রেজাউল করিম বকুল, শেরপুর: অঝোরে ঝড়ছে ঝরণার জল। এরই শান্ত শীতল জলের শ্রোতধারা এক টানা বয়ে চলেছে। সহজ সরল এ ঝরণার বুকে জেগে ওঠেছে চর। এ চরের বালু চক চক করছে। পাশেই উচুঁ টিলা। ঝরণা আর সৌন্দর্য্যে অপরূপ পাহাড়ি লীলাভূমি। যেন ঐশ্বরিক স্বপ্নপুরি। এটির কুল ঘেষেঁ নানা কারুকার্যে সাঁজানো উপজাতি এলাকা। এ গারো পাহাড়ের নিঝুম অরণ্য গ্রাম হারিয়াকোনা। আদিবাসীদের বসবাসে যেন গ্রামটিতে যোগ হয়েছে সৌন্দর্য্যরে নতুন মাত্রা। ঝরণার দু’পাশে সবুজ বৃক্ষ। এর আচ্ছাদিত অসংখ্য উচুঁ নিচু পাহাড়। এটি যেন গভীর মমতা আর ভালবাসার গড়া। যেন উপজাতিদের বর্ণিল জীবনধারা। অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির সৌন্দর্য্যময়ী এ গ্রাম।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পোড়াকাশিয়া। এর পাশেই শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ের শেষ গ্রাম হারিয়াকোনা। আজো এখানে পৌঁছেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। গ্রামের ঘরবাড়িগুলো পাহাড়ের চূড়ায়। দূর থেকে মনে হবে যেন আকাশ ছোঁয়া কুটির। ওদের জীবন যাত্রার ৮৫% লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। যেন চেহারাতেই বোঝা যায় প্রকৃতির সাথে লেনদেন বহুদিনের। ভারত থেকে নেমে আসা বন্যহাতির তান্ডব। এতে এলোমেলো হচ্ছে ওদের জীবন জীবিকার পথ। এটাই যেন প্রকৃতির নিয়ম। প্রাকৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় গারো পাহাড়ের গভীর অরণ্য হারিয়াকোনা। এ গ্রামটি অবেহেলিত। এখানে স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। নেই কোনো স্বাস্থ্য সেবা। বিদ্যুৎ নেই। স্যানিটেশন ও শিক্ষা ব্যবস্থাও নাজুক। গ্রামের মানুষগুলোর দিন কাটে খুব কষ্টে। অভাব অনটন যেন ওদের নিত্য সঙ্গী। এর মধ্যে বন্যহাতির সাথে লড়াইয়ে ক্রমাগত হেরে যাচ্ছে ওরা। বন্যহাতির অভয়ারণ্য এ গ্রামেরই ঝোঁপ জঙ্গঁলে। ফলে থেমে নেই বন্যহাতির হামলা। ক্ষতি হচ্ছে ফসল ও ঘরবাড়ির। প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক লোক। ফলে অনেকেই গুঁটিয়ে নিচ্ছেন হালের বলদ। ক্রমাগত বাড়ছে বিরাণ ভূমি।
শ্রীবরদী শহর থেকে হারিয়াকোনার দূরত্ব প্রায় ১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে আড়াই কিলোমিটার দু’পায়ে পাহাড়ি পথ। চলেনা কোনো যান বাহন। কিংবদন্তী রয়েছে, গ্রামটিতে কেউ একবার যে পথে এসেছে সে পথে আর ফিরে যেতে পারেনি। এ কারণে এ গ্রামের নাম হয়েছে হারিয়াকোনা। এ গ্রামের উত্তর ও পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পোড়াকাশিয়া। দু’দেশের সীমানা পিলার নাম্বার ১০৯৩/১০৯৪। পশ্চিমে দিঘলাকোনা। দক্ষিণে বাবেলাকোনা। প্রায় চার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গ্রামটিতে রয়েছে প্রায় অর্ধশত টিলা ভূমি। টিলার ওপরে বসত বাড়ি। প্রায় আড়াইশ আদিবাসী পরিবারের বসবাস এখানে। ওদের মধ্যে বেশিরভাগ গারো, কোচ, হাজংসহ ক্রিস্টান ধর্মালম্বীর। ফলে এলাকাটি আদিবাসী অধ্যুষিত হিসেবে চিহ্নিত। গ্রামটিতে রয়েছে একটি গীর্জা, একটি জিবিসি পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি ফুটবল খেলার মাঠ, কয়েকটি মুদি ও চায়ের দোকান। প্রতি রোববার এখানে ছুটে আসেন গ্রামবাসীরা। উপাসনা ও ধর্মীয় কাজ সেরে তারা মেতে ওঠেন নানা আলোচনায়। এদিন যেন এক আদিবাসীদের মিলন মেলা। পশ্চিম থেকে পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত গ্রামের মাঝে সড়কটির দু পাশে যেন প্রাকৃতিকভাবেই গাছের লতাপাতায় ঘেরা। গ্রামে প্রবেশ করতেই মনে হয় প্রকৃতি যেন আগন্তককে স্বাগত জানাচ্ছে।
