গ্রাম্য কোন্দলে আবারও উত্তপ্ত নড়াইলের মলিকপুর, ভাংচুর লুটপাট চলছে, পাল্টাপাল্টি মামলা
উজ্জ্বল রায়, নড়াইল: হত্যা পাল্টা হত্যা আর ভাংচুর-লুটপাটের রাজনীতিতে আবারও উত্তপ্ত নড়াইলের কয়েকটি গ্রাম। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হত্যা মারামারি আর তার পরবর্তী লুটপাট, নারী নির্যাতন এখানকার নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এরকম একটি গ্রামের নাম মলিকপুর। প্রায় ২০ বছর ধরে এখানকার দুটি গ্রাম্য দলের সংঘাত আর হানাহানি চলছে। আর এর ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রান, ধ্বংস হচ্ছে বাড়িঘর আর লুটপাট হচ্ছে অন্যের সম্পত্তি। লুটপাটের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে নিরীহ বাসিন্দারা। এছাড়া ও সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হচ্ছে তা হলো এগুলো চলার কারনে এলাকার ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মামলা আর হামলার আশংকায়। জানা যায় গত ০৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের দাঙ্গা কবলিত মলিকপুর ইউনিয়নের দোয়া মলিকপুর, চর মলিকপুর গ্রাম ঘুরে ভয়ংকর সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দোয়া মলিকপুর গ্রামের পুর”ষশূন্য মনিরুজ্জামান মলিক এর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল গোয়ালঘরে পড়ে আছে ৪ টি দুধ খাওয়া বাছুর। আর সেই সব বাছুর জড়িয়ে ধরে কাদছেন তার স্ত্রী মাঝবয়সী শাহিনা বেগম। জানালেন শুক্রবার ৬ ফেব্র”য়ারী রাত সাড়ে আটটার দিকে মারামারি হবার পরে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে প্রতিপক্ষের অন্ততঃ ১৫ জন লোক দেশীয় অস্ত্র রামদা,সড়কি ছেনি দা নিয়ে তার বাড়িতে হামলা চালায়,তাকে মারধোর করে এবং বাড়ির ভিতর থেকে ডাকাতির মতো সোনা আর টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে যায়। এসময় তার গোয়ালে থাকা ৪টি গাভী সহ মোট ৮টি গর” লুট করে নিয়ে যায়। ভয়ে তিনি কাউকে কিছু না বলতে পেরে পরদিন থেকে বাছুুরগুলো জড়িয়ে কাদছেন। দুধ খাওয়া বাছুরগলোকে বাচাতে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন তিনি।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে পাশের মন্টু মলিক, ওহাব শেখসহ কয়েকটি বাড়িতে। এসব বাড়িতে আবার হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও করা হয়েছে। মন্টু মলিকের স্ত্রী নেহারুল বেগম (৩৮) বাড়িতে একা, স্বামী আর সন্তান মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত ৩ দিনে এবাড়িতে কোন রান্না হয়নি,মহিলা নিজেও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আর এ বাড়ি ও বাড়ি করে কখনও খাচ্ছেন কখনও না খেয়েই দিন পার হয়ে যাচ্ছে দুশ্চিন্তায়। ৬ ফেব্র”য়ারী রাতে তার বাড়িতেই এসেছিলো প্রতিপক্ষের ডাকাতদল, সেরাতে পুরুষেরা কেউ বাড়িতে ছিলেন না এই সুযোগে প্রতিপক্ষের লোকেরা এসে প্রথমে তার ছেলের খোজ করে। তার ঘর খুলে দিতে বলে এসময় নেহারুন কে ঘরের দরজা ভেঙ্গে মারধোর করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আর ডাকাতেরা তার সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়।
