স্টাফ রিপোর্টার:
“আমার শাশুড়ি তার ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন মৃত্যুশয্যায়। তিনি সব সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন মরার আগে যেন ছেলের মুখ দেখে যেতে পারেন। আমার ছোট্ট মেয়ে প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকে তার বাবা ফিরে আসবে। আর আমার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ, তা তো কাউকে দেখানো যায় না।”, কথাগুলো সিলেট জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনা।
গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে হৃদয় বিদারক বক্তব্য দেন তিনি। ‘আন্তর্জাতিক গুম দিবস’ উপলক্ষে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন সময় গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের স্বজনরা।
লুনা বলেন, ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে ইলিয়াসের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং বিয়ে। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। সব বিষয় আমার সঙ্গে শেয়ার করত ও। গুম হওয়ার কিছুদিন আগেও ইলিয়াস আমাকে বলেছিল, নানা রকম লিস্ট করা হচ্ছে। জানি না ভাগ্যে কি আছে। আমি ওকে সাবধান হতে বলেছিলাম। কিন্তু ও বলতো, ভয়ে ঘরে বসে থাকলে অধিকার আদায় হবে না। তিনি বলেন, ইলিয়াস সমূহ বিপদের কথা আঁচ করতে পেরেও টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চ এবং টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আর সেটিই তার জন্য কাল হয়েছে। লুনা বলেন, ইলিয়াস গুমের সঙ্গে সরকার বা সরকারি সংস্থা জড়িত না-এ প্রমাণের দায়িত্ব সরকারের। কারণ, রাত ১২ টায় ইলিয়াসের পরিত্যক্ত গাড়ি উদ্ধারের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি থানায় গিয়েছি। প্রশাসনকে জানিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়েছি। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটা মানুষ হাওয়া হয়ে যাওয়ার কথা না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলে ইলিয়াসকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো। তিনি বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এই ফল ভোগ করব তা কখনো ভাবিনি। এক দশক আগেও গুম শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিতি ছিলাম না। এখন শুধু একটাই চাওয়া, আর কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। আর কোনো সন্তানকে যেন তারা বাবার জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। আর কোনো স্ত্রীকে যেন দিনে পর দিন, রাতের পর রাত তার স্বামীর পথ চেয়ে বসে থাকতে না হয়। এর আগে বক্তৃতা দিতে গিয়ে নিখোঁজ হাবিবুল বাশারের মা হোসনে আরা বেগম শুধু অঝোর ধারায় কাঁদলেন। কিছুই বলতে পারলেন না তিনি। তার কান্নায় মিলনায়তনের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। উপস্থিত অনেকের চোখ দিয়ে ঝরতে থাকে অশ্র“। নিখোঁজ সুত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর স্ত্রী তারান্নুম বেগম নুহাস কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তার একটিই দাবি যে কোনো মূল্যেই হোক সরকার যেন তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়। নিখোঁজ খালেদ হাসান সোহেলের স্ত্রী শাম্মী সুলতানার বক্তৃতায় কান্নার রোল ওঠে মিলনায়তনে। পাশে শিশু সন্তানকে বসিয়ে শাম্মী সুলতানা বলেন, প্রতি রাতেই আমরা ছেলে আমার কাছে জানতে চায় তার বাবা কোথায়। কখন ফিরবে সে। তিনি বলেন, সংসারের বড় ছেলে হিসেবে আমার শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল আমার স্বামীর। আর আজ সন্তানসহ আমার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে বৃদ্ধ শ্বশুরের। এ যে কি কষ্ট সেটা বলে বোঝানো যাবে না। নিখোঁজ চঞ্চলের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার ভাইকে যদি মেরে ফেলা হয় সেটা জানানো হোক। প্রতিদিন কান্নার চেয়ে আমরা একদিন কাঁদতে চাই। তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক নিখোঁজ তারেকুল ইসলামের ঝন্টুর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মিথুনের আহাজারিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যান মিলনায়তনের অনেকেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাইফুল ইসলাম বলেন, বড় সন্তানকে হারিয়ে আমার মা এখন শয্যাশায়ী। মায়ের অসুস্থতার কারণে অচল হয়ে পড়েছে আমাদের সংসার। নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমনের ছোট বোন ফেরদৌসী আরা বলেন, বড় ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর আমাকেই সব জায়গায় দৌড়াতে হয়েছে। কিন্তু কোনো জায়গা থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা পাইনি। ভাইয়ের রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় জিডি করতে গেলেও তা নেয়নি পুলিশ।