স্বাধীনতার ৪৪ বছর: আজও চলছে সোনার বাংলার রক্ত শোষণ
খন্দকার ইয়াসীন পাভেল:
আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা দিবস। শত শত বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ১৯৭১ সালের এদিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়ে, আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে একাত্তরের এই দিন যে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের মানুষ, দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দিন আজ।
স্বাধীনতা যে কোনো জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। বাঙালি জাতির ৫ হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ঘটনা হচ্ছে দীর্ঘ রক্তাক্ত পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের লাখো মানুষকে আত্মোৎসর্গ করতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য বহু প্রাণের বিনিময়ে এবং অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত সেই স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ ৪৪ বছর পরও আজ পর্যন্ত এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা পায় নি। ঘটে নি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। জানমালের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও আজ বিলীনপ্রায়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পরমতের প্রতি সহিষ্ণুতা ইত্যাদি অতিসাধারণ বিষয়গুলোও আজ অবধি অধরা। এখনও আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে ৪৪ বছর আগের সেই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা থেকেই ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে জাতিগত দাঙ্গার ফলে দুটি ধর্মের ভিত্তিতে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল- হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান। দেওবন্দী উলামাদের এবং আপামর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার লোভ দেখিয়ে জিন্নাহ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ করে নিলেও পরবর্তীতে আর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হয় নি। এটা ছিল জনগণের প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চরম বিশ্বাসঘাতকতা যা প্রকারান্তরে ধর্মব্যবসা ছাড়া কিছু নয়। পাকিস্তান শাসকরা ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া সিস্টেমটাই এখানে চালু করল যা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বৈষম্য এক কথায় অশান্তি। ব্রিটিশরা যেভাবে ভারতবর্ষকে শাসন ও শোষণ করেছে পাকিস্তানিরাও একই নীতি নিয়ে বাংলাদেশকে শাসন ও শোষণ করতে অর্থাৎ উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মূল জনগোষ্ঠী যে মুসলিম, তারা ধর্মীয়ভাবে একই ভ্রাতৃসমাজ ও একই উম্মাহর ধারণা লালন করেন তা পাকিস্তানি শাসকরা বেমালুম ভুলে গেল। শত্র“র ছুরিতে মরা আর ভাইয়ের ছুরিতে মরা একই তাৎপর্য বহন করে না। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে ১২ শত মাইলের দূরত্বের দুটি দেশকে একসাথে রাখার যে গভীর ষড়যন্ত্রের বীজ ব্রিটিশরা বপন করে গিয়েছিল তার আপাত অবসান হয়েছিল ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু এবারও সেই ব্রিটিশের প্রেতাত্মা আমাদের রাজনীতির উপরে ভর করল, আমরা সেই প্রভুদের শেখানো রাষ্ট্রব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থাকে অন্ধের মতো অনুকরণ করতে লাগলাম যদিও তা বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেখাপ্পা, বেমানান। এদেশের মানুষকে সকল প্রকার গোঁড়ামি থেকে বের করার যে দায়িত্ব এদেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত আলেমদের উপর ছিল তারা সে দায়িত্বের প্রতি ন্যূন্যতম ভ্রুক্ষেপ না করে তাদের গোঁড়ামিকেই পুঁজি করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। ফলশ্র“তিতে পশ্চিমাদের কুটকৌশল এ দেশের মাটিতে আরও পাকাপোক্ত শেকড় গড়েছে।
