সনাতনধর্মীদের অস্তিত্বরক্ষায় মোদির হস্তক্ষেপ কামনা কী বার্তা দেয়?
রিয়াদুল হাসান || ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বার্তা সংস্থা পিটিআই’র বরাত দিয়ে খবরটি ছেপেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অনলাইন ও হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইউনিট কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী রানা দাসগুপ্ত পিটিআইকে বলেছেন, “মৌলবাদী ও জামায়াতিরা বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের মূলোৎপাটনের চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট দেশ হিসেবে ভারত এক্ষেত্রে কিছু করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে আমাদের বড় আশা রয়েছে। তার উচিত এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।”
একটি সমাজ থেকে যখন ন্যায়বিচার হারিয়ে যায়, অপরাধীর মধ্যে বর্ণাশ্রম প্রথা মান্য করা হয় তখন, অপরাধী ও প্রশাসন মাসতুতো ভাইয়ের মতো সন্ধিবদ্ধ হয় তখন সেখানে নির্যাতিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষ হাহাকার করতে থাকে। ভারতভাগের সময় থেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে আমাদের দেশে অবাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছে। বলা হয় তাদের এক পা নাকি ইন্ডিয়ায় থাকে। কথায় কথায় তাদেরকে বলা হয়, ‘ইন্ডিয়ায় চলে যাও।’ নিজের পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে তারা কোথায় যাবে? যিনি বলছেন ভারতে চলে যেতে তিনি কি ভারত থেকে আগত কোনো মুসলিম পরিবারকে ভাই বলে আশ্রয় দিবেন? জীবনেও দিবেন না, তার প্রমাণ সিরিয়ার উদ্বাস্তু মুসলমানেরা যারা আরবের দেশগুলোতে আশ্রয় না পেয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেশ্যাবৃত্তি ও ভিক্ষাবৃত্তি করছেন।
প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা এদেশে হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু তাদের একটি বড় ভরসা হচ্ছে তিনদিকে ঘেরা বিরাট সংখাগরিষ্ঠ সনাতনধর্মীদের দেশ ভারত ও তার প্রধানমন্ত্রী যিনি স্বয়ং হিন্দুত্ববাদী। আমি হিন্দু ধর্মকে কটাক্ষ করছি না, কেবল বলতে চাচ্ছি হিন্দুত্ববাদ আর ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ আসলে একই বিষয়। আদতে সনাতন আর ইসলাম একই ধর্ম, যার অনুসারীরা উভয় ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে সরে গেছেন বহু শতাব্দী আগেই। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার এখন সব ধর্মের অতি ধার্মিকদের একটি প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে মুসলিমদের যেভাবে কোনে ঠাসা হয় এখানে হিন্দুদেরকে কোনে ঠাসা হয়। দু জায়গাতেই সংখ্যালঘু দলনে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়। এটা অস্বীকার করার জো নেই, ধর্মভিত্তিক ও সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলো সুযোগ পেলেই রাজনৈতিক স্বার্থহাসিলে ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুকে উসকে দিয়ে ধর্মকে ট্রাম্পকার্ড হিসাবে ব্যবহার করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা পর্যন্ত ধর্ম ও ধর্মবিদ্বেষকে ভোটে জেতার জন্য ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশে সনাতনধর্মীরা দীর্ঘকাল ধরে নির্যাতিত, তাদের বাড়িঘর দখল করে নেওয়া, তাদের মা-মেয়েকে ধর্ষণ করা, মন্দির ভেঙে ফেলা সব সময়ই চলছে। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে তথ্য অতিরঞ্জিত করা হয় কিন্তু যারা বলেন পুরোটাই অসত্য তারা সত্যের অপলাপ করেন। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আমাদের দেশে ভয়াবহ বাস্তব সমস্যা। এদেশকে অসাম্প্রদায়িক বলা পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়। কোনো কোনো এলাকায় এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে অনেকটা সাপে নেউলে অবস্থা। মালু ডাক যে পরিমাণ এই দেশের হিন্দুদের শুনতে হয় যে অনেকে তার নিজের নামও ততবার শোনে না। অনেক এলাকার নামই আছে মালুপাড়া। সোনাইমুড়িতে হেযবুত তওহীদের সদস্যদেরকে মসজিদের মাইকে লোক ডেকে হত্যার আহ্বান করেছে ইসলামের পুরোহিত আলেমগণ। তাদের মিথ্যা ফতোয়ার উস্কানিতে ইসলামিক উগ্রপন্থী রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে বর্বরভাবে হামলা চালিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার জনতার মাঝখানে পুলিশের সামনে হেযবুত তওহীদের দুইজন সদস্যকে জবাই করে, চোখ তুলে, হাত পায়ের রগ কেটে, পেট্রল ঢেলে তাদের লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা উল্লাস করতে থাকে যে, খ্রিষ্টান মেরেছি। আসলে কিন্তু সেখানে গির্জাও ছিল না, খ্রিষ্টানও ছিল না। কিন্তু আহ্বান করা হয়েছিল খ্রিষ্টান হত্যার জন্য, গির্জা ভাঙার জন্য। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক উস্কানি। জনগণও সেই সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে উত্তেজিত হয়েছে। কিন্তু জবাই করেছে দুই জন মুসলিমকে আর ভেঙেছে গির্জা নয় মসজিদ।
কী পৈশাচিকতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এদেশের ধর্মব্যবসায়ীদের মনে লালিত হচ্ছে সেটা বুঝতে শত শত ঘটনার প্রয়োজন হয় না, এই একটি ঘটনাতেই প্রকাশ পায়। চাপাতি দিয়ে গুপ্তহত্যা তো চলছেই কয়েক বছর ধরে। এত হত্যাকা-ের পরও, ভিন্ন ধর্মের এত পুরোহিত মারার পরও, এত মানববন্ধন করার পরও যদি সরকার কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারে, উল্টো যদি রমজান মাসে পুলিশ বাহিনী গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করে দেয় তখন পিযুষ রাণারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, সরকারের উপর আঞ্চলিক প্রভু রাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগ কামনা করলে সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর দ্বারা নিজের দেশকে কতটুকু ছোট করা হয় সেটা গভীরভাবে চিন্তা করেছেন কিনা সন্দেহ।
আমাদের দেশে যেই যখন সরকারে গেছে বা বিরোধীদলে গেছে সেই অভ্যন্তরীন সংকট সমাধানের জন্য আঞ্চলিক ও পশ্চিমা পরাশক্তিদের কাছে ধর্না দিয়েছেন বহুবার। রানাদাশ গুপ্ত ও পিযুষ বন্দোপধ্যায় হয়তো তাদের দেখেও শিখে নিয়েছেন এই কূটনৈতিক কলাকৌশল।
কিন্তু না। বিষয়টা অত সোজা নয়। সবাইকে মনে রাখতে হবে, নিজ দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য তৃতীয় বৃহৎ শক্তিকে ডেকে আনলে তার পরিণতি হয় মীরজাফরের মতো। নিজের গদিও থাকে না, দেশও থাকে না। পিযুষ রাণা যদি ভারতীয় নাগরিক হয়ে এই দেশে অভিবাসী হয়ে থাকতেন, তাহলে এটি হয়তো ন্যায্য হতো। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে, বাংলাদেশের সম্মানজনক জায়গায় বসে এই কাজটি করা তাদের মোটেও উচিত হয় নি। আমি বলব, তাদের এই কাজটি রীতিমতো আত্মঘাতী। আমি বিশ্বাস করি না, কোনো দেশপ্রেমিক বাঙালি এই কাজ করতে পারেন।
দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার সমাধান করতে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে অনেকেই। কেননা সরকার উগ্রপন্থী আলেমদের সমীহ করে, তাদের দাবি পূরণ করে, সুযোগ সুবিধা দিয়ে শান্ত রাখার নীতি অনুসরণ করেছে। ফলে আদর্শিকভাবে তারা সংশোধিত হন নি, জনগণও প্রকৃত ইসলামের পরিচয় পায় নি। এখন সরকার চেষ্টা করছে শক্তি দিয়ে জঙ্গিদের নির্মূল করতে। তাদের কাছে এটাই যথাযথ পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে কিন্তু এটা যত বেশি প্রয়োগ করা হবে, ততই বিদ্বেষ আর উগ্রতা বাড়তে থাকবে। পরিসংখ্যান বলে শুধু শক্তি প্রয়োগের পথে গেলে জঙ্গিদের চোরাগোপ্তা হামলা, আত্মঘাতী হামলা বাড়তেই থাকে, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ক্ষয়ক্ষতিও। সম্প্রতি ফ্লোরিডায় সমকামীদের একটি ক্লাবে একজন আইএস সদস্য একা পঞ্চাশজন সমকামীকে হত্যা করেছেন, পঞ্চান্নজনকে আহত করেছেন। তারপর পুলিশের গুলিতে নিজেও নিহত হয়েছেন। আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বড় বড় পরাশক্তিগুলো। সুতরাং মতবাদগত সন্ত্রাসকে যত দমন করা হয় তত তা আগ্রাসী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশ সরকার কি দেখে শিখবে না ঠেকে শিখবে সেটা নীতিনির্ধারকদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সাথে সাথে আমি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আলেম-পুরোহিত, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী-সহ সকল মানুষকে সাম্প্রদায়িক-সেক্যুলার সর্বপ্রকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনুরোধ করছি। লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশেরপত্র ডটকম।