অনলাইন ডেস্ক: ‘আমরা বেহেস্তে যাচ্ছি তোমরা পালাও। আমরা সবাই জান্নাতে যাব।’ হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের যেসব স্টাফদের দিয়ে খাবার তৈরি করে জঙ্গিরা খেয়েছিল রবিবার সকালে সেনাবাহিনীর অভিযানের আগে তাদের উদ্দেশে জঙ্গিরা এসব কথা বলে। অভিযানের পর বের হয়ে আসা হলি আর্টিজানের শেফ সহকারী শাহরিয়ার আহমেদ সেরুর (২৪) বরাত দিয়ে তার চাচা ইব্রাহীম আহমেদ এসব কথা বলেন।
গুলশানে হামলাসেরুর চাচা বলেন, জঙ্গি হামলার পর সেরুসহ নয়জন রেস্টুরেন্টের একটি টয়লেটের ভেতরে আশ্রয় নেয়। রাতে টয়লেট থেকে তাদের বের করে আনে জঙ্গিরা। তাদেরকে চা-কফি তৈরি করে দিতে বলে। চা-কফি তৈরির পর রাতের সেহেরির খাবারও তৈরি করিয়ে নেয় তারা। তখন স্টাফদেরও সেহেরি খাওয়ার প্রস্তাব দেয় জঙ্গিরা। এসময় সেরু সেহেরির পরিবর্তে এক গ্লাস পানি খেয়ে রোজা থাকার প্রস্তাব দিলে জঙ্গিরা তাকে পানি দেয়। পানি খাওয়ার পর রোজার নিয়ত করে সেরু। তা শুনে জঙ্গিরা খুশি হয়।
তিনি আরও জানান, জঙ্গিরা সেরু বা অন্য কোনও স্টাফদের সঙ্গে বেশি কথা বলেনি। যখন সকাল হয়, তখন তারা পায়চারি করছিল। সেনাবাহিনী যখন অভিযান চালায়, তখন জঙ্গিরা স্টাফদের সবাইকে পালাতে বলে। তারা স্টাফদের বলেছিল, তোমরা পালাও আমরা বেহেস্তে যাচ্ছি। তখন সব স্টাফরা আবার টয়লেটে গিয়ে পালায়।
সেরুর চাচা আরও বলেন, সেনাবাহিনী অভিযান করে ১৩ জনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এর মধ্যে সেরু ছিল। প্রথমে তাদের কাউকে ছাড়েনি। মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে ডিবি অফিস থেকে আমাকে ম্যাসেজ দেওয়া হয়। এরপর শনিবার রাতে গিয়ে আমরা সেরুকে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে আসি।
ঘটনার পর থেকে সেরু ভয়ে কাঁপছে। আমরা তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়াচ্ছি। সে এখন ঘুমাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, শাহরিয়ার আহমেদ সেরু পৌনে ২ বছর ধরে ওই রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। তার বাবার নাম মো. ওসমান। তিনি পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর ভাটারা থানার শাহজাদপুর এলাকার খিলবাড়িতে থাকেন।
অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী হামলার বর্ণনা দিয়ে বাবুর্চি শিশির বৈরাগী বলেন, রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকেই এলোপাতাড়ি গুলি করছিল জঙ্গিরা। এসময় সবাই টেবিলের নিচে মাথা লুকিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেছিল। আমরা নয়জন একসঙ্গে টয়লেটে ঢুকে পড়ি। সারারাত সেখানেই ছিলাম। রাত ৩ টার দিকে হামলাকারীরা আমাদের টয়লেট খুলে বের করে। জঙ্গিরা আমাদের কাছে জানতে চায়, আমাদের ভেতরে কেউ বিদেশি আছে কিনা। কোনও বিদেশি না থাকায় তারা আবার আবার টয়লেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়।
রবিবার বিকালে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, বরিশালের আগৈলঝড়া উপজেলায় তার গ্রামের বাড়ি। শিশির জানান, দেড় বছর ধরে তিনি ওই রেস্টুরেন্টে বাবুর্চির কাজ করত। শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি রান্নাঘরে প্রতিদিনের মত ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ রাত সাড়ে ৮ টার দিকে প্রধান বাবুর্চি দৌড়ে রান্না ঘরে যায়। এসময় শিশির মনে করেন খাবার তৈরিতে কোনও সমস্যা হয়েছে। এরপরই গুলির শব্দ পান তারা। সঙ্গে সকল বাবুর্চি ও বাবুর্চির সহকারীরা দৌড়ে টয়লেটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারা এক সঙ্গে ওই টয়লেটে ৯ জন ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, জঙ্গিরা ঢুকেই হামলা চালায়। আমরা টয়লেটে বসে শুধু গুলির শব্দ পেয়েছি। আর কি হয়েছে তা আমরা বলতে পারব না। আমাদেরকে শুধু তারা জিজ্ঞাসা করছিল বিদেশি আছে কি না? এছাড়া আর কোনও কিছু করেনি।
কীভাবে বের হলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শিশির বলেন, সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে টয়লেটের ভেতরে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এসময় টয়লেটের শাওয়ারের ইস্পাতের পাইপ ভেঙ্গে আমরা দরজা ভেঙ্গে ফেলি। চিৎকার করি, আমরা গরীব পেটের দায়ে এখানে এসেছি, আমাদের ছেড়ে দাও। তখন জঙ্গিরা রেস্টুরেন্টের এক স্টাফকে আমাদের কাছে পাঠায়। সে গিয়ে আমাদের বলে, তোমাদের সবাইকে যেতে বলছে। তখন চারজন ওর সঙ্গে সামনে যায়। আমরা পাঁচজন দৌড়ে বাউন্ডারি ওয়াল ডিঙিয়ে বের হয়ে আসি। আমরা সেনাবাহিনীর অভিযানের আগেই বের হই। এরপর পুলিশ আমাদের নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (১ জুলাই) রাত সাড়ে ৯টার দিকে গুলশান-২ এ ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িতে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা। তারা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনসহ ২০ জিম্মিকে হত্যা করে বলে জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)। তাদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি ও তিনজন বাংলাদেশি। অভিযানে নিহত হয় ছয় হামলাকারীও।
বিদেশিদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি ও একজন ভারতীয়। বাংলাদেশিদের মধ্যে একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছিলেন। শুক্রবার দুপুরে নিহতদের লাশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়।
নিহত তিন বাংলাদেশির মধ্যে রয়েছেন ফারাজ আইয়াজ হোসেন, তিনি এসকায়েফ-এর সিইও সিমিন হোসেনের ছেলে এবং ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি। পরিবারের পক্ষ থেকে তার পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহত অন্য বাংলাদেশি হচ্ছেন ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান ক্রিয়েটিভস (আইএসি)-এর শিক্ষার্থী ইশরাত আকন্দ। সহপাঠীরা তার পরিচয় নিশ্চিত করেছেন।
নিহত অপর আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী অবিন্তা কবীর। তিনি এলিগ্যান্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান রুবা আহমেদের কন্যা। পরিবারের পক্ষ থেকে তার পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। অবিন্তা যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে থাকতেন। তিনি ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।
যৌথ বাহিনীর কমান্ডো অভিযানে ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। একজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়।