আশিস রহমান, সুনামগঞ্জ: ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি রাত ১০টায় সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্যাস ক্ষেত্রে প্রথম দফা বিস্ফোরণ ঘটে। প্রথম দফা বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরণ ঘটে একই বছরের ২৪ জুন রাত ২টায়। দু’দফা বিস্ফোরণে টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডের প্রোডাকশন কূপের রিগ ভেঙে প্রচন্ড গর্জন এবং ভয়াবহ কম্পনসহ ২০০ থেকে ৩০০ ফুট পর্যন্ত আগুন ওঠা-নামা করতে থাকে ।
দুই দফা বিস্ফোরণে গ্যাসফিল্ডের মাটির ওপরে ৩ বিসিক গ্যাস পুড়ে যাওয়া এবং ৫.৮৯ থেকে কমপক্ষে ৫২ বিসিক গ্যাসের রিজার্ভ ধ্বংস হওয়াসহ আশপাশের টেংরাটিলা, আজবপুর, গিরীশনগর, খৈয়াজুরি ও শান্তিপুরের মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিবেশের ক্ষতি হয়।বিস্ফোরণের পর আশপাশের মানুষের সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে কিছুদিন পরই নাইকো তাদের সরঞ্জামাদি নিয়ে গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চলে যায়।
দূর্ঘটনার প্রায় ১১ বছর পরও দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা পরিত্যক্ত গ্যাসফিল্ডের আশপাশ এলাকা ও বাড়িঘর এবং টিউবওয়েল দিয়ে বুদবুদ আকারে গ্যাস বের হচ্ছে। এখনও টিউবওয়েল দিয়ে উদগীরিত গ্যাসে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।টেংরাটিলা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ও গ্যাসফিল্ডের পাশের গ্রামের বিভিন্ন পুকুর, জমি, রাস্তা ও বাড়ি-ঘরের ফাটল দিয়েও বুদবুদ আকারে গ্যাস বেরোচ্ছে। এখনো আতঙ্কিত টেংরাটিলা গ্রামের মানুষ। গ্রামের প্রায় সকল বাড়িরই বিভিন্ন ফাটল, ফসলি জমি ও রাস্তা দিয়ে গ্যাস উদগীরণের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ পাতা ঝরে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। ওই এলাকার অগনিত মানুষ টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড ট্রাজেডির বিভীষিকাময় স্মৃতির প্রতক্ষ্য সাক্ষী হয়ে আজো বেচে আছেন। বর্তমান ওই এলাকায় নারী পুরুষ ও শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।
স্থানীয়রা আর্সেনিক দুষণ, অকাল গর্ভপাত, শ্বাস কষ্ট, চোখে কম দেখা, চর্মরোগসহ নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
এদিকে উদগীরিত গ্যাসে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় টেংরাটিলা ও তার আশপাশের এলাকা অনেকটা বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়েছে ফলে স্থানীয়রা বিকল্প জ্বালানী চাহিদা মেটাতে না পারায় ঝুকিপূর্ন ভাবে অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস যত্রতত্র ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় টেংরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আহাম্মদ।
তিনি আরোও জানান দূর্ঘটনার এগারো বছর পেরিয়ে গেলেও কথা রাখেনি নাইকো। ক্ষতি গ্রস্তরা এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পায়নি। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় ঝুকিপূর্ন এলাকায় নিরুপায় হয়ে বসবাস করছেন তারা। যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন।
এ ব্যাপারে টেংরাটিলা দাবী আদায় কমিটির নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার আজিম উদ্দিন জানান, টেংরাটিলা গ্যাস ক্ষেত্র নিয়ে আইনী জটিলতার দরুন সরকার অনেকটা উদাসীন। ফলে সম্ভাবনা ময় প্রাকৃতিক গ্যাসের অপার সম্ভাবনা টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশ হারাতে বসেছে জাতীয় সম্পদ।
তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পর্যাপ্ত ক্ষয়ক্ষতি পূরনের দাবী জানান। যোগাযোগ করা হলে দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইফুল ইসলাম প্রতিবেদককে জানান কিছুদিন আগে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে এটি আইনি প্রকৃয়াধীন রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে নাইকোর গ্যাস কুপ খননে অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন পরপর দুই দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে দেশের গ্যাস সম্পদ ও গ্যাসফিল্ড এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে বর্তমান সরকার আর্ন্তজাতিক আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করে। বর্তমানে আর্ন্তজাতিক আদালতে মামলাটি বিচারধীন রয়েছে।
তবে এলাকার জনসাধারণের একটাই প্রশ্ন দূর্ঘটার প্রায় এগারো বছর পেরিয়ে গেলেও আদৌ টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড ট্রাজেডির ক্ষয়ক্ষতি ও সার্বিক সমস্যার কার্যকর সমাধান হবে কি?