আমাদের এই বাংলাদেশ ষড় ঋতুর দেশ। সময়ের সাথে সাথে নানা রূপে সাজে প্রকৃতি। শীতকালের প্রস্থান হলো, বাড়তে শুরু করেছে দিনের তাপমাত্রা। এখন চলছে বসন্ত, যার ছোঁয়া লেগেছে প্রকৃতিতে আর প্রাণে। যদিও রাত হলে শীতের আমেজ এখনও কিছুটা বোঝা যায়, দিনের বেলাটা এখন বেশ গরমই থাকে। ঋতু পরিবর্তনের এই খেলায় তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ধূলাবালি আর বৃষ্টিপাতের তারতম্যে দেখা যায় নানা রকম অসুখ বিসুখের উত্পাত আর স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা। আর আমাদের শরীরের সঙ্গে যে একটি ভারসাম্য থাকে, ঋতু পরিবর্তনে এর পরিবর্তন হয়। ঋতুভেদে এসব অসুখের বেশিরভাগই ভাইরাসজনিত এবং সাময়িক, কিন্তু অস্বস্তিকর। তবে সুবিধা হলো, একটু সতর্ক হলে প্রায় ক্ষেত্রেই এগুলোকে প্রতিরোধ করা যায়। এমনকি রোগ ব্যাধি হয়ে গেলেও তা উদ্বেগের নয়, সহজ চিকিত্সায় নিরাময়যোগ্য। এগুলো থেকে পরিত্রানের জন্য আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন, নিতে হবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
বসন্তের উষ্ণ আবহাওয়ায় বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস সক্রিয় হয়ে উঠে আর বাতাসের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে সাধারণ সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে শুরু করে জলবসন্ত আর হাম জাতীয় রোগব্যাধির প্রকোপ এ সময়টাতে বেশি দেখা যায়। বাতাসে ছাড়ানোর কারণে এগুলো খুবই সংক্রামক বা ছোঁয়াচে, খুব দ্রুতই একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। দেখা যায় বাসায় একজন আক্রান্ত হলে অন্য সকলেই ধীরে ধীরে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার আক্রান্ত ব্যক্তি অফিসে বা ছোট বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়। তাই এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে হলেও আলাদা রাখা দরকার, বিশেষকরে শিশু, বৃদ্ধ ও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের থেকে এদের পৃথক রাখতে হবে।
ঋতু পরিবর্তনের সময় ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সবাই সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ডে আক্রান্ত হয় বেশি। এই রোগে প্রায়ই দুই তিন দিন নাক বন্ধ থাকে, নাক দিয়ে পানি ঝরে, হাঁচির সাথে গলা ব্যথা করে, শুকনা কাশি থাকে, জ্বরও থাকতে পরে। এগুলো বেশিরভাগই ভাইরাস জনিত, লক্ষণভিত্তিক কিছু চিকিত্সা, এমনকি কোন চিকিত্সা ছাড়াই ভালো হয়, কোন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না। তবে শুকনা কাশিটা কয়েক সপ্তাহ ভোগাতে পারে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ, এর সাথে এন্টিহিস্টামিন খেতে হবে। আর গরম পানিতে গড়গড়া করতে হবে। গরম চা বা গরম পানিতে আদা, মধু, লেবুর রস, তুলসি পাতার রস ইত্যাদি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরপরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। কাশির সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রংয়ের কফ বের হলে সাথে জ্বর থাকলে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। মনে রাখতে হবে জ্বর যদি বেশি দিন থাকে, কাশি যদি দুই সপ্তাহের বেশি হয়, সর্দি যদি না-ই সারে, তবে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে। অযথা অবহেলা করলে অসুখ জটিল হয়ে যেতে পারে। অথবা খারাপ রোগেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সময়টাতে আরও একটি ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় যাকে বলে সিজনাল ফ্লু। এই রোগের লক্ষণগুলোও কমন কোল্ডের মতোই। আলাদা কোন চিকিত্সারও প্রয়োজন হয় না, উপরের কমন কোল্ডের মতোই উপসর্গ ভিত্তিক চিকিত্সা দিলেই ঠিক হয়ে যায়।
