হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহের বাঁশশিল্প
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি:
ঝিনাইদহ জেলায় এক সময় শহর ও গ্রাম সবখানে বাঁশের তৈরি মোড়া ও মিটসেফের ব্যবহার ছিল সচরাচর। বাড়িতে মেহমান আসলে মোড়ায় বসতে দেয়ার দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। বর্তমানে প্লাস্টিকের চেয়ার দখল করেছে সেই জায়গায়। রান্নাঘরেও ঢুকেছে বাঁশের পরিবর্তে লোহার পাত দ্বারা তৈরি মিটসেফ।
এক সময় গ্রামে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি, ধামা, মোড়া, কুলা, মাছধরার নানান জাতের ফাঁদ, ধান রাখার ডোল, গোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। কালের আবর্তে আধুনিক সভ্যতার উৎকর্ষতায় হারিয়ে যেতে বসেছে এসবের ব্যবহার। গভীর দরদে, সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় যারা এসকল জিনিসপত্র তৈরি করতো সে সকল কারিগরদের অধিকাংশই দিন দিন বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে এ পেশার উপর। যদিও পূর্বপুরুষের শেখানো এসকল কাজ এখনও তারা করে যাচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে নয়, নিজেদের ব্যবহারের জন্য ও খুচরা দু’একটি বিক্রির উদ্দেশ্যে।
শিবনগরের বাঁশশিল্পী বিমল দাস জানান, বর্ষাকালে আগের মতো পানি না হওয়ায় এবং কৃষিতে কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে খাল-বিলে মাছ না থাকায় মাছ ধরার নানান ফাঁদ তৈরি করা বাদ দিয়েছেন অনেক আগেই। এদিকে কৃষক আর গোলা ভরে ধানও রাখতে পারে না কারণ ধান ওঠার সাথে সাথে বিক্রি করে উৎপাদন ব্যয় পরিশোধ করতে হয়। কাজেই ব্যবহার কমেছে গোলা আর ডোলের। তাই এখন ঝুড়ি, টেপারি ও চাটাই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে কালীগঞ্জের বাঁশশিল্প। অথচ এক সময় ছিল, কি শহর কি গ্রাম প্রতিটি বাড়িতে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র ছাড়া যেন কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু কালের আবর্তে আমাদের বাঁশশিল্প এখন মৃতপ্রায়। কালীগঞ্জের অনেক ঋষি পরিবার পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে চলে গেছে অন্য পেশায়। কিন্তু এখনও এ শিল্পকে আঁকড়ে আছে পোড় খাওয়া স্বল্পসংখ্যক শিল্পী যারা পূর্বপুরুষের শেখানো কাজের ওপর মেধা ও শ্রম দিয়ে দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন মৃতপ্রায় এ শিল্পটিকে। কালীগঞ্জের বিমল দাস, তারা দাস, সুধীর দাস, চম্পাদাস, আরতী দাস তাদের কয়েকজন। বাঁশশিল্পী বিমল দাস জানান, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে তিনি এ পেশায় আছেন। লাভ কম হলেও মাঠে কৃষি জমি না থাকায় এখনও এ পেশায় জড়িত থাকতে হচ্ছে তাকে। শিব নগরের বিমল দাস ও চম্পা দাস জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে দিনে ৪/৫টি টেপারি তৈরি করেন। প্রত্যেকটি টেপারি ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করে। এতে টেপারি প্রতি ১৫ টাকা করে লাভ থাকে। এ দিয়েই কোন রকমে চলছে তাদের সংসার। চম্পা দাস বলেন, অন্য জিনিসের চাহিদা কম থাকায় তারা এখন ঝুড়ি ও টেপারির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এ শিল্পের চাহিদা কমতে থাকায় অনেক পরিবার বর্তমানে পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে এখন অন্য পেশায় গেছেন। শিবনগরের সুধীর দাস ও আরতী দাস জানান, তাদের ছেলেরা এখন ফার্নিচারের কাজ করেন। পূর্ব পুরুষের পেশা ছাড়তে কষ্ট হয়, তাই তারা দু’জন বাড়িতে বসে ঝুড়ি ও টেপারি তৈরি করেন। চাঁচড়া গ্রামের সমীর দাস শুধু চাটাই তৈরি করেন। দিনে ২টি করে চাটাই তৈরি করা সম্ভব হয় বলে তিনি জানান। একটা চাটাই বিক্রি হয় ২২০ টাকায়। তৈরি করতে খরচ পড়ে ১৪০ টাকা। চাঁচড়া গ্রামের তারাপদ দাস জানান, বাঁশের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না। কালীগঞ্জের ভাটপাড়া জগন্নাথপুর, বেজপাড়া রেলগেট, ভোলাডাঙ্গা, বালিয়াডাঙ্গা, শিবনগর, চাঁচড়া এলাকার ঋষি পরিবারের অনেক সদস্যই পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গিয়েছেন। তারা জানান, পুঁজি না থাকায় তারা দু’একটি করে বিক্রি করায় লাভ খুবই কম হয়। পুঁজি থাকলে একবারে অনেক মাল বিক্রি করতে পারতো, এতে লাভও ভালো হতো। বর্তমানে চট্টগ্রাম, মুন্সিগঞ্জ, যশোরসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাঁশের তৈরি বাহারী সৌখিন জিনিসপত্রের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শহুরে পরিবারে, অফিস, রেস্তোরাঁয় রঙ-তুলির ব্যবহার করা বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিস শোপিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশের বাজারেও এর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। এতে ভালো মুনাফাও পাওয়া যায় বলে জানতে পেরেছেন এ অঞ্চলের বাঁশশিল্পীরা। কিন্তু রঙ-তুলি দিয়ে বাহারী জিনিসপত্র কিভাবে তৈরি করতে হয় সে কৌশল জানা নেই তাদের। কালীগঞ্জের বাঁশশিল্পীরাও চায় তাদের তৈরি জিনিসপত্রে শৈল্পিক রূপ দিতে। এজন্য কালীগঞ্জের বাঁশশিল্পীরা সরকারি বা বেসরকারিভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সুদমুক্ত ঋণ দিতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। অন্যদিকে শিল্পপ্রেমীরা চান কোনভাবেই যাতে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশশিল্প কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়।