বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, পোর্ট অব স্পেন ও মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়াম। ২০০৪, ২০০৭ ও ২০১২। তিনটি ভেন্যু, তিনটি সাল, তিনটি পৃথক ইতিহাসের সঙ্গে জায়ান্ট বধের উচ্ছ্বাস আর রোমাঞ্চ। সবই বিশ্বমানের ব্যাটিং লাইনআপ সমৃদ্ধ শক্তিশালী ভারতের বিরুদ্ধে। বড়ই সুখানভূতি স্মৃতি। চলমান ক্রিকেট বিশ্বকাপে দাপট দেখিয়ে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালে। আগামী ১৯ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সেমিতে যাওয়ার লড়াইয়ে টাইগারদের প্রতিপক্ষ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারত। মাঠের লড়াইয়ের আগে চলছে কথার লড়াই। হচ্ছে প্রতিপক্ষকে খাটো করার হীন সব বিজ্ঞাপনও। যা করছে ভারতই। ইতিহাস, শক্তি-সামর্থ্য, পরিসংখ্যান- সবই ভারতের পক্ষে। তবে কখনো কখনো উল্টে যায় পরিসংখ্যান, ঘটে নতুন ইতিহাস, বিষাদে ছেয়ে যায় প্রতিপক্ষের তনুমন। বি পুল চ্যাম্পিয়ন ভারত। একটিতেও হারেনি তারা। এ পুলে চতুর্থ স্থান দখল করা দল বাংলাদেশ। ছয় ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে জয়, দুটিতে হার,একটি
পরিত্যক্ত। ভারতের সংগ্রহ ১২ পয়েন্ট, বাংলাদেশের সাত। পয়েন্টর পার্থক্য ছয়। তবে এবার লড়াই নকআউট পর্বের। যেখানে হারলেই বিদায়, জিতলে সেমিফাইনাল। হৃদয় কাঁপুনি এমন ম্যাচের আগে উজ্জীবিত টাইগার শিবির। প্রেরণা খুঁজছে অতীত ইতিহাস থেকে। তবে সত্যি কথা বলতে, এই ম্যাচের আগে প্রেরণার নামতো সাকিব আর মাশরাফিই। সঙ্গে যোগ হতে পারেন তামিম ও মুশফিকও। ভারতের সঙ্গে এখন পর্যন্ত ২৮টি ওয়ানডে ম্যাচে মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ। ভারতের জয় সিংহভাগ, ২৪টি। বাংলাদেশের জয় মাত্র তিনটি। এক ম্যাচ হয়েছে পরিত্যক্ত। তবে বাংলাদেশ যে তিনটি ম্যাচে জিতেছে তার দুটিই ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। একটি ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপ ও দ্বিতীয়টি ২০১২’র এশিয়া কাপ। ঐ দুটি পরাজয়ে টুর্নামেন্ট থেকেই বিদায় নিয়েছিল ভারত, যে স্মৃতি এখনও গায়ে কাঁটা দেয় ধোনিদের। সব মিলিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে তিন জয়ের নায়ক কিন্তু ছিলেন মাশরাফি ও সাকিবই। পার্শ্ব নায়ক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন হার্ড হিটার তামিম ও নির্ভরতার প্রতীক মুশফিকুর রহীম। মজার ব্যাপার, এই চারজনই আছেন চলমান বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। ভারত বধের জন্য এর চেয়ে বড় প্রেরণা আর কি বা হতে পারে? একসময় ভারতের কাছে হারই ছিল নিয়তি। প্রায় ডজনখানেক পরাজয়ের পর আনলাকি থার্টিনেই জয়ের হাসি হাসে বাংলাদেশ। সেটা ছিল ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দ্বিতীয় ম্যাচেই প্রথমবারের মতো ভারত বধ করে টাইগার শিবির। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আগে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২২৯ রান করেও বাংলাদেশ জিতেছিল ১৫ রানে। ঐ ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৬৭ রান করেছিলেন আফতাব আহমেদ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১ রানের (৩৯ বল) অপরাজিত ইনিংস ছিল তরুণ ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার। ২৩০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারত অল আউট হয়েছিল ২১৪ রানে। শেবাগ, গাঙ্গুলী, যুবরাজরা ছিলেন চরম ব্যর্থ। বল হাতে সমান তালে রুদ্ররূপে হাজির হয়েছিলেন মাশরাফি, তাপস বৈশ্য, মোহাম্মদ রফিক ও খালেদ মাহমুদ সুজন। সবাই নিয়েছিল দুটি করে উইকেট। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের কারণে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন মাশরাফিই। ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম জয়ের একমাত্র খেলোয়াড় হিসাবে স্কোয়াডে আছেন মাশরাফি।
ভারতের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় জয় পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় তিন বছর। ২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে। ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে যেখানে গ্র“প পর্বের ম্যাচে ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ধোনিদের দেশের বিমানে উঠিয়েছিল হাবিবুল বাশার বাহিনী। এই ম্যাচেও সেরা খেলোয়াড় সেই মাশরাফিই। আগে ব্যাট করতে নেমে টাইগারদের বোলিং তোপে নাস্তানাবুদ ভারত শিবির। মাত্র ১৯১ রানেই অলআউট। গাঙ্গুলীর ৬৬, ও যুবরাজের ৪৭ রান কিছুটা মান বাঁচিয়েছিল তাদের। মাশরাফি নিয়েছিল চার উইকেট। রাজ্জাক ও রফিক নিয়েছিলেন তিন উইকেট। ১৯২ রানের জয়ের টার্গেটে বাংলাদেশ পৌঁছেছিল নয় বল হাতে রেখেই। ব্যাট হাতে তিন ফিফটি এসেছিল তামিম, সাকিব ও মুশফিকের হাত ধরে। ভারতের বিরুদ্ধে এই জয়টা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখনও বেশ স্মরণীয় বাংলাদেশের জন্য। এই ম্যাচের জয়ের চার নায়ক মাশরাফি, তামিম, সাকিব ও মুশফিক এখনও দুর্দান্ত প্রতাপে রয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তৃতীয় জয়টি মনে রাখার মতো। ২০১২ সালের এশিয়া কাপ, মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। এই ম্যাচে লড়াই হয়েছিল হাড্ডাহাড্ডি। শুধু তাই নয় এই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন ভারতীয় লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার। কিন্তু দিন শেষে শচীনের সেই সেঞ্চুরি বাঁচাতে পারেনি ভারতকে। বাঘের গর্জনে ভারতীয়দের সব কারিকুরি হয়েছিল ¤¬ান। আগে ব্যাট করতে নেমে ভারতের সংগ্রহ পাঁচ উইকেটে ২৮৯ রান। পাহাড়সম এই টার্গেট বাংলাদেশ অতিক্রম করেছিল চার বল ও পাঁচ উইকেট হাতে রেখে। কি অবিশ্বাস্য! ব্যাট হাতে জ্বলে উঠেছিলেন প্রায় সবাই। সর্বোচ্চ ৭০ করেছিলেন তামিম ইকবাল। এছাড়া জহুরুল (৫৩), নাসির হোসেন (৫৪), সাকিব আল হাসান (৪৯), মুশফিকের (৪৬*) ব্যাটিং দৃঢ়তা ছিল দেখার মতো। ম্যাচ সেরা অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। সেই ম্যাচের পর বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে খেলেছে চারটি ম্যাচ। যার মধ্যে তিনটিতেই হার। শেষ ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত। এবার মেলবোর্নে কী হবে? ভারত বধের অন্যতম নায়কেরা এখনও টাইগার স্কোয়াডে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকের সঙ্গে এবার যোগ হয়েছেন তুরুপের তাস মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। জয়ের জন্য এইতো সহজ মওকা। কোথায় যাবে ভারত?