স¤প্রতি সরেজমিনে গেলে কথা হয় এখানকার আদিবাসী নেতা ও ইউপি সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মিঃ ভূপেন্দ্র মান্দার সাথে। তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপের জন্যে আমরা প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। এখানকার উৎপাদিত পন্য বাজারজাত করতে উৎপাদনের লাভের অংশ পরিবহন খাতে খরচ করতে হচ্ছে। এ কারণে গ্রামবাসীদের অনেকেই উৎপাদন বিমুখ হচ্ছেন। নানা সমস্যার কথা এভাবেই তুলে ধরেন তিনি। এমনি আগের কথা শোনাতে গিয়ে কৃষক পনোয়েল সাংমা জানান, কেউ অসুস্থ্য হলে গাছের পাতা, শিকড়, কবিরাজ ও ঝাঁড় ফুঁকের ওপরই একমাত্র ভরসা। চিকিৎসা নিতে হলে উপজেলা সদরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হয় তাদের। ফলে অনেকের সামর্থ্য না থাকায় চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। হারিয়াকোনা গ্রামের কৃষকেরা আজো চাষবাদ করেন মান্দাতার আমলের পদ্ধতিতে। সেই আমলের কৃষি জ্ঞান ও উপকরণই তাদের সম্বল। কৃষি কর্মকর্তা আছে এটা তাদের বিশ্বাস করানো কঠিন। বাঁচার তাগিতে তারা পরামর্শ নেন বিগত বছরে যারা ভালো ফলন পেয়েছেন তাদের কাছ থেকে। তাদের পরামর্শে ধান চাষের পাশাপাশি আদা, হলুদ, শিমুল আলু, আম কাঠাল, লিচু, কলা, সুপারি, আনারস, কচু, বেগুন ও শসাসহ বিভিন্ন শাক সবজি চাষ করছেন। এসব চাষাবাদে ওদের মনে বাসা বেঁধেছে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক চাষাবাদের কলা কৌশল এখন পর্যন্ত পৌছেঁনি। কৃষি অধিদপ্তর বা কোন বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসা জরুরি। এতে কৃষকেরা সীমিত জমিতে চাষাবাদ করে লাভবান হবেন বলে মনে করেন ট্রাইবাল চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা সহ গ্রামবাসীরা। উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এফএম মোবারক আলী জানান, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কে দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে অল্প জমিতে বেশি ফলন পাচ্ছে তারা। পাহাড় বেষ্ঠিত হারিয়াকোনার কৃষকেরা শাক সবজি ও ফল মূল চাষ করে ভাগ্য বদলের চেষ্টা করছেন। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদে নেমেছেন। পাহাড়ের পরিত্যক্ত শতশত একর ভূমিতে এখন শোভা পাচ্ছে শাক সবজি ও ফল মূলের চাষাবাদ। ২/৩ বছরের মধ্যেই অনেকে দেখছেন স্বচ্ছলতার মুখ। কেউবা গবাদি পশুর খামার করে হয়েছেন শূন্য থেকে খামার মালিক। গারো পাহাড়ের ঝোঁপ জঁঙ্গল আর বিরাণ ভূমি এখন গোচারণ ভূমিতেও পরিণত হয়েছে।
স¤প্রতি বিদ্যুৎ আর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী। তাদের মতে, বিদ্যুৎ এলে বন্যহাতির কবল থেকে রক্ষা পাবেন। এতে নিরাপদে করতে পারবেন চাষাবাদ। বদলে যাবে তাদের জীবন জীবিকা। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা এগিয়ে যাবেন সমানতালে।
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তর সীমান্তে হারিয়াকোনা গ্রামটির অবস্থান। আয়তন চার বর্গ কিলোমিটার। দেশের আর ১০টি গ্রাম থেকে এ গ্রামটি একটু ভিন্ন। গ্রামের প্রায় সবাই আদিবাসী। কৃষির উপর ৮৫% লোক নির্ভরশীল। এখানে কেউ বেকার বসে থাকে না। এখানকার আদা, হলুদ, শিমুল আলু, আম, কাঠাল, লিচু, কলা, করলাসহ উৎপাদিত কৃষি পণ্য রপ্তানি হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। খুব ভোরে পাখি ডাকার আগেই শুরু হয় কৃষি কাজ। চলে সারাদিন। নারী পুরুষ এক সাথে প্রায় সবাই কাজই করে। এখানে রয়েছে একটি জিবিসি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি গীর্জা ও এক একর জমিতে একটি ফুটবল খেলার মাঠ। এর পাশ ঘেঁষে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পোড়াকাশিয়ার রিমতাং পাড়া থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঝরণা। পার্শ্বে রাবার বাগান।