ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাত হানতে পারে আজ
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আরো শক্তিশালী হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রোয়ানু আরো ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আজ শনিবার বিকাল বা সন্ধ্যা নাগাদ বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়োহাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ?সংকেত এবং কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ?সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪-৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
প্রস্তুতি : এদিকে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ক্ষতি মোকাবিলায় গতকাল শুক্রবার রাত ৮টার মধ্যে উপকূলীয় এলাকার মানুষজনকে সরে যেতে বলেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এরই মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল। তিনি বলেন, রাত ৮টার মধ্যে তাদের সরিয়ে নিতে সারাদেশে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ১৮ জেলার সাড়ে ২১ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে এমন ১৮টি জেলার ৩ হাজার ৮৫১টি আশ্রয়কেন্দ্রে এসব মানুষকে আনা হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা, খাওয়া ও চিকিত্সার সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদিকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী সকল ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর কারণে গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে দক্ষিণাঞ্চলগামী ৩৭টি রুটসহ সারাদেশে যাত্রীবাহী সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। আবহাওয়ার পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এটি বলবত্ থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তত্সংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৬০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৪০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭০৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরো ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আজ শনিবার বিকাল/সন্ধ্যা নাগাদ বরিশাল-চট্রগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
শাহ কামাল বলেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে ৫৫ হাজার। এছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রোভার স্কাউট ও আনসার ভিডিপিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশাল কর্মীবাহিনী রয়েছে।
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু মোকাবিলায় চট্টগ্রামে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। গতকাল রাতেই জেলার ৪৭৯টি সাইক্লোন শেল্টার খুলে দেওয়া হয়েছে এবং উপকূলীয় এলাকাগুলোতে মাইকিং শুরু হয়েছে। লোকজনকে সাইক্লোন শেল্টারে চলে যেতে বলা হয়েছে।
সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে নিয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
কক্সবাজার প্রতিনিধি জানায়, কক্সবাজারে সাগর উত্তাল রয়েছে। গভীর সাগরে থাকা ফিশিং ট্রলারসমূহ ঘাটে ফিরে এসেছে। রোয়ানু মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে কক্সবাজারের প্রশাসন। নিচু এলাকার লোকজনকে নিরাপদে চলে আসার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। বাতিল করা হয়েছে সব সরকারি কর্মকর্তার ছুটি। সহকারী আবহাওয়াবিদ এ.কে.এম নাজমুল হক জানান, ভারী বর্ষণের ফলে কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় ও পূর্ণিমার প্রভাবে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর এবং সকল নদ-নদী ফুঁসে উঠেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে কলাপাড়া চরাঞ্চলসহ নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপকূল জুড়ে বৃহস্পতিবার রাত থেকে দমকা হাওয়া ও মাঝারি এবং ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
মংলা (বাগেরহাট) সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আশঙ্কায় পশুর চ্যানেলে অবস্থানরত ১১টি জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ মোকাবিলায় আগাম সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে পৃথক ৪টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
বরিশাল অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বৈরী আবহাওয়ায় বরিশাল-ঢাকা রুটসহ অভ্যন্তরীণ সকল রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই ব্যাপক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এদিকে রোয়ানু মোকাবিলায় নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বরিশাল ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিসি)।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, রোয়ানুর প্রভাবে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল শুক্রবার দিনভর নোয়াখালীতে হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস জানান, জেলার সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়াসহ উপকূলীয় এলাকার ২৫১টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, গত দুই দিন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ প্রভাবে সৃষ্ট বৈরী আবহাওয়া ঝড়ো বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে নিম্ন এলাকায় ২/৩ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২ দিন টানা বর্ষণে মঠবাড়িয়ার নদ তীরবর্তী জেলে পাড়াসহ কয়েকটি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাদিক মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা পোনে ছয়টা থেকে কর্তৃপক্ষ পূর্ব সতর্কতামূলক এ নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়।