এভাবে হাতির বেঁচে থাকা বিরল
ভারতের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে ভেসে আসা বুনো হাতিটিকে প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় ফিরিয়ে দিতে পারলে পরে গলদঘর্ম বা জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। আগুন জ্বালিয়ে ঢোল-ডগর বাজিয়ে কাজটি করা যেত। এমনটাই মনে করেন দেশের বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, প্রথম দিকে হাতিটি উদ্ধারে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঘাটতিও ছিল। যখন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তত দিনে সীমানা পেরিয়ে হাতিটি অনেক দূর চলে এসেছে। তবে ওই বন্য হাতিটিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে সহনশীল থেকে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, খাবার সরবরাহ করেছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। ভারতীয় প্রতিনিধিরা চলে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের মানুষের সহনশীলতার প্রশংসা করে গেছেন।
এদিকে ভারতীয় হাতি উদ্ধার নিয়ে দেশব্যাপী তুমুল আলোচনার মধ্যে আজ শুক্রবার সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হাতি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘হাতি সহযোগিতায় বিশ্বকে একত্র করা’। বাংলাদেশে হাতি এখন একটি বিপন্ন প্রাণী। শিল্পায়নের নামে তাদের আবাসন ধ্বংস করে ফেলা, খাদ্য ও নিরাপত্তা কমে আসা, পাচারসহ নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে হাতি। বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত দেশে মানুষের হাতে ৪২টি হাতি মারা গেছে। আর আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে এখন ২০০টির মতো হাতি রয়েছে; যদিও হাতির সংখ্যা নিয়ে নতুন একটি জরিপের কাজ এরই মধ্যে শেষ করেছে আইইউসিএন। সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয়ের সহকারী বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ সুলতান আহমেদ বলছেন, হাতির সংখ্যা কমছে না বেড়েছে, সেটি ফলাফল ঘোষণার আগে জানা যাবে না। তবে সার্বিক যে অবস্থা তাতে হাতির সংখ্যা বাড়ছে, তা বলা মুশকিল।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে হাতি আসার অভিজ্ঞতা নিকট অতীতে আরো কয়েকবার হয়েছিল। ২০০০ সালের দিকে ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে দলছুট হয়ে তিনটি বুনো হাতি বাংলাদেশের সীমানায় চলে আসে। তখন স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় তিনটি হাতিকে ভারতের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল; যদিও ভারতে নেওয়ার সময় একটি হাতি মারা যায়। বন্য হাতি যখন একটি দেশের সীমানা পেরিয়ে অনেক দূরে চলে আসে তখন তাকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যায়। কুড়িগ্রাম দিয়ে ঢুকে পড়া হাতিটির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এ ধরনের স্থলচর জন্তু উদ্ধারে যে ধরনের উদ্ধার যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত জনবল ও উপকরণ থাকার কথা, দেশের বন বিভাগের কাছে সে ধরনের উপকরণ নেই বলেও মত দেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাতি ছাড়া অন্য যেকোনো প্রাণী হলে তাকে উদ্ধারে এত সময় লাগত না। হাতি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ স্থলচর প্রাণী। তাই তাকে অজ্ঞান করা কঠিন। কারণ গত ৪৫ দিন সে সারাক্ষণ পানির মধ্যেই ছিল। তা ছাড়া ওই সময় পুরো উত্তরবঙ্গে চলছিল বন্যা। শুকনো জায়গায় সে একবারের জন্যও ওঠেনি। বন্যার মধ্যে এত বড় আকারের একটি হাতিকে বেহুঁশ ও অচেতন করতেও অনেক সময় লাগে। আর অচেতন করলেই তো হবে না; এই হাতিকে নদী কিংবা জলাশয় থেকে উঠিয়ে ট্রাক কিংবা ট্রেনে ওঠানো অসম্ভব।’
বন বিভাগের এক কর্মকর্তা ভারতীয় প্রতিনিধিদের উদ্ধৃতি দিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, আসাম থেকে বাংলাদেশে আসার আগে বুনো হাতিটি অন্তত এক হাজার কিলোমিটার হেঁটেছে। বাংলাদেশে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্ত দিয়ে ঢোকার পর থেকে গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ হয়ে আবার জামালপুরে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এখন পর্যন্ত ৮০০ কিলোমিটার হেঁটেছে। সব মিলিয়ে এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে হাতিটির। এতে হাতিটি এখন পুরোপুরি দুর্বল। তবে সুস্থ। তাকে উদ্ধার করে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে নিয়ে আসার কথা রয়েছে।
প্রধান বন সংরক্ষক ইউনূস আলী বলেন, ‘যাঁরা বলেছেন প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই হাতিটিকে সে দেশে পাঠানো যেত, তাঁদের মতের সঙ্গে আমি একমত নই। এ ছাড়া উপকরণ ও যন্ত্রপাতির অভাব আছে, আমি সেটিও বলব না। তবে অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। এটা ভারতেরও আছে।’
আজ বিশ্ব হাতি দিবস : বিশ্ব হাতি দিবস উপলক্ষে সারা বিশ্বে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও বাংলাদেশের বন বিভাগ দিবসটি উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করেনি। এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের কর্মকর্তা অসিত রঞ্জন পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা একটি হাতিকে এ রকম বিপন্ন অবস্থায় রেখে হাতি দিবস পালন করলে খারাপ দেখা যায়। সে জন্য আপাতত কোনো অনুষ্ঠান করছি না। ভারত থেকে আসা হাতিটিকে উদ্ধারের পর করা সম্ভব হলে করব।’ আইইউসিএনের সর্বশেষ এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যেতে হাতির ১২টি করিডর বা পথ রয়েছে। আর ট্রান্সক্রসিং পয়েন্ট আছে ৩৯টি। ভারতের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত হাতি আসা-যাওয়া করে; যদিও ভারতের দেওয়া কাঁটাতারের কারণে হাতিদের চলাচলে সমস্যা হচ্ছে।