেন কিভাবে তারা? আর আমিই বা কেন পারি না? প্রিয় এক বন্ধু মেসেজ করে জানতে চাইল, “বাড়ি আসবে কবে? এবার কলেজে সবাই এক হবো। অনেক দিন একসাথে হই না।” কোনো কিছু না ভেবেই একবাক্যে উত্তর দিলাম, “তোমরা যাও, আমার শুভ কামনা রইল।” কেন আমি এতটা অনান্তরিক আর অসামাজিক গোছের হয়ে গেলাম?
না, আমি বুড়িয়ে যাইনি। উচ্ছল কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছি খুব বেশি দিন হয়নি। পৃথিবীর সব রং, রূপ, রস উপভোগ করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি, বিষয়টা তেমন নয়। কিংবা জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জীবনের প্রতি সব আগ্রহ-আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে, তেমন ব্যর্থ কোনো যুবকের প্রতিনিধিও নই আমি। হাহাকার করার মতো কিছুই ঘটেনি আমার জীবনে। তথাপি বিশ্বাস করুন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদের দিনগুলোও আমার কাছে কোনো আনন্দ নিয়ে আসতে পারেনি। প্রাণভরে হাসতে পারি না, বন্ধুদের সাথে আনন্দে মজতে পারি না বহুদিন। মুসা ইব্রাহিমের এভারেস্ট জয় আমাকে একদিন যতটা আনন্দিত করেছিল, মুস্তাফিজের আইপিএল জয় আজ আমাকে তার সিকি ভাগও আনন্দ দিতে পারে না। অথচ চারদিকে কত হৈ-চৈ, মাতামাতি। পরিচিত জনেরা আমার আচরণে প্রায়ই অবাক হন, কাউকে কাউকে বিরক্তি প্রকাশ করতেও দেখি। তথাপি আনন্দের অভিনয়টুকুও করতে পারি না। নিজের সংক্ষুব্ধ হৃদয়কে কিছুতেই স্থির করতে পারি না আমি।
এই সমাজ আর এই দেশটাকে নিয়ে যখন থেকে একটু একটু করে ভাবতে শিখেছি, তখন থেকেই আমার ব্যক্তিগত আনন্দের উপলক্ষগুলো ধীরে ধীরে কেমন ফিকে হয়ে আসতে শুরু করে। খেলাধুলা আর বিনোদন আর কাটুনের পাতা ছেড়ে যেদিন থেকে অন্য পাতাগুলোতে মনোযোগ দিতে শুরু করলাম, তখন থেকে দেখে আসছি, সমাজে অন্যায়, অবিচার, জুলুম, দুঃশাসন, মানুষে মানুষে সংঘাত, রক্তপাত, ক্রোধ, হিংসা, অবিশ্বাস আর অনাস্থা ধাঁই ধাঁই করে কেবল বাড়ছে। আজ জীবনের এই পর্যায়ে এসে জাতির অতীত আর বর্তমানকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে যতবারই ভবিষ্যতের কল্পনা করতে যাই, আমি শিঁউরে উঠি। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুতের দৃশ্যমান অগ্রগতি, কথিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, এক কথায় কোনো যান্ত্রিক অগ্রগতিই আমাকে আশ্বস্ত করতে পারে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, সব বালির বাধের মতো। একটি ছোট্ট আঘাতে সব গুড়িয়ে যেতে পারে যে কোনো সময়। আমি বড় শঙ্কিত। আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করার চেষ্টা করি, কোথায় ছুটে চলেছে মানুষগুলো? নীতি-নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব, ধর্ম, সমাজ, মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে হন্যে হয়ে পার্থিব সুখ-সম্ভোগের পশ্চাদ্ধাবন করছে প্রতিটি মানুষ। স্বার্থের সন্ধানে একে অপরের সাথে সীমাহীন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে তারা। তারা কি ভেবে দেখেছে এই নিরন্তর নিশ্চিন্তে ছুটে চলা পথের শেষে কী অপেক্ষা করছে? এই ভাবনাগুলো আমাকে প্রায়ই বিচলিত করে তোলে। মাঝে মাঝে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, থামো সবাই, একবার আমার কথাটা শোন, এই পথের শেষে ভয়ানক মৃত্যু আর ধ্বংস অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। কিন্তু পারি না, লোকে আমাকে পাগল ভাবতে পারে।
