কেবল রাজনীতিবিদই নন, চলচ্চিত্র ও খেলার জগতের তারকারাও আছেন অবৈধভাবে কালো টাকা সাদা করার ঘরে। ফাঁস হওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ৩৪ বাংলাদেশি ও দুটি প্রতিষ্ঠানর নাম তালিকায় আছে। তবে এই কেলেঙ্কারি নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের ব্রিটেন বাদে আর কোনো দেশের সরকার প্রধান কিংবা রাজনীতিকের নাম না থাকায় এই প্রশ্ন আরো জোরালো হয়েছে। কেলেঙ্কারি ফাঁসের হোতা বলে পরিচিতি পাওয়া মোসাক ফনসেকা বলছে, ফাঁস হয়নি, তথ্য হ্যাক হয়েছে। এক কোটি ১৫ লাখ তথ্য ফাঁস হয়েছে যা ২ দশমিক ৬ টেরাবাইটের সমান। পানামা পেপারস’ নামে ওসব নথি প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)।
চাপের মুখে ক্ষমতাধররা
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি নিয়ে চাপের মুখে আছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এর সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত না হলেও তার প্রয়াত বাবা ইয়ান ক্যামেরনের নাম এসেছে। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত তার বিনিয়োগ কোম্পানি ব্লেয়ারমোর ফান্ডের নামও আছে কর কেলেঙ্কারিতে। বিরোধী লেবার নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, সরকারের উচিত ট্যাক্স কেলেঙ্কারির ব্যাপারে ইতস্তত না করে সত্য প্রকাশ করা। লেবার নেতা জেরেমি করবিন একে দুর্নীতির ভাণ্ডার হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আপনি চাইলে এখানে আপনার টাকা লুকিয়ে রাখতে পারেন। এটা আন্তর্জাতিক দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য পানামা ট্যাক্স স্ক্যান্ডাল থেকে মুক্ত। ক্যামেরন সাংবাদিকদের বলেন, আমার কোনো শেয়ার নেই, অফশোল ট্রাস্ট কিংবা তহবিল নেই। তিনি জানান, যা বেতন পান তার থেকে সঞ্চয় আর একটি বাড়ি রয়েছে। ব্রিটিশ দ্য টাইমস পত্রিকা এক প্রতিবেদনের জানিয়েছে, ৩০ বছর ধরে ব্লেয়ারমোর ফান্ডের নামে কর পরিশোধের কোনো রেকর্ড নেই। ডাউনিং স্ট্রিটের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, এটা ক্যামেরন পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ রকম জবাবে অবশ্য সন্তুষ্ট হতে পারেনি কেউ। ফলে গতকাল বুধবার ডাউনিং স্ট্রিট থেকে ফের বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ভবিষ্যতে ক্যামেরন কিংবা তার পরিবারের কোনো সদস্য ব্লেয়ারমোর ফান্ড থেকে কোনো ধরনের সুবিধা নেবেন না। তালিকায় নাম এসেছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বড় বোনের জামাই দেং জিয়াগুয়ের নাম। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান ও সাবেক আটজন প্রভাবশালী নেতাও কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঘনিষ্ঠ ৭ আত্মীয়ের নামে বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর দেশটিতে এ সম্পর্কে আলোচনায় নজরদারি করছে সরকার। রাশিয়ার শক্তিধর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি কেলেঙ্কারিতে জড়িত না থাকলেও তার বাল্যকালের দুই বন্ধু আরকাদি ও বরিস রোতেনবুর্গ ভ্রাতৃদ্বয়ের নাম উঠে এসেছে তালিকায়। দুই ভাই রাষ্ট্রায়ত্ত নানা খাতে ঠিকাদারি কাজ করে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করেছেন। অভিযোগ উঠেছে প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজেকে আড়াল করার জন্যই বন্ধুদের দিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন এবং অবৈধভাবে কালো টাকা সাদা করছেন। পুতিনের আরেক বন্ধু সের্গেই রোলদুগিনের নামও আছে তালিকায়। তিনি নিজেকে ‘পুতিনে প্রায় ভাইয়ের মতো’ বলে পরিচয় দেন।
পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দুই ছেলে ও মেয়ের নাম তালিকায় আছে। নওয়াজের দুই ছেলে হাসান ও হুসেন নওয়াজ শরিফ এবং মেয়ে মরিয়ম সফদার ইস্পাত, চিনি ও কাগজের মিলের মালিক। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পানামা পেপারসের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। দেশটির পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফের প্রধান ইমরান খান নওয়াজের সম্পদের তদন্তের দাবি জানিয়েছে ইতোমধ্যে। এছাড়া সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ বিন আবদুল রহমান আল সৌদ, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ছেলে আলা মোবারক, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের মামাতো দুই ভাই রামি ও হাফেজ মাখলুফের নাম মোসাক ফনসেকার তালিকায় উঠে এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার ভাতিজা ক্লিভ খুলুবুসুজে জুমা বিদেশে অর্থ পাচার করেছিলেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ছেলে মোহাম্মদ নাফিজুদ্দিন মোহাম্মদ নাজিবেরও নাম রয়েছে নথিতে।
ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিতে দেখা গেছে, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন ও তার স্ত্রী ২০০৭ সালে উইনট্রাস নামের কোম্পানিটি ক্রয় করেন। ২০০৯ সালে দেশটির পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাওয়া লভ্যাংশের কথা গোপন করেছিলেন। গত ৫ এপ্রিল বিক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। দেশটিতে আগাম নির্বাচন দেয়া হচ্ছে। ‘পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারিতে কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে আর্জেন্টিনার তারকা খেলোয়াড় মেসি, বর্তমান ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো ও আরও কিছু ফুটবলারের নামে। তবে স্পেনে খবর প্রকাশ করা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছেন মেসি। আর ইনফান্তিনো অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি ছিলেন উয়েফার সাবেক মহাসচিব। ভারতীয়দের তালিকায় শীর্ষ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অমিতাভ বচ্চন ও তার পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়া রাই, করপোরেট ব্যবসায়ী কেপি সিং ও তার পরিবারের ৯ জন সদস্য, আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানিসহ অনেকের নাম রয়েছে। ভারতের অন্তত ৫শ ব্যক্তির বিদেশে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ফাউন্ডেশন এবং ট্রাস্টের সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ আর্থিক লেনদেন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই এ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের দৌঁড়ে থাকা বার্নি স্যান্ডার্স ২০১১ সালে পানামাকে কর ফাঁকির দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি পানামা বাণিজ্য চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এছাড়া অন্যান্য প্রার্থীরা আর্থিক দিয়ে শক্তিশালী হলেও স্যান্ডার্স নিজেকে সমাজতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেন এবং তার সম্পদও আর সবার মতো নেই।
২৫ বাংলাদেশির নাম
মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে উঠে এসেছে ২৫ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার কথা। এর মধ্যে ২টি কোম্পানি, একজন সুবিধাভোগী ও ২২ জন শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এক এমপির নামও রয়েছে। হস্তগত গোপন নথি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ী বিদেশে কোম্পানি স্থাপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী নিলুফার জাফরের নাম। তবে জাফরউল্লাহ ও তার স্ত্রী উভয়েই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ ছাড়া মার্কেন্টাইল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আজিজ খান, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আজিজ খান, কন্যা আয়েশা আজিজ খান, ভাই জাফর উমায়েদ খান ও ভাগ্নে ফয়সাল করিম খান বিদেশে মোট ছয়টি কোম্পানি চালান। এর মধ্যে ব্রিটিশ ভার্জিন আইসল্যান্ডের কোম্পানি সিঙ্গাপুরের ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধন করা হয়েছে। এসব কোম্পানি অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তবে আজিজ খান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তাদের কার্যক্রম আইনসম্মত বলে দাবি করেন। বিদেশে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে আরও যেসব অর্থ পাচারকারীর নাম ওই তালিকায় দেয়া আছে, সেগুলো হচ্ছে ইউনাইটেড গ্রুপ অব কোম্পানির হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মঈনুল আহসান (শামীম), আহমেদ ইসমাইল হোসেন, আখতার মাহমুদ, স্কয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. এএমএম খান, মমিন টির পরিচালক আজমত মঈন, পাট ব্যবসায়ী দিলিপ কুমার মোদি, সি পার্ল লাইন্সের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ সিরাজুল হক, বাংলা ট্রাক লিমিটেডের মো. আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক ও তারিক ইকরামুল হক, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার ক্যাপ্টেন সোহাইল হাসান, মাসকট গ্রুপ অব কোম্পানির চেয়ারম্যান এফএম জোবায়দুল হক, সেতু কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, তার স্ত্রী উম্মে রব্বানা, স্পার্ক লিমিটেড ও অমনিকেমের চেয়ারম্যান ইফতেখারুল আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেডের নির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম, তার স্ত্রী আসমা মোনেম এবং অনন্ত গ্রুপের শরীফ জহির।
অস্বীকার করছেন অনেকে
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমর্থকরা এ ঘটনাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্র বলে বর্ণনা করেছেন। ক্রেমলিনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, যে সাংবাদিকরা এই গোপন দলিল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে তাদের অনেকেই সিআইএ বা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক কর্মকর্তা। ভারতের চলচ্চিত্র তারকা অমিতাভ বচ্চন অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা জমিয়েছেন বলে যে খবর এসেছে তা অস্বীকার করেছেন তিনি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘আমি কখনোই এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলাম না। সম্ভবত কেউ আমার নামের অপব্যবহার করেছে। আইন অনুসারে সব ধরনের কর পরিশোধ করে থাকেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা এসব দলিলপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এসব খবর সম্পূর্ণ অসত্য।
ওবামা যা বলছেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কর ফাঁকি রোধে আন্তর্জাতিক কর নীতি সংস্কারের কথা বলেছেন। কর ফাঁকির তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর গত মঙ্গলবার এ কথা বলেন তিনি। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আন্তর্জাতিকভাবে কর ফাঁকি একটি বড় ধরনের সমস্যা। যদিও বড় একটি অংশ বৈধ, অবৈধ নয়। তিনি বলেন, কেবল কর ফাঁকি দেয়ার জন্যই আমাদের এই টাকাকে লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয় এবং সেটাকে বৈধ বলা উচিত নয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেন, ধনী এবং প্রভাবশালীরা কোনো আইন লঙ্ঘন করেননি। কারণ তাদের অনেক আইনজীবী আছেন যারা দায় এড়াতে ভূমিকা পালন করেন। তারা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে এই কাজ করেন।