মঙ্গলবার বিকেলে বই মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে বীরঙ্গনা টেপরী রাণীর হাতে বাড়ির চাবি ও উপহার সামগ্রী তুলে দেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড.গওহর রিজভী।
ঠাকুরগাঁওয়ে সদ্য পদোন্নতি পাওয়া সুপার দেওয়ান লালন আহমেদ বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গান মিউজিক ভিডিওসহ রচনা করেছেন। “আমার মা জননী বীরাঙ্গনা” নামে একটি ইতোমধ্যে দেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল গানের ভিডিওতে রাণীংশকৈল উপজেলা বীরঙ্গনা টেপরী রাণীর জীবন যাপনের করুন দশা দেখে ৩ দিনের মধ্যে একটি থাকার ঘর তৈরি করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড.গওহর রিজভী এ সময় বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীরাঙ্গনাদের নিজের কন্যার মর্যাদা দিয়েছিলেন। সরকারি উদ্যোগে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। তাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রও স্থাপিত হয়। তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা হয়। বর্তমান সরকার পরবর্তীতে তাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিতে ভূষিত করেন।
গীতিকার দেওয়ান লালন বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করি, ধারণ করি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এই বিষয়গুলোকে যাতে মনে, মননে ও মগজে ধারণ করে সেটি মাথায় রেখে লিখেছি ‘কাঁদো বাঙালি আজ কাঁদো সবাই’, ‘পঁচিশে মার্চ’ ও ১৯৭১ সালের বীরাঙ্গনা মায়েদের সম্মানে ‘বীরাঙ্গনা’।”
বীরাঙ্গনা গানের শুরুটা এমন ‘যুদ্ধ এখনও বইছে, যেন যুদ্ধে রচিত জীবনধারা, বিজয়ে সবাই হাসে। উঠে না তাদের শুকতারা।’
গীতিকার জানালেন, এ গানের পেছনে ইতিহাস আছে। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বলিদ্বারা গ্রামের টেপরি রানী একজন বীরাঙ্গনা। ১৯৭১ সালে পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তাকে ইচ্ছামতো নির্যাতন করত। সবার কথা চিন্তা করে সব মুখ বুজে সকল নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি। তাকে মেরে ফেলার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের বারবার আকুতি করেছিল কিন্তু তারা তা করেনি। সেই টেপরি রানীর কথা উঠে এসেছে এ গানে।
দেওয়ান লালন আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম এক্সপার্ট, তিনি মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক অপরাধ নির্ণয়ে বিশেষ পারদর্শী। পাশাপশি লেখালেখি ও শিল্পচর্চা করেন।
তার লেখা গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ হয়। দেওয়ান লালন বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র ‘ডিটেক্টিভ’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। ব্লগার স্বীকৃতি হিসেবে প্রথম আলো ব্লগ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। তার গ্রন্থ ‘বাবার চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ ২০১৬ সালের বইমেলায় প্রশংসা কুড়িয়েছে। জাতীয় ও ঠাকুরগাঁওয়ে বই মেলায় আসে দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘পুলিশের খেরোখাতা’ ও ‘বাবার চোখে মুক্তিযুদ্ধ নামে দুটি বই।
বীরঙ্গনা টেপরি রানী বলেন, পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ইচ্ছামতো নির্যাতন করত। সবার কথা চিন্তা করে সব মুখ বুজে সহ্য করেছি। আমি পাকিস্তানি সেনাদের বারবার আমাকে মেরে ফেলার জন্য আকুতি করলেও তারা তা করেনি। আত্মহত্যা করে জীবন বিপন্ন করতে চাইনি। সংগ্রাম করেই বাঁচতে চেয়েছিলাম। নির্যাতনের কথা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বলিদ্বারা গ্রামে আবার বসবাস শুরু করি। কিন্তু নির্যাতিত হওয়ায় আমাদের পরিবারকে প্রায় দুই বছর একঘরে করে রাখে স্থানীয় লোকজন। আমাদের সঙ্গে কেউ লেনদেন করত না, কথা পর্যন্ত বলত না। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে আমার স্বামী মাটাং রায় অসুখে মারা যান। তারপর থেকে আমার দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অতিকষ্টে দিন কাটাচ্ছি। ছেলে সুধীর একজন যুদ্ধশিশু যিনি এখন ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন ।
এর আগে বই মেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়ালের সভাপতিত্ব আরো বক্তব্য রাখেন, আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১ আসনের এমপি রমেশ চন্দ্র সেন, ৩ আসনের এমপি ইয়াসিন আলী, সংরক্ষিত আসনের এমপি সেলিনা জাহান লিটা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মু. সাদেক কুরাইশী, পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ প্রমূখ।