ধর্মবিশ্বাস: এক বৃহৎ সমস্যার সহজ সমাধান
শুরুতেই কয়েকটি মৌলিক ও অকাট্য সত্যের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। সেটা হচ্ছে,
১) বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধর্মকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই কেননা বিশ্বরাজনীতিতে ধর্ম এখন প্রধান নিয়ামক (Prime factor), এক নম্বর বিচার্য বিষয় (First issue)। ধর্ম থেকেই সৃষ্ট জঙ্গিবাদ যা বর্তমানের মানবজাতির ক্যান্সার হিসাবে বিবেচিত, ভোটের রাজনীতিতে ডানপন্থী ও রক্ষণশীল দলগুলোর প্রধান হাতিয়ারও সেই ধর্ম। পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পালে দমকা হাওয়া লেগেছে যা সেক্যুলার দলগুলোর জন্য প্রধান সংকট বলে মনে করা হচ্ছে।
২) পশ্চিমা বস্তুবাদী ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্মকে একেবারে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করার যে চিন্তা ও চেষ্টা করা হয়ে থাকে সেটা বাস্তবমুখী নয়, কারণ পৃথিবীতে গুটিকয় নাস্তিক ছাড়া আর সকলেই স্রষ্টার অস্তিত্বে, কোনো না কোনো ধর্মে এবং পরকালীন জীবনে বিশ্বাস রাখে। তাদের এ বিশ্বাস অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে যা প্রতিনিয়ত তাদের চিন্তা-চেতনা ও কার্যকলাপে প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে ধর্মের প্রকৃত রূপ হারিয়ে যাওয়ায় বিকৃত ধর্মগুলো মানুষের জন্য শান্তিদায়ক নয়, উপরন্তু ধর্ম নিয়ে হাজারো অপকর্ম ও বিকৃতি প্রচলিত আছে বিধায় অনেক মানুষ ধর্মীয় আচার-আচরণ ও পুরোহিত-আলেমদের ধ্যান-ধারণার প্রতি বিরক্ত, অনেকেই ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা হারিয়েছে কিন্তু নাস্তিক হয় নি। সুতরাং ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিজীবনে নির্বাসিত করে রাখার চিন্তা করা ভুল। রাষ্ট্রের প্রথম উপাদান হচ্ছে মানুষ, সেই মানুষের চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাস থেকে ধর্মকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালানোর পথ হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
আমরা যদি বিভিন্ন মতবাদের তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে আপাতত বাদ রেখে একটু বাস্তবতার দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, চলমান দুনিয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে বড় বড় সমস্যাগুলো বিরাজ করছে সেগুলোর উৎপত্তি ধর্মকে কেন্দ্র করেই। মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিষ্ট ধর্ম মানুষের জাতীয় জীবনের সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান দিতে পারছিল না, অথচ ধর্মযাজকগণ ছিলেন প্রবল ক্ষমতার অধিকারী। তখন রাজা আর চার্চের মধ্যে, ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে তুমুল সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনোভাবে সমন্বয় করতে না পেরে নিরুপায় রাষ্ট্রনায়কগণ ধর্মকে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন, এরই পারিভাষিক নাম ধর্মনিরপেক্ষতা। সাধারণ মানুষের ধর্মপ্রাণতা আর রাজনীতিকদের ধর্মহীন রাষ্ট্রের চিন্তাধারার বিপরীতমুখী এ যাত্রা আজও আমাদের জীবনে নিত্যনতুন সংঘাত আর সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটিয়ে যাচ্ছে। এটা এখন রাষ্ট্রনায়কদের বড় মাথা ব্যথার কারণ যে, ধর্মকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না, আবার ধর্মজীবীদের হাতে দেশকে তুলেও দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ নানাবিধ কারণে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন তা এদের মধ্যে গড়ে ওঠে নি। তাদের হাতে রাষ্ট্রশক্তি গেলে সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভয়াবহ রূপ নেবে, বিকৃত ধর্মের কারণে মানুষ অন্ধত্ব, পশ্চাৎপদতার গহীনে নিমজ্জিত হবে। এক কথায় আরেকটি মোল্লাতান্ত্রিক তালেবানি রাষ্ট্র (Theocracy) কায়েম হবে যা সাধারণ মানুষের কাম্য নয়। মানবজাতিকে বহুল উচ্চারিত যে প্রশ্নের সমাধান এখন করতে হবে তা হলো:
রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মকে নিয়ে কী করা হবে?
এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে: যুগে যুগে ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণে, তাই ধর্মকে মানুষের কল্যাণেই কাজে লাগাতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ, ধর্মকেও যদি আমরা একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করি তাহলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ঘুঁচে যাবে, ধর্ম ও রাষ্ট্র হাত ধরে পথ চলবে এবং স্বভাবতই মানবজাতির সকল অন্যায় অশান্তির সমাধান হয়ে যাবে।
সর্বপ্রথম পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, প্রচলিত ধর্মগুলোই মানুষের জীবনে অনেকাংশে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এর কারণ এগুলো শত-সহস্র বছর ধরে বিকৃত হতে হতে বর্তমানের রূপ ধারণ করেছে এবং সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় সেগুলোকে পুঁজি করে বিভিন্ন ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এই ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত না হলে ধর্ম থেকে মানুষ আজও প্রভূত কল্যাণ লাভ করত। সামনে দু’একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করব। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে এক শ্রেণির ধর্মাশ্রয়ীর দ্বারা ধর্ম এখন মানুষের সামষ্টিক জীবনে কল্যাণের চেয়ে ধ্বংসই সাধন করছে বেশি। তাছাড়া বর্তমান জীবনব্যবস্থায় ধর্মকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তথাকথিত ভাব-গাম্ভীর্য আরোপ করে উপাসনা, পরলোকগত নেতাদের কবর জেয়ারত ও কোর’আন খানি, ঈদ, পূজা-পার্বণে বাণী দেওয়া, উপাসনালয় পরিদর্শন করা, হজ্ব-তাওয়াফ, চেহলাম, অনুষ্ঠানের শুরুতে তেলাওয়াত ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে সেখান থেকে উঠে এসে মানবসমাজে কল্যাণকর ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ ধর্মের নেই। আর ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের সঙ্গে কেবল আখেরাতের যোগাযোগ, পার্থিব জীবনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই, এভাবে ধর্মকে গুরুত্বহীন করে রাখা হলেও ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মকে অপব্যবহারকারী রাজনীতিকরা মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে যুগে যুগে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে এসেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যাকেও বৈধ করে ফেলা হয়েছে। এক সম্প্রদায়কে আরেক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধর্মের নামে গণহত্যা, গণধর্ষণ, সর্বস্বপহরণ করা হয়েছে। বহু জাতিই এমন নির্মমতার শিকার হয়েছে। ইহুদি জাতির কথা বলতে পারি। সেই ৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় দুই হাজার বছর এই ইহুদি জাতির ইতিহাস কী? তাদের ইতিহাস হচ্ছে এই যে, ইউরোপের যে দেশেই তারা আশ্রয় নিয়েছে, বসতি স্থাপন করেছে, সেই দেশের সমস্ত মানুষ তাদের অবজ্ঞা করেছে, ঘৃণা করেছে। অনেকে শুকরকে যেমন ঘৃণা করে- তেমনি ঘৃণা করেছে। শুধু ঘৃণা করেই তারা ক্ষান্ত হয় নি। কারণে-অকারণে মাঝে মাঝেই ইউরোপের খ্রিষ্টানরা দলবদ্ধ হয়ে ইহুদিদের বসতি আক্রমণ করে তাদের পুরুষদের হত্যা করে মেয়েদের বেঁধে নিয়ে গেছে, সম্পত্তি লুটপাট করে বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই কাজটা ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা প্রতিটি ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রে এতবার করেছে যে ইউরোপীয় ভাষায় একে বোঝাবার জন্য একটি নতুন শব্দেরই সৃষ্টি হয়েছে- Pogrom, যার আভিধানিক অর্থ হলো Organised Killing and Plundered of a Community of People, বাংলায় “সুসংগঠিতভাবে সম্প্রদায় বিশেষকে হত্যা ও লুণ্ঠন।” দু’হাজার বছর ধরে ইহুদিদের উপর ঐ Pogrom চালাবার পর শেষ Pogrom চালালেন হিটলার। তিনি ইউরোপের ইহুদিদের উপর চরম অত্যাচার করলেন ও ছয় মিলিয়ন অর্থাৎ ৬০ লক্ষ ইহুদিদের হত্যা করালেন (যদিও এ সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে)। একইভাবে একসময় সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কোপানলে ছারখার হয়ে গিয়েছিল মহামতি বুদ্ধের অনুসারীরা, পোপ দ্বিতীয় আরবানের ফতোয়ায় ক্রুসেডে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা, আবার ইউরোপের বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে স্পেন থেকে মুসলিমদের নির্মূল করে আটশ’ বছরের ইসলামি সভ্যতার নামগন্ধ মুছে ফেলেছিল,
