সংবিধান সংশোধন বিল নিয়ে আইনজীবীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
স্টাফ রিপোর্টার:
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিল’ নিয়ে আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেননি। কেউ পক্ষে মত দিয়েছেন আবার কেউ কেউ এ বিলের চরম সমালোচনা করেছেন। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণেতা কমিটির সদস্য ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সংবিধানের ৯৬নং ধারা বজায় রেখে সংশোধন করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি সংসদে যাওয়ার আগে জনমত যাচাই করা দরকার ছিল। এত তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে বলেও মত দেন এই সিনিয়র আইনজীবী। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, “সব উন্নত দেশেই বিচারকদের অভিশংসনের সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ করেন, আইনসভা রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে আইনসভা বিচারকদের অভিশংসন করতে পারবে না কেন?”
প্রসঙ্গত, গত রোববার উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে দশম জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ উত্থাপন করেন। বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় স¤পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। আইনমন্ত্রী বিলটি তোলার সময় সরকারি দলের পাশাপাশি সংসদের বিরোধী দলের সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তা সমর্থন করেন। গত ১৮ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিলটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায়। বিলটি চলতি অধিবেশনেই পাস করা হবে বলে তখন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী। ষোড়শ সংশোধনী বিলটি পাস হলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপিত হবে। তাতে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ফিরে পাবে সংসদ। একই সঙ্গে মহা-হিসাব নিরীক্ষক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্যসহ অন্যান্য সাংবিধানিক পদের ব্যক্তিদের অপসারণের ক্ষমতাও সংসদের কাছে ন্যস্ত হবে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একজন বিচারক ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত নিজ পদে বহাল থাকবেন। প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশে কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে। এ ছাড়া কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষরযুক্ত চিঠি দিয়ে পদত্যাগ করতে পারবেন।
সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, “বিচার বিভাগের বিষয়ে সংবিধান সংশোধন নিয়ে আলোচনা করা খুবই প্রয়োজন ছিল। আলোচনা না করায় আমরা উদ্বিগ্ন।” এ সংশোধন হলে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে করেন তিনি। কামাল হোসেন বলেন, “আমাদের সংবিধানে গণভোটের পদ্ধতি নেই। কিন্তু আলোচনার পদ্ধতি তো আছে। সুতরাং সংশোধন করার আগে সবার সঙ্গে আলোচনা করা দরকার ছিল। এটা সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।” সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, “বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে গেলে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মাঝে ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। সংবিধান অনুযায়ী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে একটি কার্যকরী সংসদ হবে। কিন্তু কথা হলো, আমাদের দেশে অধিকাংশ সংসদ সদস্যই অনির্বাচিত।” সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, “সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের পদের নিশ্চয়তা বাড়বে।” তিনি বলেন, “সংবিধান সংশোধন করার পর একটি আইন করতে হবে। কীভাবে বিচারপতিকে অপসারণ করা হবে, কী কী কাজ অসদাচারণ বলে বিবেচিত হবে, তা আইনের মধ্যে লেখা থাকবে। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি বা কমিশনের কথা উল্লেখ রাখতে হবে আইনে।” উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনের (অপসারণ) ক্ষমতা সংসদকে দেয়ার প্রস্তাব বিচার বিভাগকে নগ্নভাবে দলীয়করণেরই প্রচেষ্টা। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না বলে মত প্রকাশ করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
তারা মনে করেন, এর ফলে আদালতের রায় বা আদেশ সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাবে। সংবিধানে বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া আছে। কিন্তু অভিশংসনের ভার সংসদকে দিয়ে বিচারকদের বিচার যদি সংসদ সদস্যদের হাতে দেয়া হয় তাহলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না বলে মনে করেন আইনবিদরা। তাদের মতে, এটা একটি অশুভ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “বিচার বিভাগ ইতিমধ্যেই দলীয়করণের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। তারপরও বিচার বিভাগকে একটি অনির্বাচিত সংসদের আওতায় আনার অশুভ প্রচেষ্টায় সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা হাতে নিতে নিচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ বিচার বিভাগকে নগ্নভাবে দলীয়করণেরই প্রচেষ্টা বলে আমি মনে করি।” সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক স¤পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বলেন, “বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে চলে গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না। আদালতের রায় বা আদেশ সরকারের ইচ্ছায় করতে হবে। এটা করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।”
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন অভিশংসনের ক্ষমতা পেলেও সংসদ বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের সুযোগ পাবে না। তিনি বলেন, “সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অযোগ্যতার অভিযোগ এলে তা তদন্ত করে সংসদে পাঠাবে।” আইনমন্ত্রী বলেন, “বিচারপতিদের রায়ের সঙ্গে অভিশংসনের কোনো স¤পর্ক নেই। রায়ের জন্য তারা অভিশংসনের মুখোমুখি হবেন না। সংসদ কর্তৃক অভিশংসন ব্যবস্থায় তাদের স্বাধীনতা একবিন্দুও ক্ষুণœ হবে না।” তিনি বলেন, “কেবল বড় ধরনের অসদাচরণ ও অযোগ্যতার অভিযোগ প্রমাণিত হলেই বিচারপতিরা অভিশংসনের সম্মুখীন হবেন; অন্য কোনো কারণে নয়।” অভিশংসনের যাতে অপব্যবহার না হয় আইনটি সেভাবেই প্রণীত হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। প্রসঙ্গত, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছেন সে রায়েও এই ক্ষমতা বিচার বিভাগের কাছে রাখার পক্ষে অভিমত রয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনের (অপসারণ) ব্যপারে সংসদকে দেয়ার প্রস্তাব চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করা হয়েছে। ২০১২ সালে তৎকালীন ¯িপকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। সে সময়ই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জোরালো হয়।