উত্থান-পতন, লড়াই, ফের ক্ষমতার মসনদের নিকটে তালেবান
তাদেরকে আটকে রাখার লড়াইয়ে নিয়োজিত সরকারি বাহিনীগুলোকে হটিয়ে ঝড়ের বেগে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বিনা বাধায় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ঢুকেছে ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভিযানে ক্ষমতাচ্যুত তালেবানের যোদ্ধারা।
কট্টর এ ইসলামী গোষ্ঠীর নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
তাদের উত্থান-পতন, দর্শন, ২০ বছরের লড়াই, আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন সাজিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ইতিহাস
তালেবানের আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৪ সালে, আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারের আশপাশে। পশতু ভাষায় ‘তালেবান’ শব্দের অর্থ ছাত্র।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা সরে যাওয়ার পর ও তাদের সমর্থিত সরকারের পতনের পর আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে যে কয়েকটি অংশর মধ্যে গৃহযুদ্ধ বেধেছিল, তালেবান ছিল তার একটি।
গোষ্ঠীটি গত শতকের ৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়া তথাকথিত ‘মুজাহিদীন’ যোদ্ধাদের অনেককে আকৃষ্ট করেছিল।
গঠিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যেই তালেবান রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল; ১৯৯৬ সালে তারা নিজেদের দখলকৃত অংশে ‘ইসলামী আমিরাত’ ঘোষণা করে, চালু করে কট্টর শরিয়া আইন। অন্যান্য মুজাহিদীন দলগুলো পিছু হটে দেশের উত্তরাঞ্চলে চলে যায়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পর নভেম্বরে উত্তরে থাকা ওই বাহিনীগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক বিমান হামলার সহায়তা নিয়ে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
তালেবান যোদ্ধারা আশ্রয় নেয় আফগানিস্তানের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায়, শুরু করে আফগান সরকার ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে ২০ বছরের দীর্ঘ লড়াই।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরও গা-ঢাকা দেন। তার আস্তানা কোথায় কিংবা তিনি কোথায় অবস্থান করছেন, তা এতটাই গোপন ছিল যে, ২০১৩ সালে তার মৃত্যু হয়েছিল এই খবরও জানা যায় দুই বছর পর। তার ছেলেই বাবার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিলেন।
দর্শন
ক্ষমতায় থাকাকালীন ৫ বছরে আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশে কঠোর শরিয়া আইন চাপিয়ে দিয়েছিল তালেবান প্রশাসন। নারীদের যে কেবল পড়ালেখা বা চাকরি করার সুযোগ ছিল না তা-ই নয়, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া তারা ঘরের বাইরেও বের হতে পারতেন না।
জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড বা চাবুক মারা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পশ্চিমা চলচ্চিত্র ও বই ছিল নিষিদ্ধ। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘হারাম’ এমন সব সাংস্কৃতিক নিদর্শনও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।
গোষ্ঠীটি এবারও তাদের দখল করা এলাকাগুলোতে একই ধরনের শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে বলে বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও পশ্চিমা দেশগুলো অভিযোগ করেছে। তবে তালেবান নেতারা এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
চলতি বছরের শুরুতে গোষ্ঠীটি বলেছিল, তারা আফগানিস্তানজুড়ে ‘সত্যিকারের ইসলামিক ব্যবস্থা’ গড়ে তুলতে চায় যেখানে ধর্মীয় রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কিত নানান বিধিবিধান থাকবে।
সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দখল করা বেশকিছু এলাকার শাসনপদ্ধতিতে অবশ্য ওই আশ্বাসের ছাপ দেখা যাচ্ছে না; অনেক এলাকাতেই তারা নারীদের কাজ করতে বাধা দেওয়া শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
দুই দশক আগেও যখন ক্ষমতায় ছিল, পাকিস্তানসহ মাত্র ৪টি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল তালেবান সরকার। জাতিসংঘসহ বেশিরভাগ দেশের স্বীকৃতি গিয়েছিল কাবুলের উত্তরের প্রদেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া একটি গোষ্ঠীর পকেটে।
জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক বাহিনীর প্রস্থানের পর গোষ্ঠীটি ফের ক্ষমতার দুয়ারে পৌঁছে গেলেও তাদেরকে কূটনৈতিকভাবে স্বীকার করে নেওয়া হবে, বেশিরভাগ দেশের কাছ থেকেই এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন চলতি মাসের শুরুতে বলেছিলেন, তালেবান যদি ক্ষমতা নেয় এবং ফের বর্বরতা শুরু করে তাহলে দেশটির ‘বন্ধুহীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার’ শঙ্কা থাকছে।
চীন তালেবানকে আফগানিস্তানের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বাকিদের মধ্যে কারা কী অবস্থান নেবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।