জলবসন্ত হলে প্রথমে জ্বর, শরীরে প্রচন্ড ব্যথা আর সর্দি দেখা দেয়। তারপর গায়ে ফোস্কার মতো ছোট ছোট দানা উঠে। সঙ্গে থাকে অস্বস্তিকর চুলকানি, ঢোক গিলতে অসুবিধা, অরুচি ইত্যাদি। এটাও কোনো মারাত্মক অসুখ নয়। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, শরীর চুলকালে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, ক্যালামিন লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করলেই রোগের প্রকোপ কমে আসবে। আর সংক্রমণ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
বসন্তে গাছে গাছে থাকে হাজারো ফুলের সমাহার, আর তার সাথে বাতাসে ভেসে বেড়ায় ফুলের পরাগ রেনু। এই সব রেনু অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে। অ্যালার্জিজনিত অ্যাজমা বা হাঁপানির অন্যতম কারণ এই পরাগরেনু। এই সময় বাতাসে অ্যালার্জেন বেশি থাকায় হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস সহ অন্যান্য অ্যালার্জিজনিত রোগরে প্রকোপও বেড়ে যায়। তাই এই পরাগরেনু এড়িয়ে চলাই ভালো। প্রয়োজনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা ভালো, বিশেষ করে যাদেরকে বাইরে বেশি কাজ কর্ম করতে হয়।
সাইনোসাইটিস এবং টনসিলাইটিস জাতীয় রোগগুলোও এই সময়ে দেখা দিতে পারে। টনসিলের সমস্যা যে কারোরই হতে পারে, তবে ছোট বাচ্চারাই বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ শীত চলে যাবার প্রাক্কালে গরমের শুরুতে ঠান্ডা পানীয় বা আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতা এর কারণ। এমনকি বাচ্চারা স্কুলে বা অন্যান্য যায়গায় ধূলাবালিতে খেলাধূলা করলেও এসমস্ত রোগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাতাসের আর্দ্রতা পরিবর্তন আর ধুলাবালির কারণে এসময়টাতে হাঁপানি, ব্রংকাইটিস বা শ্বাসজনিত অন্যান্য রোগের তীব্রতা আর আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যায়।
ফুসফুসের রোগ ছাড়াও এই সময়টাতে অনেকেই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। দেখা যায় অনেকেই প্রচন্ড গরমে পিপাসার কারণে রাস্তাঘাটে যত্রতত্র অপরিষ্কার পানি বা শরবত পান করেন। এছাড়া গরমের কারণে খাবার দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, আর এসব খাদ্যদ্রব্য খেয়ে অনেকেই ডায়রিয়াজনিত রোগব্যাধি, এমনকি টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, জন্ডিস, সাধারণ আমাশয়, রক্ত আমাশয়ও হতে পারে।
শীতবসন্তের আবর্তনে স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই মোটামুটি সুস্থ থাকা সম্ভব। ধুলাবালি পরিহার করতে হবে, অতিরিক্ত গরমে যাওয়াও এড়িয়ে চলতে হবে। ঘাম হলে মুছে ফেলুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠান্ডা পানি বা খাবার খাওয়া, ধূলাবালিতে যাওয়া ইত্যাদি পরিহার করলেই অনেক রোগ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব। ভাইরাজ জনিত অসুখে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে, যেখানে সেখানে দূষিত পানি বা পানীয় পান বর্জন করতে হবে। গরমের কারণে এই সময় পানি বা অন্যান্য তরল পানীয় গ্রহণ করতে হবে একটু বেশি, তবে তা যেন অবশ্যই বিশুদ্ধ হয়। বিশেষ করে যারা অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজকর্ম করেন তাদের বেলায় তরল পানীয়ের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে নেবেন। ওরস্যালাইনও খেতে পারেন।
ঋতু পরিবর্তন চিরন্তন। সময়ের সঙ্গে আসচে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত্, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত। প্রকৃতি সেজে উঠবে বিভিন্ন রূপে, এক সময় অপরূপ, আবার অন্যসময় বিরূপ। আর এরসাথে একেক ঋতুতে একেক রোগব্যাধির প্রকোপও দেখা দিবে। ঋতু পরিবর্তনের সময় সুস্থ থাকার জন্য চাই সচেতনতা, পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরচর্চা ও পরিচ্ছন্নতা। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে। তাই সুস্থ থাকার জন্য ঋতুভেদে কিছু সহজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
ডাঃ ডিন, মেডিসিন অনুষদ
অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়