জাপানে পৃথিবীর ভয়াবহতম নিউট্রণ বোমা হামলা জায়েজ করতে অনেকেই (অধ্যাপক থেকে ছাত্র, সাংবাদিক থেকে গবেষক পর্যন্ত) এটা বলেন যে, এ হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বন্ধে দরকারি ছিল এবং এটি জাপান কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার বিমান ঘাঁটিতে আক্রমনের জবাব। এটি একটি চরম ভুল ধারণা এবং অপরাধী স্বত্ত্বা আড়াল করতে আমেরিকার প্রোপাগান্ডার সফল উপস্থাপন। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে উস্কানী খুঁজছিল। সেইসঙ্গে অপেক্ষা করছিল বড় বড় শক্তিগুলো একে অপরকে ধ্বংস করে দুর্বল হওয়া পর্যন্ত সময়ের। কারণ, জায়োনিস্ট বলয় চাচ্ছিল আমেরিকার মধ্যে এমন একটি সুপারপাওয়ারের উত্থান ঘটাতে যেটি ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাঈল জন্ম নিতে সহায়ক হবে। হয়েছিলও তাই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের এ যুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রবল বাসনা ঐতিহাসিক Charles C Tansill Gi Back Door to War : The Roosevel Foreign Policy (1933-1941) গ্রন্থটিতে বেশ গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩. ১৮৯৬ সালে ইহুদীবাদের লোকসম্মুক্ষে প্রকাশের পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে জায়োনিস্টরা প্রতিটি যুদ্ধের কলকাঠি নাড়ছিল সেটা ভুলে গেলে ইতিহাস ইহুদীবাদী আমেরিকার পক্ষে চলে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ইউরোপে, জার্মানি, ফ্র্যান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, অষ্ট্রিয়া, ইতালি প্রভৃতি রাষ্ট্র যুক্ত ছিল। এমন কি জার্মাণ ডেসট্রয়ার মার্কিন রণতরী পর্যন্ত ডুবিয়ে দেয়। এটিই প্রথম মার্কিনীদের প্রতি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা বড় ধরনের আক্রমণ, পার্ল হারবার নয়। অথচ “পার্ল হারবারে জাপান হামলা করে` আমেরিকাকে যুদ্ধে ডেকে এনেছে” এই প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয় যুগের পর যুগ ধরে এবং এখনো তা চলছে। হিরোশিমা, নাগাসাকির ট্রাজেডিতে সে মিথ্যা চিহ্নিত হোক। আসলে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে আমেরিকা যুদ্ধে আসতোই। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ড রুজভেল্ট চাচ্ছিল জাপান, জার্মানি বা ইতালি যেন আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
৪. এখন প্রশ্ন একাধিকবার জার্মান হামলায় আক্রান্ত হয়েও আমেরিকা ইউরোপে কেন পারমাণবিক বোমা ফেললোনা? এর উত্তয় পাওয়া যায় তৎকালীন মার্কিন রিয়ার এডমিরাল রবার্ট আলফ্রেড থিওবালডের The final secret of Pearl Harbor: The Washington background of Pearl Harbor Attack বইটিতে। এই বইয়ে বলা হয়, ব্রিটিশ ও ইহুদীরা চাচ্ছিল, যে করেই হোক আমেরিকাকে যুদ্ধে নামাতে হবে। এদিকে হিটলারও আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করছিল না। ফলে জায়োনিস্ট পরিকল্পনা চলে যায় এশিয়ার দিকে, জাপানে। যেহেতু জাপান-জার্মানি-ইতালির ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী “একদেশের উপর হামলা তিন দেশের উপর হামলা” বলে বিবেচিত হতো তাই আমেরিকা জাপানের কাছ থেকে আগে আক্রান্ত হওয়ার সব পথ খোলা রাখে। এ বইয়ে আরো দাবি করা হয়, জাপানের আক্রমণের ব্যাপারে ওয়াশিংটন আগেভাগে জানতো এবং জেনেও পার্ল হারবারকে অনিরাপদ করে রাখে।
