এতদিন শুনে এসেছি মাদ্রাসায় জঙ্গিবাদ শেখানো হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোর পর এখন আর সে কথা কেউ বলছেন না। এখন আবার সন্দেহ করা হচ্ছে কিছু পাবলিক ভার্সিটিকে, কারণ সেখানকার বেশ ক’জন ছাত্রের বিরুদ্ধে জঙ্গি কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে যে অর্থে এক সময় মাদ্রাসাকে দায়ী করা হতো সঙ্গত কারণেই সেই অর্থে পাবলিক ভার্সিটিকে দায়ী করা যাচ্ছে না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্মীয় কোনো আদর্শ শিক্ষা দিয়ে ছাত্রদেরকে জঙ্গি বানিয়ে ফেলা তাই পুরোপুরি অসম্ভব। তাহলে তারা জঙ্গি হচ্ছে কীভাবে?
সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপ বিবেচনা করলে বোঝা যায় সরকারও সম্ভবত এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পায় নি। টিভি চ্যানেল বন্ধ করা, জুমার খুৎবা মনিটরিং করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নজরদারি বাড়ানো ইত্যাদি করে জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে এমনটা হয়ত সরকারও বিশ্বাস করে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা যদি ধরি, তাহলে মাদ্রাসার ব্যাপারে বলতে হবে- মাদ্রাসার সিলেবাসে যা শেখানো হয় তা দিয়ে হুজুগ সৃষ্টি করানো সম্ভব, ‘এটা চাই ওটা চাই – মানি না মানব না’ টাইপের আন্দোলনেরও জন্ম দেওয়া সম্ভব, দাঙ্গা বাঁধানো সম্ভব, কিন্তু আত্মঘাতী আইএস বাহিনী তৈরি করার জন্য ওটা যথেষ্ট নয়। আর সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মকে রাখা হয়েছে অপাংক্তেয় করে। সেখান থেকে মানুষ ভোগবাদী আত্মকেন্দ্রিক চেতনা নিয়ে বেরিয়ে আসে, কোনো নীতি বা আদর্শ নিয়ে নয়, ধর্মীয় আদর্শ তো আরও নয়। সুতরাং জঙ্গি তৈরিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যক্ষ দায় খুব কম। আসলে আইএস তৈরিতে যে মাল-মশলা ব্যবহৃত হয় তা স¤পূর্ণ ভিন্ন ফ্যাক্টরির প্রোডাক্ট। ওটা মাদ্রাসাতেও নাই, স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতেও নাই। ওই লাইনটাই আলাদা। ওই লাইনটা ধরতে না পারলে হাজারো ফতোয়া দিয়ে, মানববন্ধন করে, রোড শো করে, কমিটি করে এবং আহাজারি করে লাভ হবে না।
একজন মানুষ জঙ্গিবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয় তার জাতীয় জীবনে ঈমানী দায়িত্ব পালনের চেতনা থেকে। খেয়াল করলে দেখা যাবে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয় প্রত্যেক ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিম-লে ধর্মকর্ম বা ঈমানী দায়িত্ব পালনের যথেষ্ট সুযোগ পেলেও তার জাতীয় জীবনে ঈমানী দায়িত্ব পালনের কোনো সুযোগ সে পায় না। আপনি বলতে পারেন- এই সুযোগ তো অন্য ধর্মের লোকেরাও পায় না। হ্যাঁ, তা ঠিক, তবে এতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কোনো অসুবিধা না হলেও ইসলামের বেলায় কিছু বুনিয়াদী সমস্যা দেখা দেয়। কেননা ইসলামের পরিম-ল কেবল ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। ইসলামের জাতীয় চেতনা অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রকৃত ইসলামের যুগে ব্যক্তি ছিল গৌণ, জাতিই ছিল মুখ্য বিষয়। সেই জাতীয় জীবনে ভয়াবহ অন্যায়-অশান্তি চলতে দেখলে স্বভাবতই একজন তরুণের মনে ক্ষোভ জাগে। সে তার ঈমানী চেতনা থেকে জাতির জন্য কিছু করতে চায়। সে চায় জাতীয় জীবনে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। সে সুযোগ যখন তাকে দেওয়া হয় না, শান্তিপূর্ণভাবে তার ঈমানী দায়িত্ব পালনের কার্যকরী কোনো উপায় যখন সে খুঁজে পায় না, তখন স্বভাবতই সে একটি শূন্যতা অনুভব করে। সুযোগ বুঝে ওই শূন্যতাকেই কাজে লাগানো হয় জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে।