বসনিয়াতে গণহত্যার পাশাপাশি দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করে সার্ব খ্রিষ্টানরা জারজ সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য করেছিল। একই জাতীয় চড়মৎড়স আজ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসরাইল ও পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ইরাকেই হত্যা করা হয়েছে ১০ লক্ষ মুসলিম। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা-ই মনে হোক না কেন এ সমস্ত হামলার পেছনে মূল ইন্ধন যে ধর্ম এ সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
এটা সম্ভব হয়েছে শুধু এজন্যই যে, ধর্ম খুব সংবেদনশীল একটি বিষয়, এ ব্যাপারে মানুষ খুবই অনুভূতিপ্রবণ। মানুষ তার হৃদয়ের গভীরে স্রষ্টা, ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, ধর্মপ্রবর্তকগণের প্রতি সযতেœ শ্রদ্ধা লালন করে। ধর্মের উপর আঘাত হানলে মানুষ উত্তেজিত হয়ে হেন কর্ম নেই যা করতে পারে না। এই উত্তেজিত করার কাজটি খুব নিপুণভাবে করতে পারে ধর্মের ধ্বজাধারী, লেবাসধারী পুরোহিত-আলেম শ্রেণি। এটা চরম সত্য যে, ধর্ম থেকে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে শুধুমাত্র ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা পার্থিব স্বার্থ ছাড়া ধর্মের কোনো কাজই করতে রাজি নয়। কিন্তু সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ধর্মকে পরকালীন জীবনের পথ ও পাথেয় মনে করে, ধর্মের প্রতিটি কাজ তারা করে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে। ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে হাতিয়ার হিসেবে মানুষের এই নিঃস্বার্থ ধর্মপরায়ণতাকে ব্যবহার করে, মানুষের ঈমানকে, ধর্মীয় চেতনাকে ওয়াজ করে উত্তেজিত করে ভুল পথে প্রবাহিত করে। কোটি কোটি ভোটার ভোটদানকালে তাদের ধর্মবিশ্বাস (ঈমান) দ্বারা প্রভাবিত হয়। ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষকে বলে যে, অমুক ব্যক্তি ইসলামের শত্র“, কাফের, তাকে হত্যা করলে সেটা আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ হিসাবে গণ্য হবে। অথবা বলে যে, অমুক দল ধর্মদ্রোহী, তাদেরকে মারলে জান্নাত নিশ্চিত, তাদের দ্বারা নিহত হলে শহিদ, বাঁচলে গাজি। মানুষ সরল বিশ্বাসে তাদের কথায় ভুল পথে পা বাড়ায় এবং হত্যাকাণ্ডসহ বিবিধ সহিংস ঘটনা ঘটায়। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে দিয়ে অধর্মের কাজ করানোর চেয়ে বড় পাপ ও প্রতারণা আর হতে পারে না। কারণ তাদের কথায় পবিত্র জেহাদ মনে করে আখেরাতে পুরস্কারের আশায় মানুষ ইসলাম তথা ধর্ম-পরিপন্থী কাজগুলো করে। কিন্তু বাস্তবে সে হয় চরম ক্ষতিগ্রস্ত। সে তার ইহকাল-পরকাল দুটোই হারাবে। আর যারা তাদের ঈমানকে হাইজ্যাক বা লুট করে এভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করবে, হাশরের দিন আল্লাহর কাছে তাদেরও জবাব দিতে হবে, সঙ্গে আরো বহু মানুষের পাপের বোঝাও তাদেরকে বহন করতে হবে। আল্লাহ তাদের সম্পর্কেই বলেছেন, আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল (সুরা বাকারা-১৭৫)।
কিন্তু সেটা তো আখেরাতের বিষয়, বর্তমানে এই ধর্মজাত ফেতনা থেকে আমাদের মুক্তির উপায় কী? এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষের ধর্মবিশ্বাস (ঈমান)-কে সঠিক পথে পরিচালিত করা। আবারও বলছি, ধর্মকে বাদ দেওয়া যাবে না, অবজ্ঞাও করা যাবে না বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে (To right direction) পরিচালিত করতে হবে। আমাদের দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানসহ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলেই কমবেশি ধর্মপ্রাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের একটি বিরাট অংশকে ইতোমধ্যেই ধর্মব্যবসায়ীরা বিভ্রান্ত করে ফেলেছে। সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আন্তধর্মীয় ভুল বোঝাবুঝি ও বিদ্বেষভাব এত প্রবলভাবে আছে যা বিশেষ বিশেষ ঘটনায় প্রকট আকার ধারণ করে। ১৯৪৭ এর দেশভাগ ছিল ধর্মভিত্তিক, কারণ ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের ফলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এতটাই নৃশংস রূপ ধারণ করেছিল যে, একটি ভূখণ্ডে বসবাস করা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তারপরও দাঙ্গা নিয়মিতই চলমান ছিল। একাত্তরে তার চরম রূপ আমরা দেখেছি যে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও সংখ্যালঘুদের উপর ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের এ সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান কারণই ছিল ধর্ম।
ধর্মীয় উন্মাদনা থেকেই জঙ্গিবাদের সূচনা হয়। জঙ্গিবাদ ও অপরাজনীতির ভয়াবহ পরিণাম আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ দেখে আসছি, নিকট অতীতেও (২০১৩) দেখেছি। ভবিষ্যতে যেন আমাদের দেশে আবারও কোনো প্রকার ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে জননিরাপত্তা ও দেশকে হুমকির মুখে ফেলতে না পারে, তাই যত দ্রুত সম্ভব ধর্মের এই অপব্যবহারের দ্বার রুদ্ধ করা উচিত। অতীতে দেখা গেছে- সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবন করেন নি, তারা ব্যাটন ও বুলেটের দ্বারা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন এমন মনোভাবই প্রদর্শন করেছেন। তারা ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্ররোচিত বৃহত্তর জনসংখ্যার ঈমানকে খাটো করে দেখেছেন, অবজ্ঞা করেছেন। ফল হয়েছে এই যে, ধর্মব্যবসায়ীরা দেশজুড়ে এমন অরাজক পরিস্থিতি, অচলাবস্থা ও গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যা বিশ্বময় সমালোচনার ঝড় তুলে দিয়েছে এবং এদেশের মানুষকে মৌলবাদী, উগ্রবাদী হিসাবে চিত্রিত করেছে, পাশাপাশি জনজীবনকে অসহনীয় দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তাই এ ধারণা করা বিরাট বড় ভুল যে, সাধারণ মানুষ অশিক্ষিত, কূপমণ্ডূক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মান্ধাতার আমলের বাসিন্দা। তাদের সেন্টিমেন্টকে খাটো করে দেখলে বিপর্যয় সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকেই যাবে। ধর্মীয় অনুভূতির চাবি আর কোনোভাবেই স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে রাখা যাবে না। রাখলে সিরিয়া, মিশর, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোতে যা হচ্ছে সেটা এখানেও যে হবে না তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে জুমার দিনে মসজিদগুলোতে পাহারা দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে- এ পরিস্থিতি ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু মানুষের ঈমানকে সঠিকপথে পরিচালিত করা হলে তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে মসজিদের মুসুল্লিদের পাহারা দিতে হবে না, বরং মুসুল্লিরাই বিনে পয়সায় আত্মা থেকে দেশ ও দেশের সম্পদ পাহারা দেবে।