৬. এই ইতিহাস পাওয়া যায় Robert B Stinnett Gi Day of Deceit : The Truth about FDR and Pearl Harbour বইটিতে। এখানে বলা হয়েছে, রুজভেল্ট সরকার চাচ্ছিল জাপান থেকে একটা হামলা আসুক। এই হামলার জন্য জাপানের প্রস্তুতিও জানতো ইউএসএ। তারা জাপানি সামরিক কোডও ভেঙে ফেলেছিল। জায়োনিস্ট ব্লক সেটি জেনেই পার্ল হারবারে আক্রান্ত হয় অথবা আক্রমণ করে। এর কারণ সুপার পাওয়ার হতে ইউএস এর ক্ষমতা প্রদর্শন দরকার ছিল। রুজভেল্ট একটা উপায় খুঁজছিল যুদ্ধে জড়ানোর। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ছিলেন কট্টর ইহুদীপন্থী। ফিলিস্তিনের বুকে অবৈধ ইসরাঈল নামের ক্যানসার তৈরিতে এই ব্যক্তির ভূমিকা অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকাকে এনে জাপানকে ধ্বংস্তূপ করেনও রুজভেল্ট। রুজভেল্ট এতোই ইহুদীবাদী ছিলেন যে, রাশিয়ায় একটি আন্দোলনে কিছু ইহুদী নিহত হওয়ায় তিনি চিঠি লেখেন। বর্তমান ইসরাঈল ও ইহুদীদেও নানা বইপত্র ও গবেষণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬ তম প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা দেয়া হয়। এই রুজভেল্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল রাফায়েল নামী এক ব্যক্তি। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরির সময় রাফায়েলের সঙ্গে পরিচয় হয় রুজভেল্টের। রাফায়েলই রুজভেল্টকে জায়োনিজমে দীক্ষিত করে। রাফায়েল ছিল কট্টর ইহুদী। যা বলছিলাম, ফ্রেডরিখ আর এর Design of war:A study of secret power politics(1937-1941) বইটিতে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে, `পার্ল হারবার এটাক` আমেরিকা ও ব্রিটিশ উচ্চ পদস্থদের সক্রিয় সমর্থনের ফল। আর এই বিষয়ে ১৯৪১ সালেই আমেরিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক John Thomas Flynn `Pearl Harbor advance-knowledge conspiracy theory ` এর জন্ম দেন।
৭. এখানে মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জাপান ধোয়া তুলসি ছিলনা। সম্রাট হিরোহিতোর নেতৃত্বে জাপানও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। যুদ্ধের শুরুর দিকে চীনে আগ্রাসন চালায় জাপান। এমনকি বাংলাদেশে অবস্থিত ব্রিটিশদের উপর হামলা করতে চট্রগ্রামে আক্রমণ করে জাপান। তবে এসব আচরণ জাপানে বোমা হামলা চালানোর বৈধতা দেয়না। পার্ল হারবারে জাপান যে হামলা চালায় তা ছিল শান্তি আলোচনায় ইহুদীবাদী রুজভেল্ট প্রশাসনের ইচ্ছাকৃত কালক্ষেপনের ফল। আর আমেরিকার যুদ্ধে অংশগ্রহণের মনোবাসনা ছিল, সেটি আগেই বলা হয়েছে। দরকার ছিল আগে আক্রান্ত হওয়াটা। পার্ল হারবারের `কাঙ্খিত` হামলা আমেরিকাকে সেই সুযোগ এনে দেয়। অতএব একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে পৈচাশিক পারমাণবিক বোমা হামলা চালানোর উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার উপলক্ষ তৈরি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল ক্ষমতা প্রদর্শন। সে চক্রান্ত প্রাথমিকভাবে সফল হয়। তার ফল আজো বিশ্ব ভোগ করছে। আমেরিকাকে ব্যবহার করে ইহুদীবাদীরা একের পর যুদ্ধ ও হতাহত পরিস্থির উদ্ভব ঘটাচ্ছে। পার্ল হারবার বিমান হামলার অজুহাতে চালানো পারমাণবিক বোমা হামলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সুপারপাওয়ার হিসেবে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত করে।
পার্ল হারবারের মর্মান্তিক মঞ্চ নাটকের কাঁধে বন্দুক রেখে হিরোশিমা ও নাগাসাকির পৈচাশিক হামলার সন্ত্রাসী বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন করার এই প্রবণতা আমেরিকা চিরতরে বন্ধ করুক। বাংলাদেশের পরম বন্ধুরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির নিহতদের আত্মা প্রশান্তি পাক। পৃথিবী থেকে যুদ্ধ বিলুপ্ত হোক। শান্তির জয় হোক।
মঈনুল ইসলাম রাকীব
শিক্ষার্থী ও মুক্ত সাংবাদিক,
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশেরপত্র/এডি/পি