Connecting You with the Truth

সমাজ নিয়ে কেউ ভাবে না

মোহাম্মদ আসাদ আলী:

কালের প্রবাহে আজ আমরা এমন একটি শোচনীয় পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছি যেখানে ব্যক্তি নয়, ধ্বংসের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে আমাদের সমাজ। মনুষ্যত্ব হারিয়ে সামাজিক জীব মানুষ রূপ নিয়েছে অমানবিক প্রাণিবিশেষে। এমন কোনো অন্যায়, অপরাধ নেই যা আমাদের সমাজে হচ্ছে না। নিজের পিতা-মাতাকে জবাই দিতেও মানুষের আত্মা কাঁপছে না, কোলের শিশুর জীবন নিতে দ্বিধা আসছে না, কয়েকশ’ টাকার লোভে নৃশংসভাবে একজন আরেকজনকে হত্যা করছে। স্বার্থের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত ন্যায়, সত্য, সুবিচার। এই ব্যক্তিগত স্বার্থান্ধতা হুমকির মুখে ফেলেছে সমাজকে। কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে সমাজের ঐক্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য। সমাজ হয়ে পড়ছে ভঙ্গুর, মেরুদণ্ডহীন প্রথাবিশেষে।
মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক জীব। বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে প্রতিক্ষণে সমাজের সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। সমাজকে দিয়ে এবং সমাজ থেকে নিয়ে মানুষের পথচলা। চিরকালই মানুষের পরম বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে তার সমাজ, তার আশেপাশের পরিচিত-অপরচিত মানুষগুলো। সমাজে মানুষে মানুষে সহযোগিতা-সহমর্মিতার মাত্রা যত বেশি থাকে সমাজ তত বেশি শক্তিশালী ও দৃঢ় হয়। আর সহযোগিতার পরিধি ক্ষুদ্র হলে সে সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুদ্রতায় ডুবে থেকে ধ্বংসের প্রহর গুণে। বর্তমানে আমাদের সমাজের হাল-হকিকত সকলেরই জানা। যাদের দৃষ্টি আছে, অন্ধকার নামলে তাদেরকে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না যে অন্ধকার নেমেছে, তা রাতের অন্ধকারই হোক আর মিথ্যার অন্ধকারই হোক, আর যাদের দৃষ্টি নেই, অন্ধকার কেন, মৃত্যুখাদের কিনারে দাঁড়িয়েও তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে।
আফসোস এই জাতির জন্য, এই কোটি কোটি মানুষের জন্য, যারা ইতোমধ্যেই বোধ-বুদ্ধি খুইয়ে নিজেদের ও অনাগত বংশধরের জন্য মৃত্যুউপত্যকা রচনা করেছে নিশ্চিন্তমনে, কোনো প্রকার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ব্যতিরেখে। পতনোন্মুখ এই সমাজের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখে, নির্যাতিত, নিপীড়িত, দুঃখ-কষ্টে কাতর মানুষের আর্তনাদ দেখেও যাদের কপালে ভাঁজ পড়ে না। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় স্বচক্ষে দেখার পরও যারা খাচ্ছে-দাচ্ছে, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করছে কোনো প্রকার উদ্বেগ ছাড়াই, নির্বিকার চিত্তে। সমাজের এই অধঃপতন কি মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে না? পারছে, আসলে সমস্যাটা ওখানে নয়, সমস্যা হচ্ছে- মানুষের স্বার্থবাদিতা তাকে সমাজের এই অধঃপতন রোধে করণীয় থেকে বিরত রেখেছে। স্বার্থ নামক সামাজিক মহামারিটি সমাজকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছে যে, দয়া, মায়া, মমতা তার কাছে গৌণ। অপরের কী হচ্ছে না হচ্ছে, সুখে-আছে নাকি দুঃখে আছে, খেতে পেল কি পেল না- তা দেখার বিষয় নয়। নিজ দেশকে ভুলে, নিজ সমাজকে ভুলে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিজ পরিবার-পরিজনকে ভুলে মানুষ ব্যস্ত থাকছে নিজেকে নিয়ে। সমাজের প্রতিটি মানুষ আজ মোহাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অর্থের মোহ, ক্ষমতার মোহ, মান-সম্মানের মোহ বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরীমাকে করেছে অচল-অসার-নির্জীব।
এখন বলুন- এভাবে সমাজ চলতে পারে? সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সহযোগিতা, কেননা সমাজের প্রতিটি মানুষ সর্বদা একে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকে। এই সহযোগিতার শর্ত ভঙ্গ করে যদি স্বার্থবাদিতার ভিত্তিতে কোনো সমাজ দাঁড়াতে চায় সেটাকে আর যাই হোক মানুষের সমাজ বলা যায় না। তাই অতি জরুরি ভিত্তিতে এখনই সমাজকে ঢেলে সাজাতে হবে। সমাজ নিয়ে ভাবতে হবে। কেন ভাবতে হবে তার পক্ষে আরও ব্যাখ্যা আছে।
সমাজ হলো একটি ছাঁচ (গড়ষফ)। এই সাঁচে পড়ে ওই সমাজে বসবাসকারী মানুষের চরিত্র রচিত হয়। একটি মানবশিশু জন্মের সাথেই কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। যেমন শিশুটি ছেলে হলে এক ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়, মেয়ে হলে আরেক ধরনের। অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক কিছু প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য সে জন্মগতভাবেই লাভ করছে। কিন্তু এটা লক্ষণীয়, এ বেশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে শারীরিক বৈশিষ্ট্য, মানসিক বা চরিত্রগত নয়। চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হলো বৈধ-অবৈধ বা ন্যায়-অন্যায়বোধ, শিষ্টাচার, আদব-কায়দা, সহানুভূতি, দয়া-মায়া, ভালোবাসা, পরোপকারিতা ইত্যাদি। এই গুণগুলো একটি শিশু জন্মগতভাবে পায় না, এগুলো সে লাভ করে পরিবার, খেলার সাথী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সমাজ থেকে। একে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সামাজিকীকরণ।
পরিবার ও সমাজকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। কারণ পরিবার সমাজেরই একটি ক্ষুদ্রতম একক। একটি শিশু জন্মলাভ করার পর প্রথম সমাজের এই ক্ষুদ্রতম একক অর্থাৎ পরিবারের সাথে পরিচিত হয়। পরিবার থেকে সে আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, প্রাথমিক ন্যায়-অন্যায়বোধ শিক্ষা লাভ করে। শিশুর জীবনে সর্বাধিক প্রভাব পড়ে পরিবারের। তার পরিবার যে ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মবিশ্বাস লালন করে ওই শিশুটিও সেদিকেই প্রবাহিত হয়। পরিবার যদি সুশৃঙ্খল হয়, রুচিশীল হয়, মার্জিত ও ভদ্র-সভ্য হয় সে পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুটিও সাধারণত সুশৃঙ্খল, মার্জিত রুচিশীল ও ভদ্র-সভ্য হয়। আর পরিবার যদি কলহপূর্ণ হয়, ঐক্যহীন হয় তাহলে শিশুও সেভাবে বেড়ে ওঠে।
এই পরিবারেরই বৃহত্তর সংস্করণ হলো সমাজ। কাজেই পরিবার যেভাবে একটি শিশুর চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করছে, সমাজও সেভাবেই ওই সমাজবদ্ধ প্রতিটি মানুষের চরিত্রকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি মাছ যখন পুকুরে বসবাস করে তখন তার বসবাসপ্রণালী একরকম থাকে, যখন বানের জলে ভেসে নদীতে যায় তখন ভিন্ন রকম হয়, আবার যখন নদী বেয়ে সমুদ্রে পৌঁছে তখন অতল সমুদ্রের বিভিন্ন প্রভাবকের সংস্পর্শে এসে তার জীবনপ্রণালী অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত একজন মানুষ পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হয়, সে বয়স পেরিয়ে গেলে তার জীবনের গতিপথ নির্ধারিত হয় সামাজিক ব্যবস্থার আলোকে। দাঙ্গাপ্রিয়, হিংসাত্মক, ষড়যন্ত্র ও অকৃতজ্ঞতায় পূর্ণ সমাজে আবদ্ধ হয়ে ভালো মানুষও হিংসা-বিদ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজে বসবাসরত অসৎ ও দাঙ্গাপ্রিয় লোকও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৎ জীবনের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়। স্রোতের বিপরীতে খুব কম জনই তরী বইতে পারে।
যাই হোক, কোনো প্রকার চিন্তা-ভাবনা ব্যতিরেখেই এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আমরা বর্তমানে যে সমাজে বসবাস করছি সে সমাজ ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজ নয়, এ সমাজের সঞ্জিবনী শক্তি হলো স্বার্থ। স্বার্থকেন্দ্রিক এ সমাজে আপনি যতই ভালো হয়ে থাকার চেষ্টা করুন, ব্যর্থ হবেন, জীবনের প্রতি পদে হোঁচট খাবেন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অতি স্বল্পসংখ্যক মানুষ হয়তো এই বিপরীত স্রোতকে ডিঙ্গিয়ে যেতে সক্ষম হবেন কিন্তু মোটের তুলনায় তারা এতই নগণ্য যে, সমষ্টির চাপে তাদেরকে থাকতে হবে কোনঠাসা হয়ে। তারা সৎ হবেন বটে, কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা এতই প্রখর যে, অন্যের অপকর্ম মুখ বুঁজে দেখা ছাড়া উপায় থাকবে না। এটাকে যদি আপনি সততা বলেন তাহলে গোটা জাতিতে হয়তো এমন হাতে গোনা কিছু সৎ লোকের দেখা মিলবে। কিন্তু বাকিদের অবস্থা? তারাই তো সমাজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বাঙ্গে অজগরের ন্যায় পেঁচিয়ে আছে। তাদের কথা ভাববে কে?
সমাজ নিয়ে যারা এক-আধটু চিন্তা-ভাবনা করেন, ভাবলে ভুল হবে যে, তাদের এ প্রয়াসের কারণ সমাজের উন্নতি ঘটানো, বরং তাদের এত ভাবনা-চিন্তার পেছনেও স্বার্থ কাজ করে। শিক্ষাকে তারা পণ্যে রূপ দিয়ে দরকষাকশি করছেন প্রতিনিয়ত। সমাজের গতিপথ কতটা মঙ্গলজনক, কতটা অমঙ্গলজনক- সেটা তাদের গবেষণার তালিকায় স্থান পায় নি, কারণ ওটাতে লাভের পাল্লায় কেবলই শুন্য। অন্যদিকে যে ধর্ম এসেছে সমাজের কল্যাণের জন্য, সেই ধর্মই এখন সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তির বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ধর্ম আর ধর্ম নেই, ধর্মগুরু প্রতারকরা ধর্মকে বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। আর্থিক বাণিজ্য, রাজনৈতিক বাণিজ্য- সবখানেই ধর্মের বাম্পার চাহিদা। ফলে সমাজ ও ধর্ম এখন বিপরীত অভিমুখে গতিশীল দুই মেরুর বস্তু। ধর্মব্যবসায়ীদের বাইরে যে কথিত ধার্মিক শ্রেণিটি বিদ্যমান তারা সমাজকে দুনিয়া জ্ঞান করে ও সমাজে চলা অন্যায়, অবিচারকে ফেতনা জ্ঞান করে সর্বদা এড়িয়ে চলেন। তাদের দৃষ্টি কখনও সাত আসমানের নিচে নামে না। সমাজকে পবিত্র করে যে পৃথিবীকেও স্বর্গে পরিণত করা যায় সে বোধ তাদের নেই। এভাবে সবাই যখন সমাজবিমুখ হয়ে নিজ নিজ স্বার্থের সিন্দুক আগলে রাখছেন, তখন একদল সন্ত্রাসী, অপরাধী, গডফাদাররা সমাজের দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছে। ফলে কাকের ডিম ফুটে যেমন কোকিলশাবক বেরোয় না, তেমন এই অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজও ভালো মানুষ তৈরি করতে পারছে না।
এই যখন অবস্থা, তখন একটি বারও ভেবেছেন কি, আপনার অনাগত সন্তানের জন্য কেমন সমাজ রেখে যাচ্ছেন? মনে রাখবেন, এই সমাজের অনুকূলেই কিন্তু আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরের চরিত্র নির্মিত হবে। আমাদের সমাজ তো এমন ছিল না। কোথায় গেল বাঙালির চিরাচরিত সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য? কেন প্রকাশ্য দিনেদুপুরে একজন মানুষকে খুন করে খুনিরা শত শত মানুষের সামনে দিয়ে বীরদর্পে চলে যায় আর মানুষ দর্শকের ভূমিকা পালন করে, এমনকি কেউ ওই আহত ব্যক্তিকে টেনে তোলার সাহসটুকুও দেখায় না? কীভাবে আমাদের সমাজে স্বার্থবাদ এত প্রকট আকার ধারণ করল? এ প্রশ্নের উত্তর আজ হোক কাল হোক সন্ধান করতেই হবে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের সমাজব্যবস্থার শত শত বছরের ইতিহাস হচ্ছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ইতিহাস। সে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে কীভাবে স্বার্থবাদভিত্তিক নতুন এক কলঙ্কজনক ইতিহাসের পথ রচিত হলো তা অবশ্যই ভাবার বিষয়।

লেখক: হেযবুত তওহীদের সদস্য।

Comments
Loading...