ধর্মবিশ্বাসকে অস্বীকার করে কল্যাণ রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না। পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে আমাদের সমাজেও তথাকথিত মুক্তমনা, শিক্ষিত ও উন্নাসিক একটি শ্রেণির প্রাদুর্ভাব হয়েছে যারা বলে থাকেন ধর্ম কুসংস্কার, ধর্ম প্রাচীন যুগের সমাজপতিদের তৈরি করা জুজুর ভয়, স্রষ্টা বলতে কেউ নেই, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম সবই মানুষের কল্পনা। তারা ধর্মের প্রভাবকে, ধর্মের গন্ধকেও মানবজীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চান। রাষ্ট্রপরিচালকগণও অনেক ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাদের কথা ও কাজের দ্বারা যখন মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে তখনই সমাজে দাঙ্গা ও গোলোযোগ সৃষ্টি হয়। আমাদেরকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, এই তথাকথিত মুক্তমনারা যতই বলুন, বইয়ে আর ব্লগে লেখালিখি করুন না কেন, মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য, অধিকাংশ মানুষই এসব কথা শুনবে না। এ কথা বিগত কয়েক শতাব্দীতে শত শতবার প্রমাণিত হয়েছে। ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভবের পাশাপাশি নাস্তিক্যবাদেরও উদ্বোধন ঘটে যা কম্যুনিজমের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাসা বাঁধতে সক্ষম হয়। পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধর্মহীন, এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক যুগে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকেই ধর্মের প্রতি সন্দিহান করে তোলা হয়েছে, আর রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে তো বহু আগেই বাদ দেওয়া হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে কম্যুনিস্ট শাসনাধীন এলাকাগুলোতে নাস্তিক্যবাদী দর্শনের যে রমরমা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তাতে করে নাস্তিক্যবাদী চিন্তানায়ক ও রাষ্ট্রনায়করা ধারণা করেছিলেন যে এবার বুঝি স্রষ্টার ধ্যান-ধারণাকে মানুষের মন-মগজ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করা সম্ভব হবে। কিন্তু কার্যত সেটা সম্ভব হয় নি। কারণ,
ক) যিনি সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ সেই স্রষ্টার রূহ বা আত্মা প্রত্যেকের ভেতরে আছে। স্রষ্টাকে বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট রকম উপাদান প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেগুলো পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ আয়াত, নিদর্শন বা মো’জেজা বলেছেন। এসব দেখার পরও মানুষ অন্ধের মতো নাস্তিকে পরিণত হবে না। আল্লাহর নাজেলকৃত ধর্মগ্রন্থগুলোর বেশ কয়েকটি এখনও মানুষের কাছে আছে যেগুলো স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। মানুষ সেগুলো সম্মানের সঙ্গে পড়ছে, জানছে, বিচার বিশ্লেষণ করছে। এগুলোর স্বর্গীয় বাণীসমূহ মানুষের আত্মার গভীরে প্রভাব ফেলছে। অধিকাংশ মানুষ সেগুলোকে মাথায় করে রাখছে, সন্তানকে যেমন যতœ করা হয় সেভাবে যতœ করছে। সুতরাং মানবজাতিকে ধর্মহীন করে ফেলার চেষ্টা অপ্রাকৃতিক, বাস্তবতাবর্জিত, নিতান্তই অর্বাচীন ও মূঢ়তাসুলভ পরিকল্পনা।
খ) অতীতে হাজার হাজার হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর মানুষকে শান্তি দিয়েছে ধর্ম। এই ইতিহাস মানুষের জানা আছে। সময়ের সেই বিশাল ব্যাপ্তির তুলনায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির শাসনামল এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র এবং এগুলোর অভিজ্ঞতাও শান্তিময় নয়। ধর্মের শাসনে প্রাপ্ত সেই শান্তির স্মৃতি মানবজাতির মন থেকে মুছে যায় নি। অধিকাংশ মানুষ এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে একমাত্র স্রষ্টার বিধানেই শান্তি আসা সম্ভব। কাজেই যুগের হাওয়া তাদেরকে যতই অন্য দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক, তারা শান্তির আশায় বারবার ধর্মের পানেই মুখ ফেরায়। উপরন্তু প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে, শেষ যুগে (কলিযুগ, আখেরি যামানা, The Last hour), আবার ধর্মের শাসন বা সত্যযুগ প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ বৈরিতা থাকবে না, কোনো অবিচার, অন্যায় শোষণ থাকবে না, পৃথিবীটা জান্নাতের মত শান্তিময় (Kingdom of Heaven) হবে। এই বিশ্বাস থেকে অধিকাংশ মানুষ ধর্মের উত্থানই কামনা করে। এটা তাদের ঈমানের অঙ্গ, এ বিশ্বাস মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
গ) শান্তির আশায় ধর্মের পানে ছুটে চলা মানুষকে ফেরাতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন হবে ধর্মের বিকল্প এমন একটি জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন যা তাদেরকে সেই কাক্সিক্ষত শান্তি দিতে পারবে, একই সঙ্গে দেহ ও আত্মার প্রশান্তি বিধান করতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে কি সেটা মানুষ আজ পর্যন্ত করতে পারে নি এবং কোনো কালে পারবেও না। বহু চেষ্টা করেছে কিন্তু সবই মাকাল ফল। শান্তির শ্বেতকপোত গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক কারো হাতেই ধরা দেয় নি। ধরুন, যদি কোনো ব্যক্তিকে বলা হয় যে, তুমি কীভাবে মরতে চাও? গুলি খেয়ে না বিষ খেয়ে? বাঁচার কোনো পথ নেই, কেবল মরার জন্য দু’টো পথ। ঐ মানুষটিকে একটা না একটা পথ বেছে নিতেই হবে। মানুষের আবি®কৃত জীবনব্যবস্থাগুলোকে যত সুন্দর সুন্দর নামেই ডাকা হোক না কেন তা হচ্ছে মানবজাতির সামনে মৃত্যুর বিকল্প পথ। জীবনের পথ একটাই; আর সেটা হলো ধর্ম অর্থাৎ স্রষ্টাপ্রদত্ত দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। বর্তমান স্রষ্টাবর্জিত জীবনদর্শন মানুষকে কেবল নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর জীবন উপহার দিয়েছে। কাজেই মানুষ এখন জীবন রক্ষার আশায় ধর্মের দিকেই যেতে চাইবে, কেননা তাদের বস্তুত শান্তি দরকার। সুতরাং মানুষকে ধর্মহীন করার যে চেষ্টা করা হয় সেটা কোনোদিন সফল হয় নি, হবেও না। এখন একটাই করণীয়, মানুষের ঈমানকে, ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে চালিত করা। প্রথমেই কয়েকটি মৌলিক বিষয় মানুষকে জানাতে হবে যেমন- ধর্মের আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য মানবতার কল্যাণ। ধর্মব্যবসা সকল ধর্মে নিষিদ্ধ। ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে ধর্মব্যবসায়ীরা কীভাবে মানুষকে প্রতারিত করছে, কীভাবে মানুষের ইহকাল ও পরকালকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কীভাবে তারা মিথ্যা ফতোয়াবাজি ও ধর্মের অপব্যাখ্যা দ্বারা সমাজে অন্যায়, অশান্তি, দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার করছে আর নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে এসব বিষয় সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। এটা করতে পারলে তারা আর ভবিষ্যতে ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা উত্তেজিত হয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়াবে না। ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্মের অপব্যবহার থেকে বিরত হতে বাধ্য হবে। সমাজ ধর্মব্যবসার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। পাশাপাশি ধর্মের গায়ে লেগে থাকা অধর্মগুলোকে চিহ্নিত করে ধুয়ে ফেলে ধর্মকে নির্মল করতে হবে। ধর্মের সত্য ও সুন্দর রূপটিকে যদি মানুষের সামনে তুলে ধরা যায় তাহলে আলো ও অন্ধকার, সাদা ও কালো পৃথক হতে সময় লাগবে না।
