‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিশুদের প্রয়োজনীয় ভাষায় শিক্ষা চাই’
এড. বাবুল রবিদাস
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা যায়। আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের কথা আজকের প্রবন্ধে তুলে ধরা হলো। ক্ষুদ্্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানেরা জন্ম প্রতিপালন হয় এক ভিন্ন পরিবেশে। মাতৃগর্ভে যখন বাাচ্চা আসে তখন গর্ভবতী মাতাকে সুষম খাদ্য, চিকিৎসা নিয়মিত চেক আপ না করিয়ে ওঝা, বৈদ্য, বা কবিরাজ এনে ঝাড়-ফুঁকের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে গর্ভের সন্তান পুষ্টির অভাবে যা ওজন নিয়ে জন্মানোর কথা তার থেকে কম ওজন ও অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। মায়ের পেট হতে ভুমিষ্ট হওয়ার পর বাচ্চা চিৎকার দিলেই তারা মনে করে ভূত-প্রেত আছর করেছে। ঐ সময় ভূত-প্রেত তাড়ানোর জন্য দূর থেকে বৈদ্য বা কবিরাজ এনে ঝাড়-ফুঁক চলতে থাকে। ঘরের মধ্যে আগুন, ধূপ-ধোঁয়া দিতে শুরু করে। ঘরের জানালায় জাল ও কাটা জাতীয় জিনিষ টাংগানো হয়।
শিশুকে পশুর চামড়া, ছেঁড়া জুতা, গাছের ছাল, কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মাথার কাছে ও পায়ের কাছে লোহা, ছুরি, দা ইত্যাদি রাখার ব্যবস্থা করে। শিশুর গায়ে গরম তৈল, রসুন-পিঁয়াজ মিশিয়ে মাখা হয়। মায়ের দুধ বাচ্চাকে পান করতে দেয়া হয় না। ফলে ঘরের মধ্যে অক্সিজেনের পরিমান কমে আসে। অক্সিজেনের অভাবে বাচ্চাটি আরো নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ সময় প্রসূতিকে ভাল বা উন্নত খাবার না দিয়ে বিভিন্ন খাবার খেতে নিষেধ করে। এমতাবস্থায় বাচ্চা প্রসূতি মাতা অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়ে। খাদ্য-পুষ্টির অভাবে শিশু হয়ে উঠে রোগা। রোগ মুক্তির লক্ষ্যে শিশুকে তাবিজ বা মাদুলী পড়িয়ে দেয়। শিশুকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গিয়ে ওঝার পরামর্শে শিশুটিকে কোন নদীর ধারে নিয়ে চুল মাথা ন্যাড়া করে দেবতার উদ্দেশ্যে দান করতে দেখা যায়।
এরকম কু-সংষ্কারের মধ্যে দিয়ে অপুষ্টির শিশু বেড়ে উঠে। শিশু একটু বড় হলেই অন্য বৃহত্তর সমাজের সন্তানদের মাঝে খেলতে দেখা যায় না। আদিবাসী পরিবারের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় যে, স্বামী-স্ত্রীকে পরিশ্রম করতে। তাই ছোট বাচ্চাকে মাতা কাপড় দিয়ে পিঠে বেঁধে মাঠে কাজ করে। শিশুটি ঐ অবস্থায় মায়ের পিঠে পুটুলিতে ঘুমায়, আর রৌদ্রে পোড়ে। শিশু হাঁটাহাঁটি বা চলা ফেরা না করার কারণে এবং পুষ্টির অভাবে সঠিক বৃদ্ধি (এৎড়ঃিয) পায়না। শিশুটি এ অবস্থায় মাতৃভাষার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মায়ের কাছে যা দেখে বা শোনে, শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ব্রেন-বুদ্ধির বিকাশ হয় না। নতুন কোন পরিবেশ না পেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হয়, তখন এ পরিবেশ তার কাছে ভয়-ভীতির সৃষ্টি করে। প্রথমতঃ ভাষায়, দ্বিতীয়তঃ আচার-আচরণ, তৃতীয়তঃ সহ-পাঠিদের উপহাসে শিশুটি সর্বত্র হতাশা আর হতাশা দেখে। উপরোক্ত অবস্থাধীনে স্কুল থেকে ছিটকে পড়ার কারণ ঘটে। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেহেতু শিক্ষক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ছাত্রের ভাষাগত সমস্যা দেখা দেয়। এ সমস্যাকে বলা হায় ‘উভয় সংকট।’
আরো একটি জটিল সমস্যা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহপাঠিদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয় না। এটিও একটি বাঁধা। এ প্রসঙ্গে একটি উদহরণ দেওয়া যেতে পারে। তা হলো-ভারতের সংবিধান লেখক ড. ভীম রাও আম্বেদকর। তাঁকে স্কুলের বেঞ্চে বসতে দেয়া হয় নাই। বাড়ি থেকে মাদুর নিয়ে যেতে হতো। কোন পানি কুপ থেকে নিজ হাতে তুলে পান করতে পারতো না। অর্থাৎ সর্বত্র অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্য। এ রকম পরিস্থিতিতে শতকরা কতজন শিশু অতিক্রম করে শিক্ষা অর্জন করতে আগ্রহী হতে পারেন? এ ধরণের প্রতিকুল পরিবেশ কমলমতি শিশুদের শিক্ষা অর্জনে অগ্রগামী করার পরিবর্তে লাইনচ্যূত করে ও ঝড়ে পরে।
এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নেতৃ-বৃন্দের দূরদর্শিতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। কোন নেতা বলেন, বাংলা হরফে আদিবাসী ভাষায় শিক্ষা দিতে হবে। আর এক নেতা বলেন, রোমান হরফে শিক্ষা দিতে হবে এবং ৩য় নেতা বলেন ‘অলচিকি’ ভাষায় শিক্ষা দিতে হবে। যে যার মতো কথা বলছেন। কিন্তু সবাই একত্রে বসে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপস্থাপনা ও সমাধান করছেন না কেন? এর ফল কমলমতি শিশু সন্তানেরা ভোগ করবে কেন?
