Connecting You with the Truth

কাশ্মীর হামলা: কেমন হতে পারে ভারতের জবাব, ইতিহাস কী বলছে?

কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের ভয়াবহ হামলায় নিহত হয়েছে অন্তত ২৬ জন নিরীহ পর্যটক। হামলার পেছনে কাদের হাত, সে প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট না হলেও ভারতের আঙুল ফের পাকিস্তানের দিকেই। এরই মধ্যে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান দাবি করেছে—“বিশ্বস্ত গোয়েন্দা তথ্য” অনুযায়ী, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত তাদের ওপর সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে।

অন্যদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতোমধ্যেই একাধিক উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই ঘটনাগুলো একসাথে মিলিয়ে ইঙ্গিত করছে—দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছাতে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, ভারত কী ধরনের জবাব দিতে পারে? আর ইতিহাস আমাদের কী শিক্ষা দেয়?

গোপন অভিযানের পুনরাবৃত্তি?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গোপন সামরিক অভিযানের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর সংঘটিত এমন অনেক অপারেশনের কথা সরকারি ভাবে স্বীকার করা হয়নি, তবে সেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে।

এইসব অভিযানের মূল লক্ষ্য হয় সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস করা, সেনা হত্যা কিংবা শত্রুপক্ষকে বার্তা দেওয়া। তবে এগুলো ‘অঘোষিত’ হওয়ার ফলে কূটনৈতিক উত্তেজনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে, কারণ প্রতিপক্ষ প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানায় না।

পেহেলগামের হামলার পর এমন একটি ‘শান্ত কিন্তু ধারালো’ প্রতিক্রিয়া ভারতের পক্ষ থেকে আসতে পারে।

সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পথে?

২০১৬ সালে উরির সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার পর ভারতের সেনাবাহিনী ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, সীমান্ত পার হয়ে জঙ্গি ‘লঞ্চ প্যাড’ ধ্বংস করা হয়েছে।

এই স্ট্রাইক প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়—মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ এবং বিশ্ববাসীর সামনে শক্ত বার্তা দেওয়ার কৌশল হিসেবে। বর্তমানে বিজেপি সরকার ২০২৯ সালের নির্বাচনের আগে একটি দৃঢ় প্রতিরক্ষা চিত্র উপস্থাপন করতে চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে আরেকটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সম্ভাবনার বাইরে নয়।

বিমান হামলার নজির: বালাকোট

২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলায় সন্ত্রাসীদের আস্তানায় আঘাত করার দাবি করে ভারত। যদিও পাকিস্তান বলেছিল, হামলা একটি নির্জন বনভূমিতে হয়েছিল এবং কেউ নিহত হয়নি।

ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে ওই হামলা হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিও কিছুটা মিল রয়েছে—আসন্ন নির্বাচন, জাতীয় আবেগ ও পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে। তাই আবারও বিমান হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কাশ্মীর পুনর্দখলের অভ্যন্তরীণ চাপ

গত কয়েক বছরে বিজেপি ও তাদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর (PoK) পুনর্দখলের দাবি জোরালো হয়েছে।

পেহেলগাম হামলার পর এই দাবি আবারও সামনে এসেছে। এমনকি বিরোধী দল কংগ্রেসের মধ্য থেকেও এ বিষয়ে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

যদিও পুরো অঞ্চল দখলের চেষ্টা একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধকে আহ্বান জানাবে, তবুও এটা এখন আর কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়, বরং সম্ভাব্য নীতিগত পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

নৌবাহিনীর শক্তি প্রদর্শন

পেহেলগাম হামলার পরপরই ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্র থেকে পরীক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।

তাদের বক্তব্য, “যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময় দেশের স্বার্থ রক্ষায় প্রস্তুত।” বিশ্লেষকদের মতে, এটা আসলে পাকিস্তানকে সতর্ক বার্তা—জলপথেও ভারত আঘাত হানতে সক্ষম।

নৌবাহিনীর একটি ‘প্রতীকী হামলা’ বা বন্দর, জাহাজঘাঁটি লক্ষ্য করে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ: ইতিহাস যা বলে

ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ৭৮ বছরে মোট চারবার সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালের যুদ্ধগুলো ছিল মূলত কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে।

দুই দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, তাই সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকলেও, বড়সড় সামরিক সংঘাত একেবারেই অসম্ভব নয়।

বিশ্লেষকদের মতে, উভয় পক্ষ যদি উত্তেজনা প্রশমনে রাজি না হয়, তাহলে “নিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ” শুরু হয়ে পরবর্তীতে তা বড় আকার নিতে পারে।

উপসংহার: কী অপেক্ষা করছে সামনে?

ভারতের প্রতিক্রিয়া একাধিক মাত্রায় আসতে পারে—গোপন অপারেশন, প্রকাশ্য স্ট্রাইক, সীমিত বিমান হামলা কিংবা কূটনৈতিক পদক্ষেপ। তবে বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়া দুটি পারমাণবিক রাষ্ট্রের জন্যই বিপজ্জনক।

নরেন্দ্র মোদী সরকার কী রাজনৈতিক লাভের কথা ভেবে সামরিক ঝুঁকি নেবে, না কি কূটনৈতিক চাপে শান্তিপূর্ণ পথে যাবে—তা সময়ই বলবে। তবে অতীত বলে, প্রতিবার বড় হামলার পর ভারত কোনো না কোনোভাবে জবাব দিয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Comments