অতঃপর মানুষের ঈমানকে ইতিবাচক পথে, ন্যায়ের পথে, মানবতার কল্যাণে, মানুষের মুক্তির জন্য, জাতীয় উন্নতি-প্রগতির কাজে লাগাতে হবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। এটা সহজবোধ্য যে, কোনো একটি কাজ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় করা যদি অসম্ভবও হয়ে দাঁড়ায়, আপামর জনতা যদি তাদের ধর্মবিশ্বাস থেকে সেটা করতে উদ্যোগী হয় তাহলে রাষ্ট্রের বিনা খরচে খুব সহজেই করা সম্ভব। ধরুন, সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, প্রতিটি গ্রামে হতদরিদ্র, অক্ষম মানুষদের জন্য একটি করে পাকা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ৮৫ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে সরকারকে বিরাট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, বৈঠকের পর বৈঠক করতে হবে, বিদেশীদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাততে হবে, ট্যাক্স বাড়াতে হবে, টেন্ডার দিতে হবে, সেখানে দুর্নীতি হতে পারে, টেন্ডারবাজদের মধ্যে মারামারি হবার সম্ভাবনা থাকে। এক কথায় সরকারের উপর বিরাট একটা চাপের সৃষ্টি হবে। ফলে এ উদ্যোগ হয়তো আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। আর যদিও বা হয়, সেই ব্যয়িত অর্থের অতি ক্ষুদ্র অংশই বাড়িটির নির্মাণ কাজে ব্যয় হবে এবং সে বাড়ি কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু এ কাজটিই অতি সহজে করে ফেলা সম্ভব হবে যদি মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়। যদি প্রতিটি গ্রামের বাসিন্দাদেরকে এটা বুঝানো যায় যে, আমরা সবাই আমাদের গ্রামের দুস্থ আশ্রয়হীন মানুষের থাকার জন্য ঘর তৈরি করে দিলে আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল আমাদের উপর খুশি হবেন। এ ঘরের বিনিময়ে আল্লাহ পরকালে আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন এবং তাঁর জান্নাতে আমাদের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেবেন। নিরাশ্রয় মানুষগুলো আমাদের জন্য দোয়া করবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করাই আমাদের প্রকৃত এবাদত- এই সত্যটি জানলে এভাবে মানুষগুলো যার যা সামর্থ আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এ কাজে আত্মনিয়োগ করবে তাহলে সরকারি আর্থিক সহায়তা ছাড়াই শুধুমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এবং বিনা দুর্নীতি, বিনা টেন্ডারবাজিতে ৮৫ হাজার গ্রামে পাকা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়ে যাবে। শুধু কি তাই? এ কাজে মুসলিম-সনাতন-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই অংশ নেবে, তাদের মধ্যেও সৃষ্টি হবে ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি। সকল ধর্মেই পরহিতব্রতের কথা, ‘মানবতার কল্যাণই মুক্তির পথ’- এ কথা বলা আছে। তাই ধর্মকে উপাসনালয়ের অচলায়তন থেকে বের করে মানুষের কাজে লাগাতে হবে। এভাবেই ধর্মবিশ্বাস একদিকে যেমন পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলবে, পরকালকেও সাফল্যমণ্ডিত করবে। আজ আমরা পদ্মাসেতু নিয়ে চিন্তিত। অথচ ১৬ কোটি মানুষের জন্য কল্যাণকর এই সেতু নির্মাণকে সহজ করে দিতে পারে ধর্মের সঠিক ব্যবহার। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, ধর্মকে ব্যবহার করেই আজ অনেক জাতীয় সম্পদ, ব্রিজ, সেতু, রাস্তাঘাট, রেললাইন পর্যন্ত ধ্বংস করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ ধর্ম আজ জাতীয় উন্নতি অগ্রগতির পরিবর্তে ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে করে ধর্মের প্রতি মানুষের ঘৃণা, বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
কিংবা ধরুন বাংলাদেশে এক কোটি দরিদ্র মানুষ আছে যারা পরনির্ভরশীল, অনেকে ভিক্ষাজীবী। একজন মানুষের সারাদিনে খাবারের খরচ একশ টাকা ধরলে দৈনিক লাগবে একশ কোটি, মাসে লাগবে তিন হাজার কোটি। এত টাকা বছর জুড়ে যোগানো কি সরকারের সাধ্যের মধ্যে? না। কিন্তু বাকি পনের কোটি মানুষকে যদি বোঝানো হয়, এই মানুষগুলো তোমাদেরই দরিদ্র ভাই। প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে তুমি নামায, রোযা করলেও লাভ নেই, তুমি তো মোমেনই হতে পারবে না। সুতরাং বাঁচতে হলে ওদের খাওয়াও। আল্লাহ তোমাদেরকে জান্নাত দিবেন। তোমাদের অর্থ-সম্পদ ধর্মব্যবসায়ীদের দিও না, দরিদ্র মানুষকে দাও। এয়ারকন্ডিশনযুক্ত টাইলসের মসজিদ বানানোর দরকার নেই, আল্লাহর রসুল খেজুর পাতার ছাউনি দেওয়া মসজিদে থেকে রাষ্ট্র চালিয়েছেন। ওই টাকা দিয়ে এই ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে খাওয়াও। এভাবে যদি চেষ্টা করা হয়, দেখা যাবে রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে থাকা ঐ এক কোটি মানুষের জন্য রাষ্ট্রকে কোনো চিন্তাই করতে হবে না। আজও হাজার হাজার এতিমখানায় লক্ষ লক্ষ শিশু বড় হচ্ছে মানুষের দানের টাকায়, ধর্মকে বাদ দিলে এই ব্যয় তখন সরকারকেই যোগাতে হবে। যদি এতিমখানায় দানকৃত অর্থে ধর্মব্যবসায়ীদের কালো থাবা না পড়ত তাহলে নিঃসন্দেহে অর্থ উপচে পড়ত। অনেকে মনে করতে পারেন যে, এভাবে দরিদ্র মানুষকে যদি কর্ম বাদেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া যায় তবে তো সমাজ কর্মবিমুখ মানুষে ভরে যাবে, সমাজে আরও দরিদ্রতা নেমে আসবে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই ইসলামসহ সকল ধর্মই কর্মের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেছে। বৈরাগ্যবাদ ও আলস্য উভয়ই ইসলাম নিষিদ্ধ করে, কারণ এতে সমাজের ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যায়। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা যদি মানুষ পায় তবে তারা প্রচণ্ড গতিশীল ও কর্মমুখী হবেই। কোনো ধর্মেই অলসতার কোনো স্থান নেই। এখানে মহানবীর একটি ভাষণ লক্ষ্য করুন। তিনি বলেছেন, “হে মানুষ আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা হাসিল করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে জোর চেষ্টা কর এবং তোমাদের প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, কোনো মো’মেনের সত্তাকে দুনিয়ায় বেকার এবং অনর্থক সৃষ্টি করা হয় নি। বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্ম ও কর্তব্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কর্ম ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অল্পে সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অর্থ এ নয় যে, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা এবং নিজের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। নিশ্চয় আল্লাহর উপর ভরসা রাখা আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু রেযেক হাসিল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিতান্তই জরুরি বিষয়।
আমি তোমাদেরকে অবহিত করছি যে, দুনিয়ায় যত নবী-রসুল এসেছেন তাদের সবাই জীবিকা উপার্জনের জন্য চেষ্টা-সাধনা করতেন এবং নিজেদের বোঝা অন্যের চাপিয়ে দিতেন না। অতএব, তোমরাও জীবিকা উপার্জনের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা কর। কায়িক শ্রম, কুলির কাজ করা এবং লাকড়ির বোঝা নিজের মাথায় ওঠানো অন্যের কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। যার জীবিকা উপার্জনের সামর্থ্য রয়েছে অন্যের কাছে চাওয়া তার জন্য খুবই অপমানজনক। সে দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত এবং শেষ বিচারের দিনও তাকে এমন অবস্থায় হাযির করা হবে যে তার চেহারায় গোশত থাকবে না। আমি পরিষ্কারভাবে তোমাদের বলছি, যার কাছে একদিনের খাদ্যও মজুদ রয়েছে তার জন্য হাত পাতা অবশ্যই হারাম। আমি জানি কোন কোন সুফিসাধক ভিক্ষাবৃত্তিকে জায়েয বলেন, কিন্তু ইসলাম হাত-পা গুটিয়ে বসা এবং ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম আমাদের হুকুম দিয়েছে যে, ‘দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাও এবং আল্লাহর করুণা সন্ধান করো (সূরা জুমাহ-১০)।’ যে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বাঁচবে, নিজের পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ করা ও প্রতিবেশীর সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য হালাল উপায়ে জীবিকা হাসিল করবে সে কেয়ামতের দিন পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। দুনিয়াতেও তার জন্য সম্মান ও প্রতিপত্তি রয়েছে।” (ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত মহানবীর ভাষণ বই থেকে)
ধর্ম যেমন অর্থশালী মানুষকে দান করতে শেখায়, তেমনি দরিদ্র মানুষকে ভিক্ষা না করে কর্ম করতে শেখায়। কোনো ধর্মই ভিক্ষাবৃত্তিকে বৈধতা দেয় না। ইসলামের এ শিক্ষার দরুণ পরিবারের কর্মক্ষম সকলেই আর্থিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে তেমনি অর্থের স্রোত উপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়ে বৈষম্য লাঘব করবে।
শ্রীগীতায় বলা হয়েছে, “তুমি নিয়ত কর্ম (অপরিহার্য কর্ম, জীবিকার্জনের কর্ম) কর; কর্মশূন্যতা (বেকারত্ব, কর্মবিমুখতা) অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম না করিলে তোমার দেহযাত্রাও নির্বাহ হইতে পারে না।” (কর্মযোগ অধ্যায়- শ্লোক-৮)।
