জিকা ভাইরাস ও ব্রাজিলের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ব্রাজিল সরকার। কিন্তু ভাইরাসটি শনাক্তকরণে ব্রাজিলীয় প্রশাসন একের পর এক পদক্ষেপে চরম ব্যর্থ হয়েছে এবং ভাইরাসটিতে আক্রান্তদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশে দেশটির ব্যর্থতায় প্রশ্ন উঠেছে যে জিকা সংক্রমণের বিষয়টি প্রশাসন কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
মশাবাহিত এ ভাইরাসে আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্রাজিল এবং ব্রাজিলের সবচেয়ে বেশি জিকা সংক্রমিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পার্নামবুকোতে চিকিৎসক, নার্স ও রোগী, কাউকেই ছাড়েনি ভাইরাসটি। বলা হচ্ছে, চলতি বছর অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভাইরাসটিতে আক্রান্তদের শনাক্তকরণে ও জিকায় আক্রান্তদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশে ব্যর্থ হচ্ছে দেশটির সরকার প্রশাসন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশটির স্বাস্থ্য প্রশাসন হাজার হাজার জিকা আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের সেবা দিতে পারছে না, কারণ রোগীর সংখ্যা ধারণক্ষমতার তুলনায় ভীষণ রকমের বেশি হয়ে যাওয়ায় প্রশাসন নিজেই সংকটে পড়ে গেছে। কিন্তু অনেকে বলছে, জিকা শনাক্তকরণে এ ব্যর্থতা অনেকটাই উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং এ ভাইরাসে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞদের দাবি, রোগনির্ণয়ের অসম্পূর্ণ পদ্ধতির কারণে খুব অল্পসংখ্যক রোগীদের জিকায় আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

পার্নামবুকোর স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকার করেছে যে সব রোগীদের ক্ষেত্রে রোগনির্ণয়ের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, রোগটি মহামারী আকার ধারণ করায় জিকার সঙ্গে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশুর জন্মের সম্পর্ক রয়েছে বলে শঙ্কা থাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। অপরিণত মস্তিষ্ক নিয়ে জন্ম নেওয়া ‘মাইক্রোসিফ্যালিক’ শিশুদের এ ত্রুটির সঙ্গে জিকা ভাইরাসের সম্পর্ক রয়েছে বলে আশঙ্কা করলেও এখনো বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা।

বৃটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, গত বছর ব্রাজিলে মাইক্রোসিফ্যালিতে আক্রান্ত হয়ে জন্ম নেওয়া মোট শিশুর এক-তৃতীয়াংশই জন্মগ্রহণ করেছে পার্নামবুকোর রিসিফ শহরে। নিকটবর্তী অলিন্ডায় অসংখ্য মানুষের মধ্যে জিকা ও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ দেখা গেছে বলে জানিয়েছে ভাইরাসটি ধ্বংসের অভিযানে নামা স্বেচ্ছাসেবকরা। এডিস এইজিপ্টি মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি জিকা ভাইরাস ছড়ানোর জন্যও দায়ী। গত ছয় মাসে এই তিন ধরনের ভাইরাস ছেয়ে গেছে ব্রাজিলে।

ব্রাজিলের পরিবেশ স্বাস্থ্য সংস্থা সেভালের পরিসংখ্যানবিদ পলা অ্যালেন (৩৫) জানান, সংস্থাটির জিকা নির্মূলকারী ১০টি দল অলিন্ডায় প্রতিদিন গড়ে নতুন করে জিকায় আক্রান্ত হওয়া একশ’ জন রোগী পাচ্ছে। অলিন্ডার পথে প্রান্তরে মশা নিবারক উপাদান ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছে সংস্থাটি।

ব্রাজিলে এ মহামারী শুরুর পর থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ থেকে ১৫ লাখে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা এত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে যে এখন রোগী গণনাই বন্ধ করেছে দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে প্রশাসন।

