নিম্নমানের প্লাস্টিকের গ্লাস-বাটি ব্যবহারে হতে পারে ডায়াবেটিস
উত্তরে হাতিবাগান, কিংবা দক্ষিণে গড়িয়াহাট। ফুটপাথের উপর লাল-নীল-হলুদ রঙের মতো নানা রঙের প্লাস্টিকের থালা-গ্লাস-বাটি সাজিয়ে বসেছেন দোকানদাররা। দাম অল্পই। ক্রেতাদের তাঁরা জানাচ্ছেন, শুধু সুন্দর দেখতেই নয়, মাইক্রোওয়েভেও বসাতে পারেন এসব পাত্র। আর তার ফলে দেদার বিক্রি হচ্ছে সস্তার বাসন। তাতেই চিন্তিত ডাক্তাররা। ডাক্তারদের হুঁশিয়ার, নিম্নমানের প্লাস্টিকের বাসন মাইক্রোওয়েভে ব্যবহার করলে, তা থেকে বাসা বাঁধতে পারে ইনসুলিন প্রতিরোধী ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক রোগ।
কেবল এই রোগটিই নয়। চিকিৎসকদের মতে, পুরনো, রং চটে যাওয়া প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার নিয়ে নিয়মিত মাইক্রোওয়েভে যাঁরা গরম করে খান, তাঁদের বিভিন্ন ধরনের রোগের আশঙ্কা অনেক বেশি। বন্ধ্যত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। ধাক্কা খেতে পারে শিশুদের বাড়বৃদ্ধি। আর এর কারণ হচ্ছে, প্লাস্টিক থেকে নির্গত হয় ‘বিসফেনল এ’ (বিপিএ) নামের এক ধরনের রাসায়নিক, যা শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। দেহের বিভিন্ন ধরনের হরমোনের কাজকর্ম পুরোপুরি গুলিয়ে দেয় রাসায়নিকটি।
এদিকে সম্প্রতি একাধিক গবেষণায় ডায়াবেটিসের বিষয়টি সামনে আসায় নড়ে বসেছেন এন্ডোক্রিনোলজিস্টরা। এন্ডোক্রিন সোসাইটির আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছে এই গবেষণার ফলাফল।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্লাস্টিক নরম জিনিস। সেটি শক্ত করতে বিপিএ নামের রাসায়নিকটির প্রয়োজন। প্লাস্টিকের বাসনে তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিপিএ’র ব্যবহার বেশি। এছাড়া ওই রাসায়নিক প্লাস্টিকের পাইপ, সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিপিএ’র ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বহু দিন ধরেই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, এই ধরনের রাসায়নিককে বলা হয় ‘এন্ডোক্রাইন ডিসরাপটর’। দেহে যত হরমোন আছে, তার প্রত্যেকটিরই নির্দিষ্ট কাজ-কর্ম গুলিয়ে যেতে পারে এর কারণে। ইনসুলিন প্রতিরোধী ডায়াবেটিস তারই এক চরম নমুনা।
শুধু মাইক্রোওয়েভে প্লাস্টিকের বাসন ব্যবহার নয়। হু বহু দিন ধরেই প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়ারও বিরোধিতা করেছে। হু এর বক্তব্য, বোতলের গা থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক জলে মিশে রোগ ছড়াতে পারে। প্লাস্টিকের জলের বোতল ফ্রিজে রাখাটাও ক্ষতিকর। কারণ অতিরিক্ত ঠান্ডাতেও রাসায়নিকটি নির্গত হয়। বাজারে বোতলবন্দি যে পানি কিনতে পাওয়া যায়, অনেকেই সেই বোতল পরবর্তী সময়েও ব্যবহার করেন। সেটাও খুবই ক্ষতিকর।
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট তীর্থঙ্কর চৌধুরী মনে করেন, প্লাস্টিকের মান যদি ভাল হয়, তা হলে শারীরিক ক্ষতির ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে কম থাকে। তিনি বলেন, আর একটা বিষয়ে সতর্ক করতে চাই সকলকে। বাসনে মাইক্রোওয়েভেবল ছাপ মারা না থাকলে কোনও ভাবেই তা মাইক্রোওয়েভে ব্যবহার করবেন না। তবে এও সত্যি বাজারে ‘মাইক্রোওয়েভেবল’ ছাপ মারা সস্তার নিম্নমানের বাসনও রয়েছে।
এ ছাড়াও রেস্তোরাঁয় যে ধরনের প্লাস্টিকের কৌটোতে ভরে খাবার দেওয়া হয়, অনেকেই বাড়িতে আনার পরে সেই কৌটোগুলি একাধিক বার ব্যবহার করেন। ওই পাত্রে মাইক্রোওয়েভে খাবার গরমও করেন। এক চিকিৎসকের কথায়, রেস্তোরাঁয় ওই পাত্রের জন্য অতিরিক্ত পাঁচ-ছয় টাকা নেওয়া হয়। ওই দামে যে বাসন পাওয়া যাচ্ছে, সেটা তো এক বার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়ার কথা!
এদিকে রাজ্য প্লাস্টিক ফেডারেশনের প্রদীপ নায়ার অবশ্য নতুন এই সমস্যার কথা পুরোপুরি মানতে রাজী নয়। তাঁর বক্তব্য, ‘কিছু দিন আগে বিষয়টা কানে এসেছে। কিন্তু প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে কোনও রাসায়নিক বেরোবে, আর তা থেকে রোগ বাড়বে, এখনই এতটা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এ নিয়ে আরও চর্চা দরকার। তবে খুব সস্তার জিনিস না কেনাই ভাল। প্লাস্টিকের পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করার উপরেও জোর দিয়েছেন তিনি।
তাঁর মতে, অপরিস্কার পাত্র থেকে নানা ধরনের সংক্রমণ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্নতাই রোগ ছড়ানোর মূল উৎস হয়ে ওঠে বলে তাঁর অভিমত।
এডিপি/আমিরুল্ ইসলাম