এবার দেখুন বাইবেলে ঈসা (আ.) কী বলেছেন- “আল্লাহ মানুষের শ্রম বিনিয়োগকে কপালের লিখন করে দিয়েছেন। আইয়ুব, যিনি আল্লাহর নবী বন্ধু ছিলেন তাঁর কথায়, ‘পাখির জন্ম যেমন উড়ে বেড়াবার জন্য, সাঁতার কাটার জন্য মৎস্যকুল, ঠিক তেমনি মানুষের সৃষ্টি হয়েছে শ্রমিকরূপে, কর্ম করে যাবার জন্য।’
আল্লাহ মানুষকে আদেশ করেছেন এই মর্মে, ‘তেমার কপালের ঘামের বিনিময়ে তুমি খাদ্য সংগ্রহ করবে!’ আর আইয়ুব (আ.) এর বাণী হলো: ‘মানুষের জন্মই হয়েছে কাজের জন্য!’ অতএব যে মানুষ নয় সেই-ই শুধু এই নির্দেশের ঊর্ধ্বে। নিশ্চিতই যাবতীয় পণ্যের এত উচ্চমূল্যের কারণ হলো বেশ কিছু সংখ্যক মানুষের বেকারত্ব ও নিষ্কর্মাবৃত্তি। যদি এরা কর্মতৎপর হতো, কেউ কাজ করত কৃষি ক্ষেতে, কেউ মাছ শিকার করত পানিতে, তবে জগৎ প্রাচুর্যে পূর্ণ হয়ে যেত। কর্মের জগতে এই শূণ্যতা সৃষ্টির জন্য নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর হাশর দিবসে তাদের কঠোর জবাবদিহি করতে হবে।” (বার্নাবাসের বাইবেল- অধ্যায়-১১৪)। ধর্মের এ শিক্ষাগুলি যে সমাজের তরুণরা পাবে তাদের মধ্যে অবশ্যই প্রচণ্ড গতিশীলতা, কর্মমুখিতা ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। সামগ্রিকভাবে জাতি উন্নতি ও প্রগতির শীর্ষে আরোহণ করবে।
আবার রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়। সেই কর আদায়ে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে। কিন্তু তাদেরকে যদি বোঝানো যায় যে রাষ্ট্রের উন্নয়নে দান করলে সেটা তার আখেরাতের সঞ্চয় হবে, তাহলে রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও শ্রম মানুষ স্বেচ্ছায় প্রদান করবে।
এভাবে একটা একটা করে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, তবে পাঠকের বোঝার জন্য এ কটিই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি।
অনেকে মনে করতে পারেন, এই যে সবাইকে বলা হবে, এই কাজ করলে জান্নাতে যেতে পারবে এটা কি সত্য, নাকি মিথ্যা? এটা মিথ্যা নয়, অবশ্যই সত্য। সকল ধর্মে আমাদের এ কথার অবশ্যই স্বীকৃতি মিলবে যে, মানুষের কল্যাণে কাজ করাই ধর্ম। এর বিনিময়েই স্রষ্টা পরজীবনে মানুষকে উত্তম প্রতিদান দিবেন বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সুতরাং মানুষের ঈমানকে নেয়ামত বা আশীর্বাদ হিসাবে ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠনে, মানবতার কল্যাণে, জাতির উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে, তবেই মানবজীবনের সার্থকতা আসবে। এটাই আমাদের কথা। ভারী ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায় আবার এটম বোমাও বানানো যায়। এটম বোমা পৃথিবীর জন্য হুমকি কিন্তু বিদ্যুৎ আশীর্বাদ। তেমনি ঈমানকে ভুল পথে নিয়ে গেলে যেমন জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হতে পারে, তেমনি সেই ঈমানকে সঠিকপথে প্রবাহিত করা গেলে আখেরাতের সাথে সাথে পৃথিবীকেও সুন্দর করা যাবে। যে ঈমান দুনিয়ার কাজে লাগবে না তা হাশরের দিনেও কাজে লাগবে না। এজন্য আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে মানুষকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন যে, “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের জীবনকে সুন্দর করে দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে নি®কৃতি দিন”। এখানে আগে দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর করার কথা বলা হচ্ছে। এখানে আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন হাসান, হাসান- অর্থ সুন্দর (উন্নতি, প্রগতি, শিক্ষা, ন্যায়-নীতি ইত্যাদি)। যার দুনিয়া সুন্দর নয়, তার হাশরও সুন্দর হবে না কারণ আখেরাতের জীবন দুনিয়ার জীবনের প্রতিফলনমাত্র। অতীতে বারবার মানুষের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে, ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। মানুষের ঈমান এমন একটি সম্পদ যেটাকে আমরা যদি সঠিক পথে ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে সেটা অবশ্যই বিপথে-কুপথে পরিচালিত হবে। সেটা থেমে থাকবে না। কারো না কারো দ্বারা সেটা প্রভাবিত হবেই। যুগে যুগে সেই কুপথে পরিচালিত করার কাজটিই করেছে উগ্রপন্থী, ধর্মব্যবসায়ীরা, অপ-রাজনীতিকারীরা এবং অন্যান্য স্বার্থবাদীরা। এভাবে মানুষ তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে বিভিন্নভাবে ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষ জায়গা-জমি বিক্রি করে মানুষের কল্যাণে ব্যয় না করে পরকালীন মুক্তির প্রত্যাশায় ধর্মব্যবসায়ীদের হাদিয়া বা নজরানা দিয়েছে। এভাবে বহু ধর্মব্যবসায়ী ধনকুবের বনে গেছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ নিঃস্বার্থভাবে তাদের আনুগত্য করেছে কেবলই ধর্মকে ভালোবেসে। সে ভালোবাসা অপাত্রে পড়েছে, নিষ্ফল হয়েছে। এখন মানুষকে বোঝাতে হবে- মানবতার কল্যাণে কাজ করাই তোমার প্রকৃত এবাদত, এই এবাদতই আল্লাহর কাম্য, এটা করলেই জান্নাত সুনিশ্চিত। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রচলিত বিকৃত ইসলাম ও ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোস উন্মোচন করে সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার জন্য যে আদর্শিক উপকরণ তথা কোর’আন হাদীস, ইতিহাস, দলিল ভিত্তিক যুক্তি প্রমাণ প্রয়োজন তা আল্লাহর করুণায় আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে আছে। আমরা নিজেদের সীমিত সামর্থ্যে এ কাজটি করার চেষ্টাও করে যাচ্ছি।) কিন্তু এত বৃহৎ কাজ করার জন্য যে প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ প্রয়োজন তা কোনো ব্যক্তি বা দলের একার উদ্যোগে করা কোনোকালেও সম্ভব নয়। এটা তখনই সম্ভব হবে যখন রাষ্ট্রশক্তিসহ সমস্ত জাতি সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবে। কল্যাণ-রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে সেটা করা সরকারের দায়িত্ব এবং এতে রাষ্ট্রেরই কল্যাণ। মানুষকে এ বিষয়গুলো যদি যথাযথভাবে বোঝানো যায় তাহলে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট আর রাষ্ট্রের জন্য হুমকি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। জাতির কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে ধর্মই হবে সুশীতল শান্তির আধার।
সামাজিক অপরাধ দূরীকরণে প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা
সামাজিক অপরাধ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা ও অপরাজনীতির হীনচর্চা আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। আমাদের সমাজজীবন নানাপ্রকার সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, কেবল আমাদের দেশেই নয় সমগ্র বিশ্বেই সামাজিক অপরাধ, অন্যায়, অশান্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললে যে নৃশংস হৃদয়বিদারী চিত্র চোখে ভেসে আসে, তা কোনো মানবসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। এ যেন নরকতুল্য একটি আবাসভূমি, যে ভূমিতে অনুষ্ঠিত প্রতিটি অমানবিক ঘটনা ধিক্কার জানাচ্ছে কথিত মানবসভ্যতাকে, মানুষের মিথ্যা অহংকারকে, তার অস্তিত্বকে। মানুষের বিবেকহীন নির্লজ্জ আসুরিক কর্মকাণ্ড আজ পশুকেও হার মানিয়েছে। মানুষ তার প্রধান ধর্ম মানবতা ও মনুষ্যত্বকে ত্যাগ করেছে সম্পূর্ণভাবে। মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, কূটিলতা, স্বার্থপরায়ণতা ইত্যাদি যখন বৃদ্ধি পায়, এক কথায় মানুষের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটে তখন সে মনুষ্যত্ব হারায়। সমাজে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। মানুষের চারিত্রিক অবনতি ও অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পুলিশ পাহারা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না, উপরন্তু যদি শান্তিরক্ষাকারীদের মধ্যেই দুর্নীতি প্রবিষ্ট হয় তখন শান্তি আসার শেষ পথটিও বন্ধ হয়ে যায়। তথাপি মানুষের শান্তির লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাদেরকে আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে। যে অপরাধের সাজা ছিল ১০ বছর, তা বাড়িয়ে করা হচ্ছে যাবজ্জীবন, যে অপরাধের সাজা ছিল যাবজ্জীবন তা এখন মৃত্যুদণ্ড করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দিনকে দিন মানুষের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেই অপরাধ সংঘটন করছে। পুলিশ প্রহরায় রাস্তাঘাটে হয়তো অপরাধ সংঘটন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু বাড়ির মধ্যে স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে, মেয়ে বাবা-মাকে হত্যা করছে, ভাই ভাইকে হত্যা করছে, পিতা-মাতা সন্তানকে হত্যা করছে, এই ভয়াবহ অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সম্পূর্ণ দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নেই। গত বছরের প্রথম আট মাসে সারা দেশে ৩ হাজার ৬১টি খুনের ঘটনা ঘটে। এ সময়ে রাজধানীতে ১৭২ জন খুন হন। যার মধ্যে ১৬২টি খুনের কারণ সামাজিক ও পারিবারিক (বাংলাদেশ প্রতিদিন- ১২ অক্টোবর, ২০১৪)। স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে গত ৫ বছরে খুন হয়েছেন এক হাজার ১৭৫ জন নারী। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যান থেকে এটি জানা যায়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মূলত অর্থের প্রতি প্রবল মোহের অসম প্রতিযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, অন্যদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা, দা¤পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর পর¯পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা, সামাজিক উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না থাকা, রাষ্ট্রের উদাসীনতা, বিষণœতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। আর এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে হচ্ছে। সমস্ত পরিসংখ্যান বলছে, দিন দিন অপরাধ বাড়ছে, উদ্ভাবিত হচ্ছে অপরাধের নিত্য-নতুন কলাকৌশল। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে, দণ্ডবিধি দেখিয়ে মানুষকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটা আত্মাও আছে। এই আত্মাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষকে যদি আত্মিক শিক্ষা দেবার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে
যদি নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তবে সে নিজেই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপরাধ সংঘটন থেকে নিবৃত থাকবে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষেকে বিরত রাখার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা, পাশাপাশি অপরাধের জন্য কঠোর দণ্ডবিধিও থাকতে হবে।
পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের বড় পার্থক্য হলো এতদঞ্চলের সমাজ বস্তুবাদভিত্তিক নয়, বিশ্বাসভিত্তিক। এখানকার মানুষ হাজার হাজার বছর থেকে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত; কেউ ইসলাম ধর্ম, কেউ হিন্দু ধর্র্ম, কেউ বৌদ্ধ ধর্ম, কেউ খ্রিষ্ট ধর্ম। অর্থাৎ এখানে ধর্মবিশ্বাসহীন লোক খুবই কম। ধর্ম তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে, তাই এখানে পাশ্চাত্যের সব দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি খাপ খায় না। এখানে ধর্মের শিক্ষা দ্বারাই মানুষের আত্মিক শুভ পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ধর্মের শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষ বিশ্বাস করে যে সে পৃথিবীর সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। প্রতিটি কাজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব তাকে একদিন দিতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহ, রসুল, অবতারগণের উন্নত জীবনাদর্শ তার হৃদয়ে জাগরিত থাকে, সে লাগামহীন উচ্ছৃঙ্খলতার তুলনায় ন্যায়নিষ্ঠ, পরিশিলীত জীবনযাপনকে ভালোবাসতে থাকে। ধর্মের প্রভাবেই মানুষ একসময় ছিল সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, আদর্শবান। অথচ আজ পশ্চিমা ধর্মহীন জীবনদর্শন ও অসভ্য সংস্কৃতির দাপটে জীবন থেকে ধর্মের মূল্যবোধ (Moral Values) প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রতিটি ধর্ম এখন ধর্মব্যবসায়ীদের স্বার্থসিদ্ধি ও অপরাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, ফলে জাতীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্ম এখন কার্যকারিতাহীন নিছক পোশাকী একটি বিষয়। ধর্মব্যবসায়ীদের দুষ্কর্মের কারণে মানুষ দিনদিন ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর বর্তমানে ১২০ কোটি মানুষ নিজেদেরকে কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নয় বলে দাবি করে থাকেন। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা হারিয়ে যাওয়ায় সমাজে যারা ধর্মের একেবারে ধ্বজাধারী হিসাবে পরিগণিত তারাও এমনসব কুকর্ম ও অপরাধে বিজড়িত হয়ে পড়েন যে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তারাও শ্রদ্ধার পাত্র না হয়ে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। মোট কথা আমাদের সমাজে যে ধর্ম প্রচলিত আছে তা একান্তই উপাসনাকেন্দ্রিক- সমাজকেন্দ্রিক নয়। এর নৈতিক শিক্ষাগুলি বহুবিধ কারণে মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারছে না। তাদের জন্য প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা। মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে ধর্ম কী? প্রকৃত ইবাদত কী? মানুষের কাছে স্রষ্টার চাওয়া কী? কাজ ও কাজের পরিণতি (হাশর) কী? মানবজন্মের সার্থকতা কীসে ইত্যাদি। অতি সংক্ষেপে মূল কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি:-
(১) ধর্ম কী? প্রকৃতপক্ষে ধর্ম হলো কোনো পদার্থ বা প্রাণীর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো। ঠিক একইভাবে মানুষের ধর্ম হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্য, বিবেক, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলীই হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবে পরিগণিত হবার যোগ্য, কেননা তার ভিতরে মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি আছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি নামায, রোযা, হজ, পূজা, অর্চনা, উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যাপৃত থাকে কিন্তু তার ভিতরে মানবতার গুণাবলী না থাকে তাহলে সে প্রকৃত ধার্মিক নয়, আল্লাহর প্রকৃত উপাসক নয়।
(২) প্রকৃত ইবাদত ও মানবজীবনের সার্থকতা: আমাদেরকে সঠিকভাবে জানতে হবে এবাদত কী, কারণ আল্লাহর এবাদত করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে (সুরা যারিয়াত ৫৬)। এবাদত হচ্ছে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে সেই কাজটি করা। গাড়ি তৈরি হয়েছে পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্য, এটা করাই গাড়ির এবাদত। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধি (vicegerent) হিসাবে (সুরা বাকারা-৩০)। অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহ যেভাবে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ রেখেছেন ঠিক সেভাবে এ পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখার জন্য প্রতিনিধি হিসাবে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষের এবাদত হচ্ছে- মানুষের জীবন যেন অন্যায়-অশান্তি, যুদ্ধ-রক্তপাতমুক্ত থাকে, ন্যায়-সুবিচার ও শান্তিতে থাকে সেই লক্ষ্যে কাজ করা। যেমন ধরুন, আপনি গভীর রাত্রে প্রার্থনায় মগ্ন। হঠাৎ শুনলেন কারো বাড়িতে আগুন লেগেছে। তখন আপনি দৌড়ে যাবেন সাহায্য করতে নাকি চোখ-কান বন্ধ করে প্রার্থনা চালিয়ে যাবেন। সকল ধর্মের কথা হচ্ছে, যদি আগুন নেভাতে যান সেটাই হবে আপনার প্রকৃত এবাদত। আর যদি ভাবেন যে, যার বাড়িতে আগুন লেগেছে সেতো অন্য ধর্মের লোক, তাহলে আপনার মধ্যে মানুষের ধর্ম নেই, আপনার নামায-রোযা, হজ্ব, যাকাত সবই পণ্ডশ্রম। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি- মনে করুন একটি দেশে চরম অরাজক, নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। মানুষ পথে-ঘাটে আক্রান্ত হচ্ছিল, গাড়ি চলছিল না, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হবার উপক্রম হলো। প্রতিদিন দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হচ্ছিল, সর্বত্র বিরাজ করছিল ভয় ও আতঙ্ক। এই অবস্থায় কয়েক লাখ মুসল্লি জমায়েত হয়ে যদি তিন-চার দিন ধরে জিকির-আজগার, তাসবীহ-তাহলীল, ওয়াজ-নসীহত করে শেষে দীর্ঘ এক মোনাজাত করে সেই স্থান থেকে বিদায় নেয় আর সংকট যেমন ছিল তেমনি রয়ে যায় তবে আমাদের প্রশ্ন হলো- জাতির এই বিপদসংকুল মুহূর্তে আল্লাহর মো’মেন বান্দা হিসাবে এদের কী করণীয় ছিল? তাদের এই ‘প্রচেষ্টাহীন দোয়া’ কি আল্লাহ কবুল করলেন? দোয়া কবুল হলে তো শান্তিই চলে আসত। অর্থাৎ দোয়া ব্যর্থ হলো, উপরন্তু যানজট বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের ভোগান্তিও বাড়ল। তাদের এই সম্মিলিত ধর্মকর্মে মানুষ, সমাজ, জাতি বা দেশ কে উপকৃত হলো? তাহলে এক্ষেত্রে কোন কাজটি করলে তা সঠিক এবাদত হতো? যদি এই কয়েক লক্ষ মানুষ দুর্বৃত্তদের হাত থেকে দেশের রাস্তাঘাটসহ জাতীয় সম্পদ রক্ষার জন্য, মানুষের চলাচলকে নিরাপদ করার জন্য দিন রাত পাহারা দিতেন তাহলে সেটাই হতো তাদের আসল এবাদত, তারা মোমেন হতে পারতেন। তা না করে উল্টো তাদের পাহারা দিতেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গলদঘর্ম হতে হয়, তাদের মূল্যবান সময় ও সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সুতরাং ধর্ম, এবাদত ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, আকিদা যতদিন পর্যন্ত পরিবর্তন না হবে, ধর্মবিশ্বাস সঠিক পথে প্রবাহিত না হবে ততদিন পর্যন্ত ধর্ম মানুষের কল্যাণ করতে পারবে না, ধর্মবিশ্বাস জাতির বোঝা ও অকল্যাণের উপাদান হয়েই থাকবে।
মানুষের আত্মিক এবং মানসিক পরিশুদ্ধির এই প্রশিক্ষণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাগুলির মধ্যেও নেই, ধর্মগুলির মধ্যেও অনুপস্থিত, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কৃতি সবই তো সম্পূর্ণ বস্তুবাদী ও ভোগবাদী। এ বিষয়গুলো যদি মানুষকে শিক্ষা দেয়া যায়, তাহলেই মানুষের মানসিক অবস্থার শুভ পরিবর্তন হবে এবং সামাজিক অপরাধ অনেকাংশেই বন্ধ হবে।
শুধুমাত্র শক্তি-প্রয়োগে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয়
গত দেড়যুগ ধরে জঙ্গিবাদ সারা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রক্তের বন্যায় লাল হয়ে গেছে পৃথিবীর মাটি, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক। পাকিস্তান, সিরিয়া, নাইজেরিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিম দেশেই জ্বলছে জঙ্গিবাদ নামক সহিংসতার আগুন। কেবল ইরাকেই মারা গেছে ১০ লক্ষ আদম সন্তান। সর্বশেষ পাকিস্তানে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত স্কুলে জঙ্গি হামলায় শতাধিক শিশু হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিবেক প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। জঙ্গিদের কথা মনে করে মানুষ শিউরে উঠছে। বিশ্বের সুপার পাওয়ারগুলি তাদের সর্বাত্মক সামরিক শক্তি ও অর্থ বিনিয়োগ করেও এই সমস্যার কোন কূল কিনারা করতে পারে নি। জঙ্গিরা মরছে, বেঁচে থাকছে জঙ্গিবাদ। যতই তাদেরকে জোর করে দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে, ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে ততই তাদের উগ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে, এমন কি তারা আত্মঘাতীও হচ্ছে। এভাবে দিনকেদিন বেড়েই চলেছে ধর্মের নামে সহিংসতা, জনগণের দুর্ভোগ কিন্তু কোন সমাধান আসছে না। দীর্ঘ দেড় যুগের এত অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির পর অবশ্য এখন জ্ঞানী-গুণীরা একমত হচ্ছেন যে, শুধুমাত্র শক্তিপ্রয়োগে, সামরিক কায়দায় জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব নয়; কারণ জঙ্গিবাদ কোন সাধারণ ও বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, এটি একটি বিকৃত আদর্শ। আফগানিস্তান সোভিয়েত দখলদার বাহিনীর দখল (Invade) করার পর পশ্চিমা পরাশক্তিগুলি সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে ধরাশায়ী করার জন্য সেখানে ধর্মকে ব্যাবহার করেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ঈওঅ এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ওঝও যৌথভাবে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং ধর্মব্যাবসায়ী আলেমদের দিয়ে জেহাদে উদ্বুদ্ধ করেছে, এই যুদ্ধকে জেহাদ নাম দিয়েছে, যার পর থেকে এই জঙ্গিবাদ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই জঙ্গিবাদের বিস্তারে সিংহভাগ অর্থ যোগান দিয়েছে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর অনুগত ভৃত্ত ধর্মব্যবসায়ী আরবের রাজতন্ত্রগুলো। এই আদর্শ যতদিন টিকে থাকবে, জঙ্গিবাদও ততদিন টিকে থাকবে। তাই একে মোকাবেলাও করতে হবে আদর্শ দিয়েই।
এখন অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তিই শক্তি প্রয়োগের পূর্বে আদর্শিক মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করছেন।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে “বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা”-র উপর একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, “জঙ্গি কর্মকাণ্ডের পেছনে একটি আদর্শ (Ideology) থাকে। আদর্শকে আদর্শ দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। একে বলা হয় আদর্শিক লড়াই। ধর্ম নিয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে তারা যে আদর্শটি প্রচার করছে, সেটা কোর’আনের আয়াত বা হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যা দ্বারাই মানুষকে আকৃষ্ট করছে। প্রকৃতপক্ষে এই আয়াতগুলি ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যাগুলি মানুষকে জানানোর প্রয়োজন। মোদ্দা কথা ইসলামের এ বিষয়টি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা একটি বড় ব্যাপার। এই সচেতনতা (Awareness) সৃষ্টির কাজটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা করতে পারলে ভালো, তবে অন্যদেরও এগিয়ে আসা দরকার।”
এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী বলেন, “জঙ্গিবাদ দূরীকরণে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা যথেষ্ট নয়। কারণ জঙ্গিবাদ হচ্ছে একটি আদর্শগত যুদ্ধ। সে হিসেবে বাংলাদেশ সরকার এখনো কিছুই করে নি।”
অব. মেজর জেনারেল জনাব আব্দুর রশিদ বলেন, “শুধু পুলিশ, রিমান্ড এগুলি করলেই চলবে না, একটা কমপ্রিহেনসিভ স্ট্রাটেজি বা সামগ্রিক কৌশল তৈরি করতে হবে।”
মেজর জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “শক্তি প্রয়োগ করে এটা (জঙ্গিবাদ) দমন করা যাবে না। এটা যদি কেউ বলে থাকে তবে… আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এ ধরনের কথা বলবে না।”
বক্তব্যগুলির সারমর্ম হচ্ছে, ‘কোর’আন হাদিসের অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ নামক এই ভুল মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এই আদর্শিক যুদ্ধে জয়ী হতে হলে কোর’আন হাদিসের সেই বিষয়গুলির সঠিক ব্যাখ্যা মানুষকে জানাতে হবে।’
ঠিক এই কথাটিই কয়েকবছর পূর্বে বলেছিলেন যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তিনি ২০০৯ সনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র, তারাই যেখানে সামরিক শক্তি দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে পারছে না সেখানে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশের জন্য এটা আরও অসম্ভব”। তিনি সরকারকে আদর্শিক যুদ্ধের মাধ্যমে জঙ্গিদমনে সহায়তা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ এই আদর্শিক যুদ্ধে জঙ্গিদের পরাজিত করতে হলে তাদের আদর্শের বিপরীতে কোর’আন ও সুন্নাহ ভিত্তিক যে অলঙ্ঘনীয় যুক্তি ও প্রমাণ দরকার, সেই যুক্তি প্রমাণ আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। জঙ্গিদমনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলি নির্ভর করছে আলেম শ্রেণিটির উপর। আমাদের দেশের সরকারও এ ব্যাপারে নির্ভর করছেন মাদ্রাসা শিক্ষিত মসজিদের এমাম আর বিভিন্ন সরকারি ধর্মীয় গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের উপর।
কিন্তু জঙ্গিদেরকে আদর্শিক যুদ্ধে পরাজিত করার সামর্থ্য কি এই ধর্মজীবী আলেম শ্রেণির রয়েছে?
এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হলো: নেই। বাংলাদেশে কেবল নয়, দেড় যুগ আগে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটার পর থেকেই আলেমদেরকে দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারণা (Campaign) চালানো হয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই অসংখ্য বই লিখেছেন, ওয়াজ করেছেন, টিভি চ্যানেলে সেগুলি বছরের পর বছর প্রচারিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এই বাস্তবতা এখন স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসেছে যে, এই আলেমদের কাছে এমন কোন যুক্তি প্রমাণ নেই যা দিয়ে তারা জঙ্গিবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারেন।
সত্যিকার যুক্তি প্রমাণ না থাকা ছাড়াও তাদের দ্বারা জঙ্গিদমনে কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখা সম্ভব নয় তার আরও একটি কারণ আছে। মাদ্রাসা শিক্ষিত এই আলেম নামধারী শ্রেণিটি ধর্মকে তাদের জীবিকার উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন, ইসলামের কাজ করে পার্থিব সম্পদ ও সুখ-সুবিধা হাসিল করছেন যা আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে কঠোরভাবে হারাম করেছেন (সুরা বাকারা ১৭৪ সহ বহু আয়াত)। যে তাদেরকে টাকা দেয়, ভাড়াটে আলেমরা তার পক্ষেই কথা বলেন, সামান্য পার্থিব স্বার্থে তারা কোর’আন হাদিসের বিকৃত ব্যাখ্যা করে মিথ্যা ফতোয়া প্রদান করেন। তাদের এসব ব্যাখ্যায় সত্য-মিথ্যার কোন ভেদাভেদ থাকে না। হারাম ভক্ষণকারীর কোন চরিত্র থাকে না, নৈতিক মেরুদণ্ড ও সত্যের পক্ষে নির্ভীকতা থাকে না, অর্থের লোভে তারা যে কোন মিথ্যার সঙ্গে আপোস করে। তাদের এই স্বভাবের কারণে আমাদের সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই কমে গেছে।
তাছাড়া মাননীয় এমামুয্যামান প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, এই তথাকথিত আলেমরা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী নন। তাদের কাছে যে ইসলামটি আছে সেটা একটি বিকৃত এবং বিপরীতমুখী ইসলাম। যে কোন জিনিস বিকৃত হয়ে গেলে সেটা বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতি ধারণ করে। এই ধর্মব্যবসায়ী আলেম-পুরোহিত শ্রেণি হচ্ছে বিকৃত ইসলামের একটি শাখা আর জঙ্গিবাদ হচ্ছে বিকৃত ইসলামের আরেকটি শাখা। এই ধর্মজীবী আলেমদের কাছে সঠিক ইসলাম থাকলে তারা নিজেরা যেমন ধর্মব্যবসা করতেন না, তেমনি এ সমাজে জঙ্গিবাদেরও জন্ম হতো না। তাছাড়া জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করছে আরেক শ্রেণির আলেম। বিকৃত ইসলামের অনুসারী ধর্মজীবী আলেমরা অন্ধ ও পথভ্রষ্ট, অপরপক্ষে জঙ্গিরাও আরেক দিকে অন্ধ ও পথভ্রষ্ট। একজন পথভ্রষ্ট অন্ধ কি কখনও আরেক পথভ্রষ্ট অন্ধকে পথ দেখাতে পারে? পারে না। তাই ধর্মজীবী, প্রচলিত ইসলামের আলেমদেরকে দিয়ে জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা কেবল পণ্ডশ্রম; এতে সময় ও সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।
তাছাড়া ব্রিটিশদের তৈরি করা ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই মূলত এই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলির উত্থান হচ্ছে। কাজেই এই বিকৃত ইসলাম শিখেই যারা আলেম হয়েছেন তাদের দিয়ে জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা চালানো একটি স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত। তবে মাদ্রাসা থেকেই শুধু জঙ্গি তৈরি হয় তা কিন্তু নয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও এই প্রবণতা রয়েছে। এই প্রবণতা কেবল গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাদণ্ড, ফাঁসি দিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়। এরা একটি ভুল আদর্শকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ মনে করে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন।
এটাই যদি চূড়ান্ত কথা হয়ে থাকে তবে এ প্রসঙ্গে আমাদের সুস্পষ্ট কথা, যদি মাদ্রাসা শিক্ষিত ও সরকারি আলেমদেরকে দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আদর্শিক লড়াই চালানো হয় সেটা অতীতে যেমন কোন সুফল বয়ে আনে নি, ভবিষ্যতেও আনবে না। এটা উপলব্ধি করেই মাননীয় এমামুয্যামান এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, যে আদর্শে দীক্ষিত হয়ে মানুষ নিজের জীবন-সম্পদ সব তুচ্ছ করে অনিশ্চিত জীবন বেছে নেয়, এমন কি বুকে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সেই পদ্ধতিকে ভুল প্রমাণ করতে যে শক্তিশালী যুক্তি, তথ্য ও প্রমাণ প্রয়োজন তা তাঁর কাছে আছে। তাছাড়া তাদেরকে আগে কতগুলি মৌলিক বিষয় বুঝাতে হবে যথা- ইসলাম কী, ইসলামের প্রকৃত আকীদা কী, ধর্ম কী, প্রকৃত ধার্মিক কারা, এবাদত কী, মানবজনমের সার্থকতা কিসে, জেহাদ-কেতাল ও সান্ত্রাস কী ইত্যাদি। তাঁকে যদি সুযোগ দেওয়া হয় তবে তিনি কোর’আন ও হাদিসভিত্তিক সেই যুক্তি ও প্রমাণগুলি তুলে ধরে জঙ্গিদেরকে, ইসলামের নামে সহিংসতা সৃষ্টিকারীদেরকে ভ্রান্তপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন এনশা’আল্লাহ। সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ এ সন্ত্রাসবাদের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী শুধু ইসলামের নামে বোমাবাজিই কিন্তু জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস বা ঞবৎৎড়ৎরংস নয়, যে কোন কারণেই হোক মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি বা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অস্ত্র বা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করল তারা হচ্ছে সন্ত্রাসী। এই হিসাবে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের যে দলই হোক না কেন, কেউ যদি বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, মানুষ হত্যা করে সেটাও সন্ত্রাস। সর্বপ্রকার সন্ত্রাস থেকে আমরা মানবজাতিকে মুক্ত করতে চাই। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি এমামুয্যামান প্রদত্ত প্রস্তাবনা ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং সর্ব রকম অন্যায় থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দিতে পারবে এনশা’আল্লাহ। আজ যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদে আসীন ব্যক্তিগণ অনুভব করছেন যে তাদের আদর্শিক যুদ্ধে অন্যদেরও এগিয়ে আসা, অংশ নেওয়া প্রয়োজন তখন এমামুয্যামানের সেই প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য প্রস্তাব করছি। আমরা আশা করব, সরকার যদি সত্যিই জঙ্গিবাদ সমস্যার সমাধান চান তবে আমাদের এই প্রস্তাবনাটি বিবেচনায় রাখবেন।
[সেই প্রস্তাবনাটি কী এ ব্যাপারে জানার জন্য আমাদের প্রকাশিত “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যামানার এমামের পত্রাবলী” বইটি সংগ্রহ করা যেতে পারে।]
[যোগাযোগ: হেযবুত তওহীদ, ০১৭৩০০১৪৩৬১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫, ০১৮৫৩৯৯৩২২২, ০১১৯১৩৬৭১১০, ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৫৫৯৩৫৮৬৪৭]