খ্রিস্টিয় বর্ষের ইতিকথা
অনলাইন ডেস্ক: গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী, গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জী, পাশ্চাত্য বর্ষপঞ্জী, ইংরেজি বর্ষপঞ্জি বা খ্রিস্টাব্দ হল আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় সর্বত্র স্বীকৃত বর্ষপঞ্জী ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রোগোরির এক আদেশানুসারে এই বর্ষপঞ্জীর প্রচলন ঘটে। সেই বছর কিছু মুষ্টিমেয় রোমান ক্যাথলিক দেশ গ্রেগোরিয় বর্ষপঞ্জী গ্রহণ করে এবং পরবর্তীকালে ক্রমশ অন্যান্য দেশসমূহেও এটি গৃহীত হয়।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অব্দ হিসাবে খ্রিস্টাব্দ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। এই অব্দের সাথে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছেন খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক ঈসা মসীহ আ. । উল্লেখ্য, মুসলমানদের কাছে ইনি ঈসা নবি নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। ইংরেজিতে বলা হয় Jesus Christ। বাংলা খ্রিস্ট শব্দটি গৃহীত হয়েছে ইংরেজি Christ থেকে। এর সাথে সংস্কৃত থেকে গৃহীত অব্দ শব্দের স্বরসন্ধিতে তৈরি হয়েছে খ্রিস্টাব্দ (খ্রিস্ট +অব্দ)। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই অব্দের শুরু থেকে পরবর্তী অব্দগুলোকে বলা হয় Anno Domini (সংক্ষেপে AD বা A.D.)। বাংলাতে একে বলা হয় খ্রিস্টাব্দ। পক্ষান্তরে এই অব্দের পূর্ববর্তী অব্দগুলোকে বলা হয় Before Christ (সংক্ষেপে BC বা B.C.)। বাংলাতে একে বলা হয় খ্রিস্টপূর্ব অব্দ।
সাধারণভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে যে, খ্রিষ্টের জন্মগ্রহণের বছর থেকে এই অব্দের গণনা শুরু হয়েছে। যদিও ১লা জানুয়ারি তারিখে যিশুর জন্ম হয়েছিল, এ কথা যেমন ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়, তেমনি ১ খ্রিস্টাব্দেই যিশু জন্মেছিলেন এ কথাও সত্য নয়। মূলত বর্তমানে- খ্রিস্টাব্দ হলো যিশু খ্রিষ্টের স্মরণে প্রবর্তিত একটি প্রতীকী অব্দ। তারপরেও অনেকই মনে করেন- আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই অব্দটিকে বলা উচিৎ CE (Common Era) ।
এই অব্দের সূচনা হয়েছিল প্রাচীন মিশরে। মিশরীয় পঞ্জিকা’-কে বলা যেতে মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপীয় অঞ্চলের মাতৃ-পঞ্জিকা বা অন্যান্য পঞ্জিকার আদি উৎস। গোড়ার দিকে প্রাচীন রোমান পঞ্জিকা ছিল গ্রিক ভাবনা-প্রসূত মিশরীয় পঞ্জিকার একটি সংস্করণ মাত্র। রোমানদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ অব্দের দিকে রোমের স্থপতি রোমুলাস সৌরবৎসরের হিসাবে রোমান পঞ্জিকা প্রবর্তন করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ অব্দ পর্যন্ত এই পঞ্জিকাই নানাবিধ পরিবর্তন করে নতুন একটি পঞ্জিকা প্রবর্তন করলেন রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার (Julius Caesar)। এই পঞ্জিকাটি ‘জুলিয়ান পঞ্জিকা’ নামে খ্যাত।
এর পাশাপাশি বাইবেলের সূত্রে ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্ম সম্প্রদায়ের ভিতরে পৃথিবী সৃষ্টির বিতর্কের সূত্রে গড়ে উঠেছিল Anno Mundi অব্দ গণন পদ্ধতি। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল ধর্মভিত্তিক ইহুদী পঞ্জিকা ও খ্রিষ্টান পঞ্জিকা। এরই সূত্রে ধরে জুলিয়ান পঞ্জিকার সাথে খ্রিষ্টানদের ভাবনার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল বাইজেন্টেনিয়ান পঞ্জিকা।
Anno Mundi :
খ্রিস্টাব্দের সূচনা হয়েছিল বিশ্ববর্ষ (Anno Mundi সংক্ষেপে AM বা A.M.) অনুসারে। এই পঞ্জিকার ভিত্তি ছিল বাইবেলের আদিপুস্তকে বর্ণিত পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব। অনেক যত্ন করে পুরোহিতরা এই পঞ্জিকা তৈরি করলেও সৃষ্টিকাল নিয়ে ব্যাপক মতভেদের সৃষ্টি হয়েছিল। বাইবেলের দুটি সংস্করণ অনুসারে ইহুদি ও খ্রিষ্টান মতবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল ইহুদী ও খ্রিষ্টান পঞ্জিকা।