ঈমানদার ব্যক্তিকে বোঝানো হয়- তুমি মসজিদে বসে আছো, নামাজ পড়েই জান্নাতে যেতে চাইছো, অথচ তোমার জাতির আজ কী বেহাল দশা! তোমার কি কোনোই দায়িত্ববোধ নাই? আসো আমাদের সাথে। তোমার ঈমানী দায়িত্ব পালন কর। সে ভাবে- আসলেই তো, আমার জাতি আজ ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে, উদ্বাস্তু হচ্ছে, শোষিত হচ্ছে, দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে, আকাশ থেকে বৃষ্টির মত বোমা ফেলা হচ্ছে আমার মুসলিম ভাই-বোনদেরকে লক্ষ্য করে, আমার মুসলিম ঘরের বোনকে বিধর্মী সৈন্যরা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করছে, আমার জাতির ছোট ছোট বাচ্চার বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে বুলেটের আঘাতে, অথচ আমি কিছুই করছি না? এবার তার সামনে মেলে ধরা হয় অসংখ্য জিহাদের আয়াত, জিহাদের হাদীস, যুদ্ধের ইতিহাস ও রক্ত গরম করা জিহাদী বয়ান। তরুণ প্রাণে আশার ঝলক খেলে যায়।
এই যে ঈমানী দায়িত্বের কথা বলে একটি তরতাজা প্রাণকে ধ্বংসের পথে চালিত করা হলো, ওই তরুণের উদ্দেশ্য কিন্তু সৎ, সে জাতির পক্ষে কিছু একটা করার দায়িত্ববোধ থেকে ওই পথে পা বাড়িয়েছে। কিন্তু পথ ভুল। সে বুঝল না তার দ্বারা জাতির কোনো উপকার হচ্ছে না বরং ক্ষতি হচ্ছে, সে বিপদে ফেলছে নিজেকে এবং তার জাতিকে।
আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার ভুলটা হচ্ছে- ওই ঈমানী চেতনাধারী তরুণটিকে গৃহের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে বন্দী করে রেখে চিন্তামুক্ত থাকা, তাকে জাতীয় কল্যাণকর কাজে স¤পৃক্ত হবার সুযোগ না দেওয়া বা অনুপ্রাণিত না করা। তাকে যদি বৈধ পথে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ঈমানী চেতনা দ্বারা উদ্বুব্ধ করে জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হত, তাকে যদি পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্ম-অধর্ম, ন্যায়-অন্যায়ের সঠিক শিক্ষা দেওয়া হত, যদি তাকে বোঝানো হত যে, যা দ্বারা সমাজের কল্যাণ হবে সেটাই ধর্ম, আর যা দ্বারা অকল্যাণ হবে সেটা অধর্ম, মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করাই তোমার জীবনের সার্থকতা, জিহাদ হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং এই সংগ্রাম করতে হবে সেই নীতি মেনে যেটা আল্লাহর রসুল করেছেন, তাহলে যে তরুণ আজ জাতির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে সে-ই জাতির সম্পদে পরিণত হত। যে কিনা মানুষ মারতে গিয়ে শহীদ (!) হচ্ছে সে মানুষ বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হত। ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিরোধ দূর হয়ে উভয়েই হাতে হাত মিলিয়ে চলতে পারত।
রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ, ধর্মের উদ্দেশ্যও মানবকল্যাণ, তাহলে কেন ধর্মকে একঘরে করে দূরে সরিয়ে রাখা? কেন লক্ষ লক্ষ মানুষের ঈমানকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পকেটে পুরে রাখা? কেন রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ সরকার আর ধর্মের কর্তৃপক্ষ অন্য কেউ? সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে ধর্মকে যতই ব্যক্তিগত পরিম-লে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হোক ধর্ম ব্যক্তিগত জীবনে থাকছে না। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ঠিকই জাতির কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ রাষ্ট্র ধর্মকে ত্যাগ করলেও মুছে ফেলতে পারে নি, কোনোদিন পারবেও না। আবার শক্তি প্রয়োগ করে এ বিরোধের কোনো নিস্পত্তিও সম্ভব নয়। এখন রাষ্ট্র যেটা পারে তাহলো ধর্মকে বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত থাকার সুযোগ না দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবকল্যাণে ধর্মের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।