Connecting You with the Truth

ক্রিকেট উন্মাদনা কি জাতিকে বুঁদ করে দিচ্ছে?

আতাহার হোসাইন

আমাদের দেশপ্রেম কেন জানি হাওয়াভর্তি বেলুনের মতো মনে হয়। দেখতে অনেক বড়, আদতে অন্তঃসারশুন্য। ক্রিকেট নিয়ে আমরা যা করলাম এই কয়দিন! শত্র“-মিত্র প্রায় গলাগলি। পরীক্ষার সময় হরতাল অবরোধ যেখানে শিথিল হয় না, মানুষ মরে কয়লা হলেও, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বসে গেলেও যেখানে ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি চলমান থাকে সেখানে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারায় বিজয় উৎসব করার জন্য কর্মসূচিতে বিরতি টানা হয়েছিল। জেল-জুলুমে জর্জরিত দলের নেতারাও পথে নেমে বিজয় উৎসব করছিলেন। উৎসবের এ উন্মাদনায় শরীক হয়েছিলেন সরকারি দলের নেতা-কর্মীরাও। সকলেই যখন বিজয়ের উন্মদনায় নেচে-গেয়ে রাজপথ মুখরিত করে রাখছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার একদল মানুষ বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছিল, তাদের কারও শরীর ৩০  ভাগ দগ্ধ, কারও ৫০, কারওবা ৭০ কিংবা ৮০। তাদের কোনো বিজয়ানন্দ নেই, উন্মাদনা নেই, আছে কেবল ঘৃণা, ধিক্কার আর অবচেতন মনের অভিশাপ। কিন্তু তাতে কী, তাদের কাতরতা-আর্তনাদ এ জাতির উন্মাদনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে নি। সকলের কণ্ঠে এক সুর- জিতেছে রে জিতেছে, বাংলাদেশ জিতেছে! এইটুকু মাত্রা পর্যন্ত খুব কষ্টে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যখন এই বিজয়কে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের যুদ্ধ জয়ের সাথে তুলনা করা হয়, দুই-আড়াইশত বছরের অত্যাচার-অবিচার, শাসন-শোষণের জবাব বলে আখ্যা দেওয়া হয়, পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ বলে মনে করা হয় তখন জাতি হিসেবে আমাদের বোধ-বুদ্ধির গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় দোষের কিছু থাকে না।
নাসির জামশেদ নামে একজন পাকিস্তানি ক্রিকেটারের ফেক একাউন্ট থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটার রুবেলকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য এবং বাঙালির বিজয় উৎসবকে ৭১ এর বিজয় উৎসব এবং ভারতের সহায়তা ছাড়া বিজয়ের সাথে তুলনা করায় আমাদের সম্মানে আঘাত লেগেছে। ফেসবুক-ব্লগের নিউজফিডে এখনও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বন্যা বইছে। পাকিস্তানি ওই ক্রিকেটারকে নিয়ে দেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে নিউজের পর নিউজ হয়েছে। এমনকি একটি জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল তো নাসির জামশেদের ব্যক্তিগত জীবনী ঘেটে সে কবে কবে শাস্তি পেয়েছিল তা নিয়েও সংবাদ করে ফেলেছে। ভাল কথা। এতে করে বোঝা গেল যে, জাতি হিসেবে আর যাই হোক আমাদের সম্মানবোধটা অক্ষুন্ন আছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- ভারতীয় সংবাদমাধ্যম (স্যাটায়ার নয়) জি নিউজ রুবেলকে কটাক্ষ করে একটা নিউজ করলেও এ ব্যাপারে কারও তেমন কোনো উচ্চবাচ্চ দেখা গেল না! তবে কি আমাদের সম্মানবোধ কেবল নির্দিষ্ট একটি দেশের মানুষের কথাতেই জাগ্রত হয়? এ আমাদের কেমন দেশপ্রেম?
ওই দূর দেশের শত্র“দের সীমান্ত বাহিনীতো আমাদের দেশের সাধারণ গরু ব্যবসায়ীদেরকে গুলি করতে পায় না, উলঙ্গ করে পিটায় না, সীমানা অতিক্রম করে এসে ধরে নিয়ে যায় না। আমাদের দেশকে অনুগত করে ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতায় আমাদের সফলতা দেখে না হয় কিছু ক্ষোভের প্রশমন ঘটায় রমিজ রাজারা। কিন্তু তারাতো শারীরিকভাবে কিছু করতে পারে না। কিন্তু যারা প্রতিবেশী হয়ে, বন্ধুর বেশে আমাদেরকে গুলি করে, হত্যা করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের উপযুক্ত প্রতিবাদ কই? তাদের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধেও কেন আমরা টু শব্দটি করতে পারি না? আমরা আসলেই কি দেশপ্রেমিক হতে পেরেছি?
আমরা এত আবেগপ্রবণ কেন? ক্রিকেটে একটি দেশেকে হারানো কি কখনো যুদ্ধ করে দেশ জয়ের মত বিষয়? ধরা যাক, সামনের ম্যাচে আমরা ভারতকেও হারাতে সক্ষম হলাম, তাতে কী আমরা বিএসএফের হাতে নির্যাতিত হওয়া থেকে মুক্তি পাব? না, মোটেও তা নয়। খেলা তো খেলাই, স্রেফ বিনোদনের বিষয়। এটাকে এত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করার মাধ্যমে কেবল আমাদের মানসিক দৈন্যতাই প্রকাশ পাচ্ছে। জায়গামত কিছু করতে না পারার অব্যক্ত বেদনা আমরা ঢাকতে চাই ক্রিকেটে জয়ী হয়ে। অথচ মানসিক দিক দিয়ে সর্বদা আমরা ব্রিটিশদেরই গোলামী করছি। বর্তমানে আমাদের দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হানাহানি, সন্ত্রাস চলছে সে ব্যাপারে ব্রিটিশদের অবস্থান পরিষ্কার নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, তারা কোনোদিনও চায় না আমরা জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকি, শান্তিতে থাকি। কেননা ঐক্যবদ্ধ জাতির উপর খবরদারি করা যায় না, মোড়লীপনা চলে না। আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ঠিক যে মুহূর্তে আমরা হাজার হাজার মানুষ একত্র হয়ে ব্রিটিশদের হারিয়ে দেওয়ার বেলুনে বাতাস ভরছি, উন্মাদনায় গা ভাসিয়ে নাচানাচি করছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই তারা এই দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নতুন কোনো ছক আঁকছে না? তারা বারবার আমাদেরকে বাস্তবের মাঠে হারিয়েছে, এখনও হারাচ্ছে, কাজেই খেলার মাঠের একটি জয় নিয়ে এতটা আত্মহারা হবার কারণ নেই। ক্রিকেটের বিজয় উল্লাস হবে, সেই সাথে এটাকেই প্র্যাকটিক্যাল বিজয় ধরে নিয়ে মগ্ন না হয়ে দেশকে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ঐক্যবদ্ধ করে তুলে আসল বিজয়ের দিকে ধাবিত হওয়াই হবে আমাদের দেশপ্রেমের প্রকৃত নিদর্শন। কিন্তু তা না করে যদি হালকা একটি বিষয়কে নিয়ে আমরা এত মাতামাতি করতে থাকি তাহলে এই সস্তা আবেগ ধীরে ধীরে আমাদেরকে আফিমের মত বুদ করে দেবে। বিশ্বের বুকে আমরা একটা হাস্যকর আবেগসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হবো। এই আফিম থেকে আমাদের মুক্তি মিলুক।

Comments
Loading...