গত চার দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক টানাপোড়েনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাব আদায় করা হয়েছে বিভিন্ন দরকষাকষিতে সুযোগ দেয়ার লোভ দেখিয়ে বা সরাসরি টাকা পয়সা দিয়ে। এ দেশে রাজনীতি হয়েছে কেবল ক্ষমতার জন্য। ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার গঠন হলেও আজ পর্যন্ত খুব কম নির্বাচনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে। ভোট নিয়ে চলেছে নানা দুষ্কর্ম। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। মুখে মুখে স্বাধীনতার বুলি আওড়ালেও এদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অনবরত ধর্ণা দিয়েছেন পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে, এর দ্বারা নিজেদের দেশের সার্বভৌমত্বকে কার্যত দুর্বল করে ফেলেছেন। এক দল ক্ষমতায় তো অন্য দল দেন-দরবার শুরু করেছেন বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে সরকারের টুঁটি চেপে ধরার জন্য। আর সুযোগ পেয়ে পশ্চিমারা এবং পার্শ¦বর্তী পরাশক্তিগুলো অনবরত ক্ষমতার ছুড়ি ঘুরিয়ে চলেছে আমাদের উপর। মুক্তবাজার ও উন্নয়নের ধুয়া তুলে কোটি কোটি ডলার ঋণ দিয়ে করেছে সর্বশান্ত। গোড়া থেকেই বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেট নিরুপণ হয় বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্যের পরিমাণ দেখে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ পেয়েছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশের উপর দেশী-বিদেশি পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ প্রায় চার লক্ষ কোটি টাকা এবং এ ঋণের মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় সোয়া দুই লক্ষ কোটি টাকা। এ হিসেবে আজ যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে, সে জন্ম নিচ্ছে প্রায় ২৮ হাজার টাকা ঋণ কাঁধে নিয়েই। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা যতজন ততো সংখ্যা দিয়ে ঋণের পরিমাণকে গুণ দিলে পাওয়া যাবে তাদের এই মুহূর্তে পারিবারিক ঋণের পরিমাণ কতো। ঋণের ব্যাপারে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তারা জানেন যে, ঋণ হচ্ছে একটা বিনিময় সংক্রান্ত বিল। এ বিলে অর্থের পরিমাণের উপর আনুপাতিক হারে অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা থাকে। যদি সুদের হার ৫% হয় তাহলে ঋণ গ্রহণকারী রাষ্ট্র ২০ বছর সময়ে আসল ঋণের সমান পরিমাণ টাকা সুদ হিসাবে দিতে বাধ্য হয়। ৪০ বছরে দ্বিগুণ এবং ৬০ বছরে তিনগুণ সুদ পরিশোধ করা হয় অথচ আসল ঋণের অংক তখনও বহাল থাকে। এভাবেই পশ্চিমাদের বিভিন্ন ব্যাংক, সংস্থা জোঁকের মত সুজলা-সুফলা সোনার বাংলার রক্ত শোষণ করে চলেছে। আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও সা¤্রাজ্যবাদীদের সাহায্য ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়াও সরকারের পক্ষে দুরুহ ব্যাপার।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক যুগ সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার উপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস আজ সুকৌশলে অনেক দূর এগিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে একে অপরের বিরুদ্ধে এমনভাবে উসকে দেয়া হয়েছে যাতে তাদের মধ্যে চার দশকের সহাবস্থান ও সহনশীলতা ছিল সেটিও বিদায় নিয়েছে। তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ, এক টেবিলে বসে কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজ যে পর্যায়ে এসে উন্নীত হয়েছে তা কোনভাবেই আর চলতে পারে না। ঘরে ঘরে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ হানাহানি চলতে থাকলে এ দেশের সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব বিকিয়ে দিয়ে এ দেশে পশ্চিমাদের প্রক্সি ধরনের শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখতে চান তারা তাদের হীন মতলব বাস্তবায়নের জন্য এখানে প্রতিহিংসা ও হানাহানি রাজনীতি সৃষ্টি এবং তা অব্যাহত রাখতে চাইছ্।ে স্বাধীনতা পরম ধন। এটা একবার হারালে ফেরত পেতে শত শত বছর চলে যায়, রক্তের সাগর প্রয়োজন হয়। তাই যারা দেশকে ভালোবাসে তাদের উচিত এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হওয়া যেখানে রাজনীতি করে কেউ স্বার্থ হাসিল করতে পারবে না। রাজনীতি হবে কেবলই মানুষের কল্যাণে। রাজনীতিকে বাণিজ্যকরণ, পেশাকরণ করাই দুর্নীতির প্রধান উৎস। যতদিন রাজনীতি করে মানুষ অর্থ কামাবে, টাকার জন্য মন্ত্রিত্ব করবে ততদিন দেশ থেকে শোষণ-বঞ্চনা দূর হবে না, আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার শুধু সংবিধানের পাতাতেই লেখা থাকবে।