এরপর খোজ নিয়ে জানা গেল এই গন্ডগোলের কারনে এলাকার অন্ততঃ ৫ জন এস এসসি পরিক্ষার্থী তাদের পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেক কষ্টে তাদের সাথে যোগাযোগ করা গেল,একজন মহিলা আমাদের সাথে করে নিয়ে গেলেন একটি নির্জন বাশবাগানের তলে। সেখানে আমাদের দেখে কয়েকটি ছেলে ভয়ে দৌড়ে পালাতে গেলে সাথে থাকা এলাকার মহিলাকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে ফিরে এলো। কথা বলে জানা গেল এরা সবাই এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী কয়েকজন আবার এইচ এসসি দেবে সামনে।
এদের একজন হিরন মৃধা (১৭) দোয়া মলিকপুর গ্রামের হারুন মৃধার ছেলে হিরন লক্ষ্মীপাশা আদর্শ বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল। বাংলা ২টি পরীক্ষা দেবার পরে সে আর পরীক্ষা দিতে পারছে না। একদিকে প্রতিপক্ষের হামলা আর অন্যদিকে মামলার ভয়, গত ৮ ফেব্রুয়ারী হওয়া একটি মামলায় তার নাম আছে বলে সে জেনেছে। ১০ম শ্রেনীতে পড়াকালীন সময়ে ২০১৫ সালে একটি হত্যা মামলায় সে সাড়ে ৩ মাস জেলহাজত খেটে ডিসেম্বর মাসে জেল থেকে বের হয়েছে এর পর আর নতুন মামলা।
একই রকমভাবে চরমলিকপুর গ্রামের ওহাব শেখের ছেলে সজল শেখ (১৭) সে ও এবারের এসএসসি পরিক্ষার্থী। স্থানীয় মঙ্গলহাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অন্য সবার মতো সেও পরীক্ষা দিচ্ছিল কিন্তু বাধ সাধলো গ্রাম্য কোন্দল। আর তাতে তার পরীক্ষা শেষ মাত্র দুটি পরীক্ষা দেবার পরে সে আর পরীক্ষা দিতে পারছে না, দিনের বেলা এখানে সেখানে পালিয়ে সময় কাটাচ্ছে আর রাতে দুরের মামাবাড়ি গিয়ে ঘুমায় এভাবে চলছে এই ছাত্রের দিনরাত। হিরনের মতো দশম শ্রেনীতে পড়াকালীন সময়ে সেও সাড়ে তিন মাস বিনাকারনে জেলের ঘানি টেনে এসেছে। গ্রামের বড়দের কল্যানে এখন পর্যন্ত তার নামে ৩টি অমিমাংসিত মামলা ঘাড়ে নিয়ে দিন পার করছে এই মেধাবী ছাত্রটি।
শুধু তাই নয় মারের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে দোয়া মলিকপুর গ্রামের মন্টু মলিকের ছেলে বশির মলিক (১৭) সেও মলিকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএস সি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো। বর্তমানে সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করছে,তার সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানা গেল সেও দুটো পরীক্ষা দিয়ে হামলা আর পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকা এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে।
একই রকম ভাবে পরীক্ষা না দিতে পারা নাজিম শেখ, সাজ্জাদ শেখ পরীক্ষার হলে না গিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
শুধু এসএসসি পরীক্ষার্থী নয় আতঙ্কে আছে লোহাগড়া সরকারী কলেজের এবারের এইচ এসসি পরীক্ষার্থী শিহাব মৃধা। সে জানালো, প্রতিনিয়ত লুটপাট আর হুমকীর ভয়ে সে বাড়িতে থাকতে পারছে না আর ওদিকে মামলা হবার কারনে পুলিশের ভয়ে বাইরে বের হতে পারছে না। তার কলেজ, পড়ালেখা প্রাইভেট টিউটর সব বাদ দিয়ে অন্যদের মতো সেও এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
এলাকার ক্রমাগত মামলা আর কোন্দলের কারনে লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে যশোর উপশহর আলীম মাদ্রাসায় পড়–য়া তরিকুল ইসলামের। মাদ্রসায় আলমি পড়াকালীন সময়ে গত ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হত্যা মামলায় জেলে যায় সে। সাড়ে ৩ মাস জেল খেটে ডিসেম্বর মাসে বের হয়ে আসে, প্রায় ৪ মাস মাদ্রাসায় অনুপন্থিত থাকার কারনে তাকে আর ক্লাস করতে দেয়নি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এখন তাকে আবার নতুনভাবে ভর্তি হতে হবে।
এখানেই শেষ নয় গ্রাম্য কোন্দলে বাদ যাচ্ছে না ঢাকায় পড়–য়া ছেলেরাও। চর মলিকপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিল শেখের ছেলে সাজ্জাদ শেখ সে ঢাকার উত্তরা মডেল ইউনিভার্সিটিতে হিসাব বিজ্ঞানের ৩য় বর্ষের ছাত্র। তার ৩য় বর্ষের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে এই গন্ডগোল হলে ও মামলা থেকে সেও বাদ পড়েনি। তাকে ও হত্যা চেষ্টা মামলার আসামী করা হয়েছে।
লুটের ভয়ে এলাকার লোকেরা তাদের মালামাল নিয়ে ভিন্ন কোন জায়গায় চলে যাচ্ছে। এ যেন নিজ ভ’মে পরবাসীর মতো অবস্থা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন অভিযোগে জানান এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতেই এসব ভাংচুর আর লুটপাট হয়েছে।
ঘটনার পর থেকে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মলিকপুর চৌরাস্তায় লোহাগড়া থানার এস আই শাহিনের নেতৃত্বে প্রায় ১২ জনের একটি পুলিশ দলকে টহল দিতে দেখা গেল। এস আই শাহীন পুলিশের উপস্থিতিতে ভাংচুর লুটপাটের কথা অস্বীকার করে জানান,বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি সম্পূর্ন স্বাভাবিক আছে।
লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ কামর”জ্জামান জানান,এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আমরা সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে গ্রাম্য দলাদলি বন্ধ করার জন্য আমি স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং ঐ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেছি। আশা করছি অচিরেই আমরা এ ঘটনার সমাধান করতে পারবো।
স্থানীয় গ্রাম্য দলাদলির কারনে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃতুঞ্জয় কুমার দাস বলেন, এ জাতীয় গ্রাম্য কোন্দলের কারনে কোমলমতি শিশুদের যে কি ক্ষতি হচ্ছে তা উনারা বুঝতে পারছেন না। উনারা তাদের আধিপত্য বিস্তারকেই প্রধান করে দেখছেন। এভাবে চলতে থাকলে এলাকার সকল ছাত্রই মামলায় জড়িয়ে তাদের ভবিষৎ নষ্ট হবে। এলাকায় কিছু দাঙ্গাবাজ তৈরী হবে।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মলিকপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কাকামিয়া শেখ পক্ষের সাথে আজিম শেখ পক্ষের গন্ডগোল চলে আসছে প্রায় কুড়ি বছর ধরে। এর জের ধরে গত বছরের ১৪ আগষ্ট রাতে খুন হন দোয়া মলিকপুর গ্রামের মোহাম্মদ মলিক (৬০)। এ সময় থেকে আগের মামলা সহ প্রতিপক্ষের ঘাড়ে নতুনভাবে হত্যামামলা যোগ হয় আর বাড়িঘর ভাংচুর এবং লুটপাট শুর” হয়। সর্বশেষ গত ৬ ফেব্র”য়ারী রাতে প্রতিপক্ষের আঘাতে মারাতœক আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে খান আলাউদ্দিন (১৬) নামের দশম শ্রেণির এক ছাত্র। এ ঘটনায় মলিকপুর ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই মনির”ল ইসলাম কে আটক করেছে ডিবি পুলিশ।
এঘটনায় একটি হত্যা প্রচেষ্টা মামলা এবং আরো দুটি মামলা হয় লুটপাট ও বাড়িঘর ভাংচুরের। এলাকার সচেতন মানুষের আশংকা এভাবে চলতে থাকলে এই অঞ্চলের মানুষ দিনে দিনে সর্বশ্রান্ত হবে মামলায় আর লেখাপড়া বঞ্চিত হয়ে শিশুরা হয়ে উঠবে দাঙ্গাবাজ।