অ্যালেনের দাবি, ভাইরাসটি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়লেও প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের সরকারের সহযোগিতার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অথচ মহামারীটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে সরকার প্রকৃত পরিস্থিতি লুকোনোর চেষ্টা করছে, কারণ এ বছরকে ঘিরে সরকারের অনেক বড় বড় পরিকল্পনা রয়েছে। ব্রাজিলে এ বছর পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক উৎসব রিও কার্নিভ্যাল- যেখানে অংশ নেন হাজারো বিদেশী পর্যটক এবং এ বছরের অলিম্পিক গেমসের আয়োজক দেশও ব্রাজিল। এসব আয়োজনকে ঘিরে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়ে ব্রাজিলের জাতীয় পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতেই জিকা মহামারীর আসল রূপ তুলে ধরছে না প্রশাসন।’

জিকাই প্রথম মহামারী নয়, যার সুষ্ঠু প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে ব্রাজিলীয় প্রশাসন। গণস্বাস্থ্য প্রশিক্ষক ও চিকিৎসাবিদ আর্থার শিয়োরোকে তার দায়িত্ব থেকে গত সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু মহামারীর সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অব্যাহতি দিয়েছে। এরপর তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে মার্সেলো কাস্ত্রো নামের এক পেশাদার রাজনীতিবিদকে, যার গণস্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তাকে এ দায়িত্ব হস্তান্তর করেন স্বয়ং রুসেফ। আর জিকা মহামারীর সময়ে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পাশাপাশি কাস্ত্রোর বিভিন্ন মন্তব্য নানাসময়ে বিতর্ক ও সমালোচনা উস্কে দিয়েছে। এরকমই এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, ‘নারীরা পা উন্মুক্ত রাখা পোশাক পড়েন’ বলে মশার কামড়ে পুরুষের তুলনায় তারাই বেশি আক্রান্ত হন বলে তিনি মনে করেন।’

অ্যালেন বলেন, ‘এই এলাকার লোকজন একজোট হয়ে কাজ করছে এবং একে অপরের জন্য স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা এখনো পর্যন্ত কোনো আর্থিক বা অন্যান্য ত্রাণ সহায়তা পাইনি। কিন্তু আমাদের ওপর সমানে কাজের চাপ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত ১২ বছর ধরে এই সংস্থায় কাজ করছি আমি, এমন আগে কখনো দেখিনি।’

সরকারিভাবে জিকায় আক্রান্তদের সঠিক সংখ্যা কম দেখানোর প্রচেষ্টা হিসেবেও জিকা ভাইরাস সঠিকভাবে শনাক্ত করা হচ্ছে না বলেও দাবি করেছেন তিনি। অ্যালেন নিজেও জিকায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়েছেন এবং তার মতোই আরো অনেককেই আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা ছাড়াই বলে দেওয়া হয়েছে যে তাদের ‘চিকুনগুনিয়ার মতো কিছু’ হয়েছে এবং মাথাব্যথার জন্য সাধারণ ঔষধ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে একমাত্র যে সুবিধা আমি পেয়েছি, তা হলো তিনদিনের ছুটির জন্য একটি স্বাস্থ্যসনদ।’

রিসিফ ইউনিভার্সিটির মহামারী বিষয়ক স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অধ্যাপক অ্যানা লুসিয়া হিলারিও জানান, জিকা শনাক্তকরণে ব্যর্থ হলে মহামারী রোধে সঠিক পদক্ষেপ সরকার কখনোই নিতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘রোগ ছড়ানো প্রতিহত করার লক্ষ্য অর্জনের মূল চাবি হল এ বিষয়ে শিক্ষা।’

এদিকে, জিকা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে শঙ্কিত দেশটির জনসাধারণ। একইসঙ্গে যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থাও নেই। হিলারিও বলেন, ‘অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কায় নারীরা ঘরের বাইরে বের হওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িঘরে মশারি সরবরাহের জন্য কোনো অর্থসহায়তা নেই। আর বস্তি এলাকাগুলোর ব্যাপারে তো কিছু বলারই নেই।’

সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে জিকা প্রতিরোধে ব্রাজিল সরকারের দুই লাখ সেনাসদস্য মোতায়েনের খবর। কিন্তু সেনাবাহিনী মোতায়েনের কয়েকদিন পর থেকেই অলিন্ডার বস্তি এলাকাগুলো বা শহরের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোতে কোনো সেনাসদস্যের উপস্থিতি নেই।

অলিন্ডার একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত সেবিকা গিল্ডা সিয়ারা (৩৭) জিকায় আক্রান্ত বলে নিজেই সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যপরীক্ষার পর ফল পেয়েছেন ১৫দিন পর। অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, কয়েক ঘণ্টায় জিকায় আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করতে প্রস্তুত তারা। সিয়ারা জানান, তার প্রতিবেশীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে একই ধরনের লক্ষণ দেখা গেছে। এসব লক্ষণের মধ্যে ভীষণ জ্বর, হাড়ের সংযোগে ব্যথা, প্রদাহ ও ফুসকুড়িও রয়েছে।

সরকারের যুক্তি, বিপুলসংখ্যক রোগীর প্রত্যেককে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয় বলে হাসপাতালগুলো অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রাধান্য দিচ্ছে। কেন রোগনির্ণয় প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হচ্ছে না জানতে চাওয়া হলে পার্নামবুকোর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বীকার করে নিয়েছে যে মহামারীর সময়ে প্রত্যেককে সম্পূর্ণ সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ‘কেবলমাত্র অন্তঃসত্ত্বা নারী ও মাইক্রোসিফ্যালি আক্রান্ত শিশুদেরই এ সেবা দেওয়া হচ্ছে।’

একই মত প্রকাশ করেছেন রিসিফের অসওয়াল্ডো ক্রুজ হাসপাতালের প্রধান ইনফেক্টোলজিস্ট অ্যাঙ্গেলা রোশা, ৬৭, জানান, ‘এ সংকট বাড়তে থাকার প্রধান কারণ হল শৌচাগার ব্যবস্থা উন্নত করতে প্রচেষ্টার অভাব’।

একই শহরের ইমিপ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক আদ্রিয়ানা স্কাভাজ্জি, ৪২, জানান, রোগটি সংক্রমণ পরিস্থিতির সঠিক চিত্র বুঝতে সরকারি প্রচেষ্টা ভীষণ ঢিলে গতিতে চলছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি রোগেরই একটি প্রাথমিক চিত্র থাকে, যা দেখে প্রথমেই সচেতন হলে সরকার পরিস্থিতি শুরুতেই নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। কিন্তু জিকার ক্ষেত্রে এ মহাদেশে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ২০১৫ সালের আগস্টে প্রথমবার হঠাৎ করে রোগটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে লক্ষ্য করা হয়। কিন্তু এর পাঁচ মাস পর ডিসেম্বর অবধিও কোনো সচেতনতা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।’

তিনি জানান, তার হাসপাতালে কোনো আর্থিক বা ত্রাণ সহায়তা সরকার পাঠায়নি। জিকা প্রতিরোধী কর্মী দল হাসপাতালটিকে নিজস্ব প্রচেষ্টায় সংগঠিত করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সঠিক তথ্য না পেলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ, তা কিভাবে অনুমান করব আমরা বা কিভাবে সে পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ব? এমন পরিস্থিতি যে শুধু রিসিফেই, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এই মহামারী অলিম্পিক গেমসকে বাধাগ্রস্ত করতেই পারে।’

আর এটাই, অর্থাৎ বিশাল বাজেটের আসন্ন অলিম্পিক গেমসই ব্রাজিল সরকারের কাছে মূল সমস্যা, ভাষ্য সমালোচকদের।

Comments (0)
Add Comment