নেতৃবৃন্দের অভিভাবকদের বাস্তব সম্মত চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বাংলায় লেখা পড়া শুরু করি। প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শুনা করে পাশ করার পর ডিগ্রীধারী ব্যক্তিকে যদি বলি ‘আপনি স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জণবর্ণ সম্পূর্ণটাই আমাকে দ্রুত গতিতে লেখে দেন।’ তাহলে ঐ ব্যক্তি দ্রুততার সাথে পারবে কি না, আমার সন্দেহ আছে? আর ‘‘অলচিকি’’ হরফ পাঁচ বছর শিখে সমস্ত জীবন শিক্ষার্থীগণ মনে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। পাঠকবৃন্দ আপনারা কি মনে করেন?
তবে অন্য কোন হরফে না শিক্ষা দিয়ে বাংলা হরফে শিক্ষা কার্যক্রম সন্তানদের শুরু থেকে দিতে হবে। অন্য ভাষার শিক্ষা ইংরেজি হতে পারে। অন্যথায় ক্ষুদ নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানেরা পিছিয়ে পড়বে, চাকুরি-বাকুরিতে প্রতিযোগীতায় আরো পিছে পরবে। ফল স্বরূপ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানদের অপূরনীয় ক্ষতি ও ক্ষতির কারণ ঘটবে।
সর্বোপরি নিজেদের পারিপাশির্^কতা উন্নত করনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। এদের মধ্যে যারা শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে আছে তাদের উচিত হবে মাঝে মধ্যে এদের নিয়ে বসে আলাপ আলোচানার মাধ্যমে জাগ্রত করা। এদের উন্নতি করণের দিকে ধাবিত ও উৎসাহিত করা। আদিবাসীগণ অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারণে তাদের শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করাতে পারে না কারণ তারা দিন মজুরি করে খায়। দিন আনে দিন খায়।কাজেই শিশুদের লেখা পড়ার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে না। যদিও অনেক দুঃখ কষ্টের মাধ্যমে নিম্ন শ্রেণী পর্যন্ত পড়াতে পারে কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। পিতা মাতার অসচেতনতা, অদূরদর্শিতা কারণে এরূপ হতে দেখা যায়। মায়ের শিক্ষার অভাবের কারণে পারিবারিক শিক্ষার পরিবেশ ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হয়। পিতা মাতার অসচেতনতা ও অদূরদর্শিতার অভাবের কারণে শিশুরা স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে উঠতে পারে। শিশুদের বর্ধিষ্ণু কালে মানষিক সহানুভূতির পরিবর্তে অন্য বৃহত্তর সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ঘৃনা ও অবজ্ঞার কারণে মানসিক দৈন্যতায় অশান্তিতে ভোগে এবং স্বাভাবিক নিয়মে তারা বিকশিত হতে না পারায় অংকুরেই বিনাশ হয়। আবার পিতা মাতা ও অন্যান্য আদিবাসীগণের চলন বলন অর্থাৎ পারিপাশির্^কতা দেখে সেই দিকে ঝুকে পরে, অর্থাৎ পারিপাশির্^কতা সহায়ক না হওয়ায় উন্নততর অবস্থানের চিন্তা-চেতনা জাগ্রত হয় না। বরং তাদের মদ, চুয়ানী ও অন্যান্য নেশা পান করে শিশুরা সেই দিকে ধাবিত হয়। এদের আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান লাভের সুযোগ না থাকায় এরা উন্নতির দিকে যেতে পারছে না। সেই জন্য আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি লাভের জন্য যত দূর সম্ভব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি নিজেদের পারিপাশির্^কতা উন্নত করণের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। আদিবাসী শিশুদের পাঠ্য পুস্তক, খাতা-কলম, স্কুলের বিভিন্ন ফি (মিড ডে মিল), পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা আবশ্যক এবং বিভিন্ন উপায়ে অর্থাৎ সরকারী সাহায্যের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হতে সাহায্য সহানুভ’তির চেষ্টা করা প্রয়োজন।
সমাজের সচেতন অংশের দ্বারা অসচেতন অংশকে ও অরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে সচেতন করা আবশ্যক। আদিবাসী শিশুদের আত্ম বিশ^াসী করে তোলার জন্য এবং অন্যান্যদের তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়ার জন্য চেষ্টা করা আবশ্যক। যাতে অন্যান্যরা ঘৃনা বা অবজ্ঞা না করে। বরং সহানুভুতির সহিত স্নেহের চোখে দেখতে হবে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান লাভের সুযোগ আদিবিাসী শিশুদের মোটেই নাই। তাই আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি লাভের মত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা আবশ্যক। খাদ্য পুষ্টি প্রকল্পের অধীনে সকল দরিদ্র আদিবাসী শিশুদের অন্তর্ভূক্ত করা আবশ্যক।
লেখক:
এডভোকেট
জজ কোর্ট, জয়পুরহাট।