আজ ঈদের দিন, আনন্দের দিন। এমন একটি দিনের জন্য আমরা অপেক্ষা করেছি দীর্ঘ একমাস। অথচ তার তিন দিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করতে হলো। কী কারণে? একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে কিছু বিপথগামী যুবক অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২০ জন জলজ্যান্ত মানুষকে জবাই করে ফেললো। জিম্মিদের উদ্ধার করতে আসা দুই জন পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি হত্যা করল আর যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিজেরাও মরল। জবাই করে হত্যা করা মানুষগুলোর প্রায় সবাই বিদেশি, যারা আমাদের মেহমান। যারা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সাথী হতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে এখানে পড়ে আছে। যাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব, আমাদের ধর্মের শিক্ষা, হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শিক্ষা। কিন্তু আমরা তাদের নিরাপত্তা দিতে পারিনি। বরং কফিনে করে হাজার মাইল দূরে তাদের জন্য প্রতীক্ষারত পরিবার-পরিজনের কাছে গলা কাটা বিকৃত লাশগুলো পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। পাঠক, আনন্দের দিনে আনন্দ করুন, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন। এই লাশগুলো যখন একেকটি পরিবারের কাছে পৌঁছাবে তখন তারা যে সীমাহীন কষ্টে ভেঙে পড়বে, তাদের স্ত্রী-মাতারা যে বারবার মুর্ছা যাবে, সেই কষ্টটা কি আপনাকে-আমাকে স্পর্শ করতে পারছে? যদি না করে তবে শুনে রাখুন, আমাদের সমস্ত ধর্মকর্ম ব্যর্থ। আমাদের ধর্মগুরুরা নবীজি যেভাবে ঈদের নামাজ পড়তেন তা আমাদের শিখিয়েছেন। কিন্তু মানবতার ভূ-লুণ্ঠন তাঁকে যেভাবে পীড়িত করে তুলতো, তা দূর করার জন্য বিচলিত করে তুলতো তা তারা আমাদের শেখাননি। যদি শেখাতেন তবে দুইদিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন শেষে এতগুলো নিরপরাধ মানুষের সদ্যমৃত্যু আর এতগুলো পরিবারের বুকফাটা কান্নাকে উপেক্ষা করে আজ আমরা আনন্দে মেতে ওঠতে পারতাম না।
গুলশানে বিদেশিদের সাথে নিহত বাংলাদেশি তিনজনের পরিবারের কথা ভাবুন। কিংবা ভাবুন জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে যে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হলেন তাদের পরিবারের কথা। অথবা সেইসব বিপথগামী যুবকের পরিবারের কথাও, যারা একেকজন সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে তাদেরকে ঘাতকে পরিণত করা হয়েছে আর মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই সব পরিবারগুলোতে কি আজ ‘ঈদ’ এসেছে? তারাও কি আমাদের মতো আজ হাসবে, গাইবে, মাস্তি করে বেড়াবে? কিংবা স্মরণ করুন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর কথা। যারা তার বিচারের দাবিতে রাস্তায় ব্যানার হাতে মিছিল করেছেন, মানববন্ধন করেছে, ফাকে ফাকে ফেসবুকে ছবি আপলোড করে বাহবা কুড়িয়েছে, তারাও হয়তো আজকে ‘ঈদ’ করবেন। কিন্তু তার মা-বাবা? কিংবা ভাবুন নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে উন্মাদ ধর্মব্যবসায়ীদের তা-বের কথা। গত মার্চে হেযবুত তওহীদের অনুসারীদের খ্রিস্টান আখ্যা দিয়ে, তাদের নির্মাণাধীন একটি মসজিদকে ‘গীর্জা’ দাবি করে সেখানে হামলা চালানো হয় দু’টি পরিবারের বসতভিটায়। নির্মাণাধীন মসজিদসহ তাদের ঘর-বাড়ি ভেঙে, লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মেরে হাত-পা ভেঙে পিতৃ-পুরুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। ওই তা-বের বিরুদ্ধে যে মুষ্টিমেয় মানুষ দাঁড়িয়েছিল তাদের প্রত্যেককে মেরে গুরুতর আহত করা হয়। এমনকি দু’জনকে জবাই করে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেদিন ধর্মব্যবসায়ী নরপিশাচদের কোপানলে পড়ে যে মানুষগুলো তাদের ভিটে-মাটি হারিয়ে এখনো উদ্বাস্তুর ন্যায় এখানে-সেখানে রাত্রীযাপন করছেন, শরীরে জখমের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন, ঈদের আনন্দ তাদের কিভাবে স্পর্শ করবে বলুন তো! কিংবা সেই দু’জনের পরিবার যারা এই অন্যায়কে প্রতিহত করতে গিয়ে নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিল, ঈদ কি তাদের স্ত্রী-সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে? পারবে না। তারা কি আমাদের কেউ নয়? রসুল (স.) বলেছেন, মুসলিম উম্মাহ একটি দেহের ন্যায়, এর এক অংশ ব্যথিত হলে সারা শরীর সেই ব্যথা অনুভব করে। আমরা কি অনুভব করতে পারছি ব্যথিত-পীড়িত-নির্যাতিত মানুষগুলোর যন্ত্রণা? যদি পারি, যদি আমরা মুসলিম বলে নিজেদের বিশ্বাস করি, তবে এত আনন্দ আসে কোথা থেকে?
আজ আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের জীবন অনিরাপদ। কে কখন খুন হয়ে যায় সারাক্ষণ তারা এই আশঙ্কায় থাকে। উড়োচিঠি দিয়ে তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দু-চার দিন পরপর একেকজন ঘাতকের শান দেওয়া চাপাতির লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। তারাও তো মানুষ, আমাদের কারো না কারো প্রতিবেশি। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে কোনো রকম বেঁচে থাকতে চায়। পিতৃ-পুরুষের ভিটা ছেড়ে কাটা তারের বেড়া গলে ওপাড়ে অনিশ্চিত জীবনের অনুসন্ধান তাদের চাওয়া নয়। প্রতিবেশি হিসেবে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া কি ইসলামের শিক্ষা নয়? এককজন অমুসলিমকে যখন গলা কেটে হত্যা করে যায়, অতঃপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়, তখন আমার সব আনন্দ উবে যায়। ইসলাম চিরকাল তার শাসনাধীন ভূ-খ-ে অপরাপর জাতিকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রতিতে আবদ্ধ ছিল। আল্লাহর রসুল ও তার আসহাবরা এবং পরবর্তী শত শত বছর অপরাপর ধর্মের অনুসারীরা পরিপূর্ণ আস্থার সাথে মুসলিম শাসনাধীন ভূ-খ-ে বসবাস করে এসেছে। আর আজ সেই ইসলামের কথা বলে আমাদেরই জ্ঞাতি ভাইয়েরা তাদের হত্যা করছে, আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারছি না। নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে আমার। ঈদ আনন্দময় হয়ে ওঠার অবকাশ পায় না কোনোভাবেই।
আজ সারাবিশ্বের দিকে তাকান। আর নিজেদের দেশের পরিস্থিতিও বিবেচনা করুন। কোটি কোটি সিরিয়ান আজ ইউরোপের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। অনেকে নিজ দেশে উদ্বাস্তুর ন্যায় জীবন যাপন করছে। জীবন তাদেরকে এমন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে যে, কেবল নারীরা নয়, তরুণ-যুবকেরা পর্যন্ত একমুঠো খাবারের জন্য আরব শেখদের (তারাও আমাদের কথিত ভাই!) কাছে নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছে। মানবজাতির ইতিহাসে আছে এমন ঘটনা আর? আমার জানা নেই। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায়ও আজ প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। অন্যদিকে আমাদের দেশেও জঙ্গিবাদের শেকড় ধীরে ধীরে পাকাপোক্ত হচ্ছে। এতদিন জঙ্গিরা একজন একজন করে টার্গেট করতো আর নির্জনে তাকে হত্যা করে লুকিয়ে পড়ত। এখন তারা তাদের ধারা পরিবর্তন করে মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপীয় স্টাইল ধারণ করতে যাচ্ছে। জনাকীর্ণ রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে মানুষকে হত্যা করে নিজেরাও মরে যাচ্ছে। ভয়ানক কিছুর আভাস পাচ্ছেন কি? আমাদের সরকার এখনো নিজেদের জঙ্গি দমনে সফল বলে দাবি করে যাচ্ছে। বিরোধী দল চিরাচরিত প্রক্রিয়ায় নিন্দা জানিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কথিত বুদ্ধিজীবীরা আজও তাদের জ্ঞানের ফুলঝুরি সাজিয়ে বসে আছে। আর সবাই জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে। অথচ আজও তারা শত শত দলে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের প্রতি দিন-রাত বিষোদগার করে নিজেদের মুখে ফেনা তুলছে। সাধারণ মানুষেরও কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। “ মরলে মরেছে এক ‘হিন্দুর বাচ্চা কিংবা নাস্তিক বা নাসারার দল’, আমার কি? আমার যতদিন চাকরি আছে, ব্যবসা আছে, ততদিন পেটে ভাতও আছে। ওই সব ভেবে আমাদের কাজ নেই। দেশে কি সরকার নেই?”, এই হচ্ছে তাদের অভিব্যক্তি। আমার প্রশ্ন, অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও দু’চার কিংবা পাঁচ-দশ বছরের ব্যবধানে আজকের সিরিয়া বা ইরাকের ন্যায় ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে, এই আশঙ্কা কি আপনাদের কখনোই পায় না? দেশগুলোর অতীতের দিকে যখন তাকাই, দেখতে পাই তাদের হাজার হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা কোনোদিক দিয়েই তারা আমাদের থেকে পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু কোনো কিছুই তাদের রক্ষা করতে পারেনি। বিশ্ব রাজনীতির নোংরা খেলা, জঙ্গিবাদের আর সা¤্রাজ্যবাদের ভয়ংকর কালো থাবা আজ একেকটি সমৃদ্ধ জনপদকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। সবই ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে। কিন্তু আমরা তাদের ব্যর্থতার জায়গাটি অনুসন্ধান করি না। তাদের কী এমন অভাব ছিল যা আমাদের রয়েছে, যা দিয়ে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব? সাদ্দাম হোসেন কিংবা গাদ্দাফির যে অর্থনৈতিক শক্তি আর সামরিক দাপট ছিল তার সিকি ভাগও আমাদের নেই। আফসোস! দেশে এত ভয়ানক বিপর্যয়কর একেকটি ঘটনা ঘটছে অথচ আমাদের নীতি-নির্ধারকদের আস্ফালনে এতটুকু কমতি দেখি না। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে তারা পেশীশক্তিতেই আস্থা রাখতে চায়। আমাদের বিরোধী দলেরও বোধোদয় হয় না। শুনতে পাই দেশকে অকার্যকর করার জন্য ভয়ানক মোসাদের এজেন্টদের সাথে বসে পরিকল্পনা করার কথা। তাদের হয়তো বিদেশে সেকেন্ড হোম রয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার চিন্তা-ভাবনাও কারো থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যারা আম-জনতা, আমাদের তো কোনো গতি নেই। এই মাটি কামড়ে পড়ে থেকে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তায় নগ্ন গায়ে কেবল এক টুকরো কম্বল গায়ে জড়িয়ে ভিক্ষে করা ছাড়া নিজের কোনো গত্যন্তর দেখতে পাই না। তাই আজকে ঈদের দিনেও মুখে হাসির রেখা টানতে পারি না। চারপাশের এত মাতামাতিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারি না। মনে হয়, যে কোনো মুহূর্তে একটা প্রবল ঝর এসে সব তছনছ করে দিয়ে যাবে সব কিছু। আমার মনে ঈদ আসে না। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে শপথ নিতে ইচ্ছে করে, এই সব অন্যায়, অশান্তি, জুলুম, পৈশাচিকতা, বিবাদ, বিভক্তির অবসান ঘটার আগে আমার ঈদ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।