ইহুদি পঞ্জিকা : হিব্রু বাইবেলের হিব্রু Masoretic text অনুসারে ইহুদি রাব্বি Jose ben Halafta সদাপ্রভু আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৬০ অব্দে। শেষ পর্যন্ত এই গণনা সকল ইহুদি পণ্ডিতের কাছে গৃহীত হয় নি। ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে হিব্রু পঞ্জিকা সংশোধন করেছিলেন মেইমোনিদেস (Maimonides)। তাঁর মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৯২৫ অব্দে। বর্তমানে এই সংশোধিত পঞ্জিকা ইহুদিরা মান্য করে থাকেন।
খ্রিস্টান পঞ্জিকা : বাইবেলের পুরাতন নিয়মের গ্রিক সংস্করণের Septuagint অধ্যায় অনুসারে, খ্রিষ্টান পাদরিরা সৃষ্টিকালকে নির্ধারণ করা চেষ্টা করেছিলেন। এর সূত্রপাত ঘটেছিল জুলিয়াস আফ্রকানাস (Julius Africanus ২০০-২৪৫ খ্রিস্টাব্দ) -এর হাতে। তাঁর মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৩৭ অব্দে। আর অন্টিওকের ষষ্ঠ বিশপ থিওফিলাস (Theophilus ১১৫-১৮১ খ্রিস্টাব্দ) -এর মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৫২৯ অব্দে। সেরাফিম রোজ (Seraphim Rose) একে সংশোধন করে উল্লেখ করেছেন খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৩০ অব্দ। ইউসেবাসের ক্রোনিকন (Chronicon of Eusebius) এবং জেরোম (Jerome) একে পুনরায় সংশোধন করে নির্ধারণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ৫১৯৯ অব্দ। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা গোড়ার দিকে বহুদিন এই মতে বড়দিন পালন করতেন।
বাইজেন্টেনিয়ান পঞ্জিকা : এই পঞ্জিকা তৈরি হয়েছিল জুলিয়ান পঞ্জিকা’কে ভিত্তি করে। তবে এই পঞ্জিকা সাথে পার্থক্য ছিল বৎসরে শুরুর সময় নিয়ে। জুলিয়ান পঞ্জিকা- বৎসরের শুরু দিন ছিল ১ জানুয়ারি, পক্ষান্তরে বাইজেন্টেনিয়ান পঞ্জিকার মাস গণনা হতো ১ সেপ্টেম্বর থেকে। আর বৎসর গণনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো Anno Mundi পঞ্জিকার খ্রিষ্টান রীতি। সব মিলিয়ে এই পঞ্জিকা মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০৯ অব্দের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০৮ অব্দের ৩১শে আগষ্টের মধ্যে।
বাইজেন্টাইন Anno Mundi পদ্ধতির বর্ষ গণন পদ্ধতিকে পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স চার্চ ৬৯১ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছিল। এবং ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এরা এই পঞ্জিকা অনুসরণ করতো। দশম শতাব্দীর শেষের দিকে এই পঞ্জিকাতে সৃষ্টিকাল গ্রহণ করা হয়েছিল ১লা সেপ্টেম্বর খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০৯ অব্দ। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে। রাশিয়াতে এই পঞ্জিকা ১৭০০ অব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
আলেক্সান্দ্রিয়ান পঞ্জিকা : বাইজেন্টেনিয়ান পঞ্জিকাকে ভিত্তি করে ৪১২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ান পঞ্জিকা। আলেক্সান্দ্রিয়ার পুরোহিত প্যান্ডোরো (Panodoros) আদমের জন্মকাল ধরেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৫৯০৪ অব্দ। তাঁর হিসাব মতে বর্ষ শুরু হতো ২৯ আগষ্ট থেকে। তিনি এই গণনাকে ৪১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রলম্বিত করেছিলেন। এই মতবাদকে তীব্র সমালোচনা করেন প্যান্ডোরোর সমসাময়িক অপর একজন পুরোহিত। ইতিহাসে তিনি এ্যানিয়ানোস (Annianus of Alexandria) নামে খ্যাত। তিনি ঘোষণা করেন সৃষ্টি কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৯৩ অব্দ। আর বর্ষ গণনা নির্ধারণ করেছিলেন ২৫ মার্চ থেকে।
৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কতিপয় খ্রিষ্টান পুরোহিত এই পঞ্জিকার ব্যাপক সংস্কার করলেন। এই সংস্কারটি ক্রোনিকন প্যাসকেল (Chronicon Paschale) নামে খ্যাত। এই সংস্কারে আদমের সৃষ্টিকাল হিসাবে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০৭ অব্দের ২১শে মার্চ উল্লেখ করা হয়েছিল। ফলে আগের বর্ষগণনায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল।
উল্লেখ্য, পশ্চিমা খ্রিষ্টানজগত Anno Domini -এর স্থলে Anno Mundi পঞ্জিকাকে কখনই গ্রহণ করেন নি। বর্তমানে যা গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা বা গ্রেগোরিয়ান সংস্করণ নামে খ্যাত। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।