এনসিপি-বিএনপি বাকযুদ্ধ: বিরোধ নাকি শক্তি প্রদর্শনের কৌশল?
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রার্থী বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ না পড়ানো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভূমিকা ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার ও বুধবার রাজধানীতে পালিত হয়েছে বিক্ষোভ, অনুষ্ঠিত হয়েছে সংবাদ সম্মেলন। একদিকে বিএনপি, অন্যদিকে সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) -দুই দলের ঘোষিত সরকারবিরোধী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও, প্রকাশ্যে এসেছে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক অবিশ্বাস।
গত এক সপ্তাহ ধরে নগর ভবনের সামনে ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের অবস্থান কর্মসূচি চললেও বুধবার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে কাকরাইল ও মৎস্য ভবন এলাকা। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সড়কে অবস্থান নেয়া বিক্ষোভকারীরা যান চলাচল বন্ধ করে দেয়, যার প্রভাব পড়ে হাইকোর্ট ও আশপাশের এলাকায়।
বুধবার সকালে ইশরাক হোসেন তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে কর্মীদের উদ্দেশে লিখেছেন- “নির্দেশ একটাই, যতক্ষণ দরকার রাজপথ ছেড়ে উঠে আসা যাবে না।”
বিএনপির অবস্থান:
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রয়োজনে দলগতভাবে ইশরাকের আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, বিএনপি ইশরাক ইস্যুকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে শক্তি প্রদর্শনের কৌশল নিয়েছে। তিনি বলেন, “নির্বাচনের পাঁচ বছর পর ‘মীমাংসিত’ একটি ইস্যু নিয়ে রাজপথে নামা বিএনপির শো-ডাউনের রাজনীতির অংশ। সরকার যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কালক্ষেপণ করে, তাহলে এর জবাবে আন্দোলনের গতি বাড়াতে চায় বিএনপি।”
এনসিপির পাল্টা বিক্ষোভ ও অভিযোগ:
একই ইস্যুতে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বাংলামোটরে দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলে এনসিপি। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়- “২০২০ সালের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অবৈধ নির্বাচনই আজকের সংকটের সূত্রপাত। ইসি শুরু থেকেই নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে দলের নেতা আখতার হোসেন বলেন, “নির্বাচনে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ইসি একতরফা রায় দিয়েছে, মামলায় পক্ষ হয়েও লড়াইয়ে যায়নি। এতে বাদীপক্ষ বিশেষ সুবিধা পেয়েছে।”
এর জেরে এনসিপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয় এবং মঙ্গলবার সকাল থেকেই নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করা হয়। ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ।
বাকযুদ্ধের রূপরেখা
এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ইসিকে ‘বিএনপির দলীয় কার্যালয়’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “এই কমিশন এখন বিএনপির মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। যতদিন বেঁচে থাকব, এই ইসি পুনর্গঠন করেই ছাড়ব।”
তিনি আরও বলেন, “বিএনপি ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মুজিববাদী সংবিধান রাখতে চায়। আমরা সংবিধান পোড়ানোর কর্মসূচি দিতেও প্রস্তুত।”
এ বক্তব্যে বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও সংবিধানও বিরূপ সমালোচনার শিকার হয়।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও জামায়াত প্রসঙ্গ
জুলাইয়ের ঘোষিত গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত এনসিপি ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক আলোচনায় শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। দলটি জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে মতবিরোধেও জড়িয়েছে। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের এক ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতারা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, “জুলাই অভ্যুত্থানের পরও বিএনপির অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখানেই এনসিপির সঙ্গে তাদের পার্থক্য। অন্যদিকে জামায়াত আপাতত নীরব দর্শক হয়ে আছে।”
তিনি আরও বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারসাম্যের চেষ্টা করছে। কিন্তু এই ভারসাম্য রক্ষা কতদিন সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।”
ইশরাক হোসেনকে কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক বিতর্ক এখন আর শুধুই মেয়র পদ নিয়ে নয়। এটি রূপ নিয়েছে দুই সরকারবিরোধী শক্তির পারস্পরিক অবিশ্বাস, রাজনৈতিক অবস্থান ও শক্তি-পরীক্ষার ময়দানে। যেখানে নির্বাচন কমিশন, অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জটিলতাই রাজনীতিকে করে তুলছে আরও অনিশ্চিত ও দ্বিধান্বিত।