ধর্মের শিক্ষা সবার রাষ্ট্রও সবার

মসীহ উর রহমান, আমীর, হেযবুত তওহীদ

‘ধর্ম ব্যক্তিগত আর রাষ্ট্র সামষ্টিক’- এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে; যখন ইউরোপে একটি বস্তুবাদী সভ্যতা স্থাপিত হয় যার মূলভাব হচ্ছে, “বর্তমানের এই জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির যুগে ধর্ম আর প্রযোজ্য নয়। যারা ব্যক্তিগতভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাস করতে চায়, উপাসনা করতে চায় করুক, কিন্তু ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র চলবে না, রাষ্ট্র চলবে মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থা দিয়ে।” এই দর্শনকে বাস্তবরূপ দিতে গিয়ে প্রচারমাধ্যম ও শিক্ষা-ব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্মকেই মুছে ফেলার প্রয়াস চালানো হয়েছে। ধর্মকে পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মানুষকে ধর্মহীন করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা সফল হয় নি। কারণ প্রতিটি মানুষের মধ্যে স্রষ্টার আত্মা, রূহ আছে (সুরা হিজর ২৯)। মানুষের হাতে আছে ধর্মগ্রন্থ যা স্রষ্টার স্বাক্ষর বহন করছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে স্রষ্টা, প্রভুর নিদর্শন যার সামনে মানুষের মস্তক অবনত হয়। যখনই তারা বিপদাপন্ন হয় তখন প্রতি নিঃশ্বাসে তাদের স্রষ্টা, প্রভুর কাছেই আশ্রয় চায়। ইউরোপীয়রা ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে নির্বাসন দিয়েছিল কারণ ঈসা (আ.) যে শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন সেটা ছিল মূলত ব্যক্তির আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য। জাতীয় জীবন পরিচালনার বিধান তাঁর আনার প্রয়োজন পড়ে নি, কেননা সেটা পূর্বের কেতাব তওরাতেই ছিল। কিন্তু ইউরোপে শুধু খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে দণ্ডবিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি না থাকায় ধর্মযাজকরা নিজেরাই নিজেদের মনগড়া বিধানকে ঈশ্বরের বিধান বলে চালিয়ে দিতেন। সমগ্র ইউরোপেই কয়েক শ’ বছর ধরে রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে স্বার্থ ও কর্তৃত্ব নিয়ে প্রচণ্ড বিরোধ চলেছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল, মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয়েছিল কোটি কোটি মানুষ। উপায়ন্তর না পেয়ে ১৫৩৭ সনে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরির সময়ে ধর্মকে ব্যক্তিজীবনে আবদ্ধ করা হয় এবং রাজা হন সার্বভৌম কর্তৃত্বের মালিক। এই রাষ্ট্রনীতি সমগ্র ইউরোপে গৃহীত হয়। কিন্তু ইসলামে যেহেতু মানুষের সামগ্রিক জীবনের বিধান আছে, তাই মুসলিমদের ধর্মকে ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবুও ইউরোপীয়রা যে মুসলিম দেশগুলো দখল করে নিয়েছিল সেখানে জাতীয় জীবন থেকে ইসলামকে ছেটে ব্যক্তিজীবনে সীমিত করে ফেলা হলো। আর ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থা এখানেও চাপিয়ে দেওয়ার হলো। কিন্তু আল্লাহ যাকে দুটো সুস্থ পা দিয়েছেন সে কেন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করবে? তাই ইউরোপের রাষ্ট্রব্যবস্থা বিগত তিনশো বছরে মুসলিমদের উপর যতই চাপানোর চেষ্টা করা হোক সেটা তাদের জীবনে ও চিন্তা-চেতনায় সামগ্রিকভাবে গৃহিত হলো না। তাদের মধ্যে সামষ্টিক জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেতনা জাগ্রত থাকল। এখানেই ঘটল বিপত্তি। তাদের সামনে যে ইসলামটি আছে সেটা আর প্রকৃত রূপে নেই, সেটা বহু আগেই বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে গেছে, সেটা দিয়ে আর শান্তি আসবে না। উপরন্তু সেটা অতিবিশ্লেষণকারী আলেমদের দ্বারা এতটাই জটিল ও দুর্বোধ্য রূপ নিয়েছে যে সেটা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে চলে গেছে। তাই ধর্মীয় বিষয়ে তারা ধর্মব্যবসায়ীদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ল আর ধর্মব্যবসায়ীরাও মানুষের ঈমানকে ভুল পথে চালিত করে স্বার্থ হাসিল করতে সচেষ্ট হলো। শান্তির ধর্ম হয়ে গেল অশান্তির উৎস।
আমাদেরকে আজ বুঝতে হবে, যে ঈমান দুনিয়াতে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও শান্তির কাজে লাগে না সে ঈমান আখেরাতেও জান্নাত দিতে পারবে না। এজন্যই আল্লাহ আমাদেরকে দোয়া করতে শিখিয়েছেন, “হে আমাদের প্রভু! আমাদের দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর, মঙ্গলময় করো এবং আমাদের আখেরাতের জীবনকেও সুন্দর, মঙ্গলময় করো এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো (সুরা বাকারা ২০১)।” বর্তমানে এ জাতির ঈমান, আমল সবই পরকালের সুন্দর জীবনের আশায় অথচ তাদের দুনিয়ার জীবন দুর্দশায় পূর্ণ অর্থাৎ অসুন্দর। কারণ তাদের ধর্মবিশ্বাস ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা মানবজাতির অকল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই মানুষের ঈমানকে সঠিক পথে পরিচালিত করা গেলে তা জাতির উন্নতি-প্রগতি-সমৃদ্ধির কাজে লাগবে।
আমাদের সমাজে একটি শ্লোগান চালু আছে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। এর উল্টোস্রোতে গিয়ে আমরা বলছি ‘ধর্মও সবার, রাষ্ট্রও সবার’। কারণ – (১) প্রকৃতপক্ষে সব ধর্ম এসেছে একই স্রষ্টার পক্ষ থেকে, (২) সকল ধর্মের শিক্ষাও একই অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ সাধন। তাই সকলের স্রষ্টা যেমন এক, সকলের ধর্মও এক। ধর্ম কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য আসে নি। নবী রসুল, অবতারগণ কোনো নির্দিষ্ট জাতি-সম্প্রদায়ের সম্পত্তি নয়, তারা মানবজাতির সম্পদ। তাদের শিক্ষা ও ধর্মগ্রন্থগুলি সকল মানুষকে শান্তি ও মুক্তির পথ দেখাতে পারে।
মানুষের মধ্যে যারা ধর্মের বিভেদ রেখা টানতে চায় তারা প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক নয়, তারা গোঁড়াপন্থী, তারা ধর্মকে খোঁজে শাস্ত্র-কেতাবের পাতায়। কিন্তু প্রকৃত ধার্মিকগণ আলোর দিশারি। তারা ধর্ম বলতে শুধু মানুষকেই বোঝেন, শাস্ত্র-কেতাবের পাতায়ও তারা কেবল মানুষকেই খুঁজে পান।

লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ।

Comments (0)
Add Comment