তিন ম্যাচের মধ্যে দ্বিতীয় ওয়ানডে বাংলাদেশকে ম্যাচ জয়ের জন্য ২৪র রানের টার্গেট দিয়েছিলো পাকিস্তান। তৃতীয় ম্যাচেও বাংলাদেশকে টার্গেট দিয়েছিলো সফরকারীরা। তবে এবার লক্ষ্য ২৫১। অর্থ্যাৎ ১১ রান বেশি। তাই ভাবা হয়েছিলো ‘ম্যাচটি যেহেতু শেষ ওয়ানডে, আর ১১ রান বেশি’ তাই পাকিস্তান বোলাররা কোনভাবেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ছাড় দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশ যে এখন সেই আগের দল নয়। সময় বদলেছে, বদলেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। তাই বলে এতটা, তা হয়তো কেউই ভাবেনি। পাকিস্তানের শক্তিশালী বোলিং লাইনআপকে তৃতীয় ওয়ানডেতে এমনভাবে ধোলাই করলো যে, ‘হাসতে হাসতে ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতে পাকিস্তানকে হোয়াইট-ওয়াশ করেই ছাড়লো বাংলাদেশ’।
পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার জন্য ২৫১ রানের লক্ষ্যে যেভাবে শুরু করা দরকার তাই করেছেন দুই টাইগার ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। শুরু থেকেই পাকিস্তান বোলারদের উপর চড়ে বসেন তারা। কোনভাবেই বাংলাদেশকে চাপে ফেলানোর সুযোগ দিতে চাননি তারা। এজন্য আক্রমনাত্মক ব্যাটিং করেন সৌম্য। তাকে যথাযথ সহায়তা দেন তামিম। ফলে ৬২ বলে দলীয় স্কোর হাফসেঞ্চুরিতে নিয়ে যান সৌম্য-তামিম।
দলীয় স্কোর ৫০ ছোয়ার পরও যেন মনের স্বাদ মিটেনি সৌম্য-তামিমের। তাই ছক্কা হাকিয়ে ১২৮ বলে দলীয় স্কোরকে শতরানের কোঠায় নিয়ে যান সৌম্য। ততক্ষনে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরি করে ফেলেন সৌম্য। তার পথ অনুসরন করে ২৯তম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ পান তামিম। নিজের ইনিংসটাকে বড় করার পথেই ছিলেন তামিম। কিন্তু ৬৪ রানে থামতে হয় তাকে। ৭৬ বলে ৮টি চার ও ১টি ছক্কা হাকিয়েছেন তামিম। মাঝে ৪ রান করে আউট হয়েছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
তবে সৌম্যর সঙ্গী তামিম বড় ইনিংস খেলতে না পারলেও, বাংলাদেশের স্মরনীয় সিরিজে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করেন সৌম্য। অনেকটা রাজকীয় ভঙ্গিতেই তিন অংকে পা রাখেন তিনি। ৩৪তম ওভারের শেষ বলে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক আজহার আলীর বল ডিপ-মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা হাকিয়ে ৯৪ বলেই সেঞ্চুরির স্বাদ পান সৌম্য।
সেঞ্চুরির পর সৌম্য পণ করেছিলেন- ‘ম্যাচ জয় ও পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়বেন’। তাই করেছেন সৌম্য। তার সাথে তালে তাল মিলিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। তৃতীয় অপরাজিত ৯৭ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশের জয় ও পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ নিশ্চিত করেন সৌম্য-মুশফিকুর। ১৩টি চার ও ৬টি ছক্কায় ১১০ বলে ১২৭ রানে অপরাজিত ছিলেন সৌম্য। আর ৪৩ বলে ৪৯ রানে অপরাজিত থাকেন মুশফিকুর। ম্যাচের সেরা হয়েছেন সৌম্য। আর ৩১২ রান করে সিরিজ সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন তামিম।
এর আগে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ম্যাচের মত এ ম্যাচেও টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্ত নেন পাকিস্তান অধিনায়ক আজহার আলী। প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্তটা সঠিক করার দায়িত্বটা নিজের কাঁেধই তুলে নেন আজহার। সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান ডেব্যু ম্যাচ খেলতে নামা সাদ আসলামকে। বাংলাদেশী বোলারদের দেখেশুনে খেলে স্কোরবোর্ডকে শক্তপোক্ত করার পথ তৈরি করে ফেলেন তারা। ফলে উদ্বোধনী জুটিতে শতরানের দোড়গোড়ায় পৌছে যায় পাকিস্তান। কোনভাবেই পাকিস্তানের উদ্বোধনী ভাঙ্গতে পারছিলো না টাইগার বোলররা। ততক্ষনে ছয় বোলার ব্যবহারও করে ফেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। তখন মাশরাফির মস্তিস্ক জুড়ে শুধু ‘পাকিস্তানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গার’ চিন্তা।
