সামাজিক অপরাধ দূরীকরণে প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা
রাকীব আল হাসান
গতকাল একটি খবর সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় ৫ দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল সকালে চার শিশুর মাটিচাপা দেওয়া লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত শুক্রবার বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে এই চার শিশু নিখোঁজ হয়। বিষয়টি নিয়ে গত তিন দিন ধরে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে আসছিল। তারপর গতকাল সকালে একই গ্রামের বাইরের একটি জায়গায় মাটি ও বালুচাপা অবস্থায় একটি শিশুর লাশ পাওয়া যায়। শিশুর লাশ দেখে পুলিশে খবর দেওয়া হলে মাটিচাপা দেওয়া অন্য শিশুদের লাশ পুলিশ উদ্ধার করে।
প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললে এ ধরনের নৃশংস হৃদয়বিদারী খবরগুলো চোখের সামনে ওঠে, যা কোনো মানবসমাজের চিত্র হতে পারে না। এ যেন নরকতুল্য একটি আবাসভূমি, যে ভূমিতে অনুষ্ঠিত প্রতিটি অমানবিক ঘটনা ধিক্কার জানাচ্ছে কথিত মানবসভ্যতাকে, মানুষের মিথ্যা অহংকারকে, তার অস্তিত্বকে। মানুষের বিবেকহীন নির্লজ্জ আসুরিক কর্মকা- আজ পশুকেও হার মানিয়েছে। মানুষ তার প্রধান ধর্ম মানবতা ও মনুষ্যত্বকে ত্যাগ করেছে স¤পূর্ণভাবে। মানুষের মধ্যে পার®পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, কূটিলতা, স্বার্থপরায়ণতা ইত্যাদি যখন বৃদ্ধি পায়, এক কথায় মানুষের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটে তখন সে মনুষ্যত্ব হারায়। সমাজে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে।
মানুষের চারিত্রিক অবনতি ও অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পুলিশ পাহারা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না, উপরন্তু যদি শান্তিরক্ষাকারীদের মধ্যেই দুর্নীতি প্রবিষ্ট হয় তখন শান্তি আসার শেষ পথটিও বন্ধ হয়ে যায়। তথাপি মানুষের শান্তির লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাদেরকে আধুনিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে। যে অপরাধের সাজা ছিল ১০ বছর, তা বাড়িয়ে করা হচ্ছে যাবজ্জীবন, যে অপরাধের সাজা ছিল যাবজ্জীবন তা এখন মৃত্যুদ- করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো দিনকে দিন মানুষের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেই অপরাধ সংঘটন করছে। পুলিশ প্রহরায় রাস্তাঘাটে হয়তো অপরাধ সংঘটন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু বাড়ির মধ্যে স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে, মেয়ে বাবা-মাকে হত্যা করছে, ভাই ভাইকে হত্যা করছে, পিতা-মাতা সন্তানকে হত্যা করছে, এই ভয়াবহ অবস্থায় শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষারোপ করার কোনো যুক্তি নেই। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মূলত অর্থের প্রতি প্রবল মোহের অসম প্রতিযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, অন্যদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা, দা¤পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর পর¯পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা, সামাজিক উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না থাকা, রাষ্ট্রের উদাসীনতা, বিষণœতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন ধরনের খুন, গুম, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি সামাজিক ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। আর এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে হচ্ছে। সমস্ত পরিসংখ্যান বলছে, দিন দিন অপরাধ বাড়ছে, উদ্ভাবিত হচ্ছে অপরাধের নিত্য-নতুন কলাকৌশল। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে, দ-বিধি দেখিয়ে মানুষকে অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটা আত্মাও আছে। এই আত্মাই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষকে যদি আত্মিক শিক্ষা দেবার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে যদি নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তবে সে নিজেই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অপরাধ সংঘটন থেকে নিবৃত থাকবে। অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষেকে বিরত রাখার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা, পাশাপাশি অপরাধের জন্য কঠোর দ-বিধিও থাকতে হবে।
পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের বড় পার্থক্য হলো এতদঞ্চলের সমাজ বস্তুবাদভিত্তিক নয়, বিশ্বাসভিত্তিক। এখানকার মানুষ হাজার হাজার বছর থেকে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। কেউ ইসলাম ধর্ম, কেউ হিন্দু ধর্ম, কেউ বৌদ্ধ ধর্ম। অর্থাৎ এখানে ধর্মবিশ্বাসহীন লোক খুবই কম। ধর্ম তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে, তাই এখানে পাশ্চাত্যের সব দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি খাপ খায় না। এখানে ধর্মের শিক্ষা দ্বারাই মানুষের আত্মিক শুভ পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ধর্মের শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- মানুষ বিশ্বাস করে যে সে পৃথিবীর সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আল্লাহর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। প্রতিটি কাজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব তাকে একদিন দিতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহ, রসুল, অবতারগণের উন্নত জীবনাদর্শ তার হৃদয়ে জাগরিত থাকে, সে লাগামহীন উচ্ছৃঙ্খলতার তুলনায় ন্যায়নিষ্ঠ, পরিশিলীত জীবনযাপনকে ভালোবাসতে থাকে। ধর্মের প্রভাবেই মানুষ একসময় ছিল সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, আদর্শবান। অথচ আজ পশ্চিমা ধর্মহীন জীবনদর্শন ও অসভ্য সংস্কৃতির দাপটে জীবন থেকে ধর্মের মূল্যবোধ (গড়ৎধষ ঠধষঁবং) প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রতিটি ধর্ম এখন ধর্মব্যবসায়ীদের স্বার্থসিদ্ধি ও অপরাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, ফলে জাতীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্ম এখন কার্যকারিতাহীন নিছক পোশাকী একটি বিষয়। ধর্মব্যবসায়ীদের দুষ্কর্মের কারণে মানুষ দিনদিন ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর বর্তমানে ১২০ কোটি মানুষ নিজেদেরকে কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নয় বলে দাবি করে থাকেন।
ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা হারিয়ে যাওয়ায় সমাজে যারা ধর্মের একেবারে ধ্বজাধারী হিসাবে পরিগণিত তারাও এমনসব কুকর্ম ও অপরাধে বিজড়িত হয়ে পড়েন যে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তারাও শ্রদ্ধার পাত্র না হয়ে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। মোট কথা আমাদের সমাজে যে ধর্ম প্রচলিত আছে তা একান্তই উপাসনাকেন্দ্রিক- সমাজকেন্দ্রিক নয়। এর নৈতিক শিক্ষাগুলি বহুবিধ কারণে মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারছে না। তাদের জন্য প্রয়োজন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা। মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে ধর্ম কী? প্রকৃত ইবাদত কী? মানুষের কাছে স্রষ্টার চাওয়া কী? কাজ ও কাজের পরিণতি (হাশর) কী? মানবজন্মের সার্থকতা কীসে ইত্যাদি। অতি সংক্ষেপে মূল কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি:-
(১) ধর্ম: প্রকৃতপক্ষে ধর্ম হলো কোনো পদার্থ বা প্রাণীর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো। ঠিক একইভাবে মানুষের ধর্ম হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্য, বিবেক, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলীই হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবে পরিগণিত হবার যোগ্য, কেননা তার ভিতরে মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি আছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি নামায, রোযা, হজ, পূজা, অর্চনা, উপাসনা ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত ব্যাপৃত থাকে কিন্তু তার ভিতরে মানবতার গুণাবলী সে প্রকৃত ধার্মিক নয়, আল্লাহর প্রকৃত উপাসক নয়।
(২) প্রকৃত ইবাদত ও মানবজীবনের সার্থকতা: মানবজাতির শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য কাজ করাই মানুষের প্রকৃত ইবাদত। যখন কারো বাড়িতে আগুন লাগে তখন যারা সেই আগুন নেভাতে না গিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ে তারা আসলে আল্লাহর ইবাদত করছে না। মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যে কেবল উদরপূর্তি, সংসারবৃদ্ধি ও দেহত্যাগ করা নয়, ওটা পশুর জীবন। মানুষ আল্লাহর রূহ ধারণকারী, আল্লাহর নিজ হাতে সৃষ্ট আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য স্থির করে দিয়েছেন যে, মানুষ যদি তার সমগ্র জীবনকালে স্বার্থকে কোরবানি দিয়ে মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে তবেই তার মানবজনম সার্থক হবে। মানুষ যদি এই প্রত্যয় করে যে, সে বাঁচবে মানবতার কল্যাণে, মরবে মানবতার কল্যাণে, জ্ঞান লাভ করবে মানুষকে দেওয়ার জন্য, জগতের উন্নতির জন্য, দুটো পয়সা রোজগারের জন্য নয় তবেই এই পৃথিবীতে তার আসার উদ্দেশ্য সার্থক হল।
(৩) হাশর: মানুষের জীবন কর্মফলের চক্রে বাঁধা। মানুষ যে কাজই করে তার ফল অবশ্যই তাকে ভোগ করতে হবে। এখানে যদি সে খারাপ কাজ, মন্দ কাজ, মানুষের জন্য অকল্যাণকর কাজ করে তবে পৃথিবীতেই তাকে তার কুফল ভোগ করতে হবে, হাশরের দিনও তার কষ্টদায়ক ফল ভোগ করতেই হবে।
মানুষের আত্মিক এবং মানসিক পরিশুদ্ধির এই প্রশিক্ষণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাগুলির মধ্যেও নেই, ধর্মব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত হয়ে থাকা বিকৃত ধর্মেও নেই, ধর্মের এই প্রকৃত শিক্ষাগুলো আছে একমাত্র হেযবুত তওহীদের কাছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।