নেছারাবাদে ২০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের নৌকার হাট

পিরোজপুর সংবাদদাতা:
পিরোজপুরের নেছারাবাদে খাল-বিল ও নদ-নদীতে বর্ষাকালে পানিতে ভরা পরিবেশকে ঘিরে প্রতি বছর আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই চার মাসে সন্ধ্যা নদীর শাখা খালে ভাসমান নৌকার হাট বসে, যেখানে দৃষ্টিনন্দন নৌকার সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। নেছারাবাদ, স্বরূপকাঠী এবং বিল ও চরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাট প্রায় শত বছরের পুরোনো। ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও টেডিলঞ্চের ব্যাপক প্রভাব থাকলেও বর্ষা মৌসুমে পেয়ারার সময় গাছ থেকে পেয়ারা তোলা এবং ভাসমান হাটে বেচা-কেনার জন্য পানসি, আইলা ও ডিঙি নৌকার কদর বেড়ে যায়।

প্রায় দেড়শ বছর ধরে দক্ষিণ বঙ্গের বৃহত্তম এই নৌকার হাট বসছে আটঘর-কুড়িয়ানার খালে এবং রাস্তার এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। নৌকা ব্যবসায়ী সেলিম জানান, প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার ও সোমবার এখানে লাখ লাখ টাকার নৌকা বেচাকেনা হয়। স্বরূপকাঠীর কাঠ ব্যবসার জন্য খ্যাত ১০টি ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের প্রায় ২,০০০ পরিবার এ পেশার ওপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে আসছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকেরা এখানে নৌকা কিনতে আসে।

নৌকা বিক্রেতা মোসলেম আলী জানান, তিনি আজকের হাটে ১৪টি নৌকা এনেছেন এবং বিক্রি খুব ভালো হচ্ছে। একটি সাধারণ আইলা নৌকা তৈরি করতে মেহগনি কাঠের খরচ পড়ে ৮০০ টাকা, আর বিক্রি হয় ১৫০০-১৬০০ টাকায়। ভালো মানের কাঠের নৌকা তৈরিতে খরচ পড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা, আর বিক্রি হয় ৫,০০০ টাকায়। দুইজন লেবারের এক থেকে দেড় দিনের কাজ লাগে একেকটি নৌকা বানাতে, এতে ২,০০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।

ভাসমান নৌকার হাটে ডিঙি নৌকার দাম আকারভেদে ১,৮০০ থেকে ৭,০০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। আম, আমড়া, রেইনট্রি, কড়াই, চাম্বল, এবং মেহগনি কাঠ ব্যবহার করে এসব নৌকা তৈরি করা হয়। আষাঢ় মাসে হাট শুরু হলেও শ্রাবণ মাসের শুরুতেই বিভিন্ন জেলার ক্রেতা-বিক্রেতা ও দর্শনার্থীর ভিড়ে হাট জমজমাট হয়ে ওঠে।

নৌকা ব্যবসায়ী ফরিদ মিয়া জানান, এখানকার মানুষজন নৌকায় করে ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাই পেনিস নৌকার চাহিদা বেশি। নৌকা মিস্ত্রি আলিম জানান, একেকটি পেনিস নৌকা তৈরি করতে তার এক থেকে দেড় দিন সময় লাগে এবং খরচ পড়ে ১,৪০০ থেকে ১,৬০০ টাকা, যা তিনি ২,০০০ থেকে ৩,০০০ টাকায় বিক্রি করেন।

নৌকা ব্যবসায়ী জহিরুল জানান, তিনি ৩০ বছর ধরে এই হাটে আসছেন এবং আষাঢ়-শ্রাবণে বেচাকেনার ব্যস্ততা থাকে সবচেয়ে বেশি। মিস্ত্রি সাদিক বলেন, এবার নৌকা তৈরিতে কাঠ ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েছে, যা আগের তুলনায় লাভ কমিয়েছে। গত বছর যে নৌকা ২,৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার তা ৩,০০০-৩,৫০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

হাটে প্রতি সপ্তাহে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজারেরও বেশি নৌকা বিক্রির জন্য সাজানো থাকে। বৈঠা আলাদা বিক্রি হয়, যার দাম আকার ও কাঠভেদে ৭৫ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ইজারাদাররা প্রতি ১০০ টাকায় ১০-১২ টাকা খাজনা নিচ্ছে, যা অন্যবারের তুলনায় বেশি। তবে হাটে ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো বসার ব্যবস্থা নেই। রোদে পুড়ে এবং বৃষ্টিতে ভিজে তাদের ব্যবসা করতে হয়। ইজারাদার মনোজ কুমার বলেন, এখানে কোনো অতিরিক্ত খাজনা নেওয়া হয় না।

Comments (0)
Add Comment