মাশরাফির সেই চিন্তা দূর করেন নাসির হোসেন। অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা আসলাম ৫০ বলে করেন ৪৫ রান। দলীয় ৯১ রানে প্রথম উইকেট হারায় পাকিস্তান। সফরকারীদের প্রথম উইকেট পেতে যেখানে ১৮ ওভার অপেক্ষা করতে হয়েছে স্বাগতিকদের, সেখানে দ্বিতীয় উইকেট পেতে মাত্র ২০ বল অপেক্ষা করতে হয়েছে। দলীয় ১০৫ রানে মোহাম্মদ হাফিজকে বোল্ড করে বাংলাদেশকে খেলায় ফেরান স্পিনার আরাফাত সানি। আগের ম্যাচেও সানির শিকার হয়েছিলেন হাফিজ। এই সিরিজে পুরো ব্যর্থ হাফিজ এ ম্যাচে করেন ৪ রান।
হাফিজের বিদায়ের পর আবারো বড় জুটি গড়ায় মনোযোগ দেন আজহার। এবার তাকে সঙ্গ দেন হারিস সোহেল। তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৯৮ রান যোগ করেন তারা। এরমধ্যে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেন আজহার। ১১১ বলে তিন অংকে পা দেয়া আজহার শেষ পর্যন্ত থামেন ১০১ রানে। তাকে ফিরিয়েছেন সাকিব আল হাসান। ১১২ বলের ইনিংসে ১০টি বাউন্ডারির মার ছিলো।
আজহারের পরপরই প্যাভিলিয়নে ফিরেন হারিসও। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পঞ্চম হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ পাওয়া হারিস ৫২ রান করে মাশরাফির বলে আউট হন। আজহার ও হারিস মূলত পাকিস্তানের বড় সংগ্রহের ভীতটাই গড়ে দিয়েছেন। এই দু’ব্যাটসম্যান যখন বিদায় নেন, তখন পাকিস্তানের স্কোর ছিলো- ৩৯ দশমিক ২ বলে ৪ উইকেটে ২০৭ রান।
এমন পরিস্থিতি দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন- আজ তিন শতাধিক রানের পাহাড়ে চড়বে পাকিস্তান। কিন্তু ভাবনাবিদদের ভাবনাই পাল্টে দিয়েছে মাশরাফিবাহিনীর বোলাররা। পরবর্তী ৫৮ বলে পাকিস্তানের শেষ ছয় উইকেট মাত্র ৪৩ রানে তুলে নেন মাশরাফি-সানি-সাকিব ও রুবেল। ৪৯ ওভারে পাকিস্তানকে ২৫০ রানে বেঁধে ফেলেন তারা। শেষদিকে সফরকারীদের পক্ষে দু’অংকের কোঠা পার হয়েছেন সাদ নাসিম, করেছেন ২২ রান। বাংলাদেশের পক্ষে মাশরাফি, রুবেল, সাকিব ও সানি ২টি করে উইকেট শিকার করেছেন।
স্কোর কার্ড :
পাকিস্তান ইনিংস :
আজহার আলী ব সাকিব ১০১
সামি আসলাম ক মুশফিকুর ব নাসির ৪৫
মোহাম্মদ হাফিজ ব আরাফাত সানি ৪
হারিস সোহেল ক মুশফিকুর ব মাশরাফি ৫৩
মোহাম্মদ রিজওয়ান ক এন্ড ব সাকিব ৪
ফাওয়াদ আলম ক নাসির ব মাশরাফি ৪
সাদ নাসিম ক তাসকিন ব রুবেল ২২
ওয়াহাব রিয়াজ ক মাশরাফি ব রুবেল ৭
উমর গুল রান আউট (সাকিব/সানি) ০
জুলফিকার বাবর অপরাজিত ১
জুনায়েদ খান ব সানি ৪
অতিরিক্ত লে বা-১, ও-৫ ৬
মোট অলআউট, ৪৯ ওভার ২৫০
উইকেট পতন : ১/৯১ (আসলাম), ২/১০৫ (হাফিজ), ৩/২০৩ (আজহার), ৪/২০৭ (হারিস), ৫/২১৩ (রিজওয়ান), ৬/২২৪ (ফাওয়াদ), ৭/২৪৩ (ওয়াহাব), ৮/২৪৪ (গুল), ৯/২৪৫ (নাসিম), ১০/২৫০ (জুনায়েদ)।
বাংলাদেশ বোলিং :
বোলার ওভার মেডেন রান উইকেট
মাশরাফি বিন মর্তুজা ১০ ০ ৪৪ ২
তাসকিন আহমেদ ২ ০ ২২ ০
নাসির হোসেন ৭ ০ ৩৭ ১
রুবেল হোসেন ৬ ০ ৪৩ ২
আরাফাত সানি ১০ ০ ৪৩ ২
সাকিব আল হাসান ১০ ০ ৩৪ ২
সাব্বির রহমান ২ ০ ১৭ ০
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ২ ০ ৯ ০
বাংলাদেশ ইনিংস :
তামিম ইকবাল এলবিডব্লু ব জুনায়েদ ৬৪
সৌম্য সরকার অপরাজিত ১২৭
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ব জুনায়েদ ৪
মুশফিকুর রহিম অপরাজিত ৪৯
অতিরিক্ত লে বা-১, ও-৪, নো -২ ৭
মোট ২ উইকেট, ৩৯.৩ওভার ২৫১
উইকেট পতন : ১/১৪৫ (তামিম), ২/১৫৪ (মাহমুদুল্লাহ)।
বোলার ওভার মেডেন রান উইকেট
মোহাম্মদ হাফিজ ৮ ১ ৩৭ ০
উমর গুল ৭ ০ ৫৩ ০
ওয়াহাব রিয়াজ ৬ ০ ৩০ ০
জুনায়েদ খান ৭.৩ ০ ৬৭ ২
জুলফিকার বাবর ১০ ০ ৫৬ ০
আজহার আলী ১ ০ ৭ ০
ফল : বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ : তিন ম্যাচ সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জিতলো বাংলাদেশ।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : সৌম্য সরকার (বাংলাদেশ )।
ম্যান অব দ্য সিরিজ : তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ )।